ছেলের সামনে কারাফটকে মা-বাবার বিয়ে

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:১৫ | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:১৮

ব্যুরো প্রধান, রাজশাহী

ধর্ষণ মামলায় আট বছর ধরে কারাগারে বন্দি আছেন দিলীপ খালকো (৩০)। ২০১২ সালে ধর্ষণের দায়ে আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। সম্প্রতি উচ্চ আদালতে দিলীপের আইনজীবী তার জামিনের আবেদন করেন। জামিন দিলে তাতে আপত্তি থাকবে না বলে জানিয়েছিলেন ধর্ষণের শিকার ওই নারী। কারণ হিসাবে আদালতে তিনি বলেছিলেন, কয়েদির সঙ্গে তার বিয়ে হবে। সেজন্য জামিনে আপত্তি নেই তার। এরপর আদালত কারাফটকে বিয়ের আদেশ দিলে শনিবার বিয়ের পিড়িঁতে বসেন তারা।

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে দুপুরে দিলীপ খালকোর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। কয়েদি দিলীপ খালকোর বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায়। বিয়ে সম্পন্নের জন্য এদিন কনেসহ দুই পরিবারের অন্তত ১৪ জন কারাগারে গিয়েছিলেন। উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যও। তাদের সঙ্গে এসেছিল ধর্র্ষণের ফলে জন্ম নেয়া ভিকটিম নারীর আট বছরের ছেলেও।

কনেসহ দুই পরিবারের সদস্যরা বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শ্যালোইঞ্জিন চালিত একটি নসিমনে চড়ে কারাগারের সামনে আসেন। এরপর তাদের কারাফটকে ঢোকানো হয়। আগে থেকেই উপস্থিত হয়েছিলেন হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রার কৃষ্ণা দেবী এবং পুরহিত পরিমল চক্রবর্তী। কনেপক্ষ আসার পর কারাগার থেকে বর দিলীপ খালকোকে আনা হয়। তিনি একটি সাদা পাঞ্জাবি পরেছিলেন। মাথায় দিয়েছিলেন মোটা কাগজের টোপর। কয়েদিরাই এটা বানিয়ে দিয়েছিলেন।

কারাগারের অফিস কক্ষের পাশে জানালার সামনে এসে দাঁড়ান দিলীপ। তখন জানালার কাছে এগিয়ে যায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া তার ছেলে। জানালার ওপারে দিলীপের পাশে এসে কনে দেখার জন্য ভিড় করেন কয়েদিরা। ভেতরে একটি চেয়ারে বসানো হয় কনেকে। সাজানো হয় বিয়ের সাজে। তারপর এই কক্ষে আনা হয় বর দিলীপকে। এরপরই কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালার উপস্থিতিতে দুপুর সাড়ে ১২টার পর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।

প্রথমে নিবন্ধন বহিতে বর-কনের স্বাক্ষর নেন হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রার। তারপর দুজনকেই পরিয়ে দেয়া হয় গাদা ফুলের মালা। পুরোহিত তাদের দুজনকে তিনবার মালাবদল করান। এরপরই উলুধ্বনি দেন দুই পরিবারের নারীরা। তারপর দিলীপের বোন কনেকে শাখা পরিয়ে দেন। মাথায় তুলে দেন সিঁদুর। পুরোহিত এবার দিলীপকে বলেন, ‘আগে যা ভুল করেছেন, করেছেন। আর না। এখন থেকে মেয়েটি তোমার অর্ধাঙ্গিনী হলো। সুখে-দুঃখে তাকে নিয়েই থাকবে।’ দিলীপ কথা দেন। এরপর বর-কনের হাতে উপহার হিসেবে ধনের প্রতীক ধান এবং দীর্ঘায়ুর প্রতীক দুর্বা ঘাস তুলে দেয়া হয়। শেষ হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। এ সময় সিনিয়র জেল সুপার কনেকে একটি নতুন শাড়ি উপহার দেন। দুই পরিবারের সবাইকে মিষ্টিমুখ করান।

বিয়ের অনুভূতির বিষয়ে জানতে চাইলে দিলীপ বলেন, ‘বিয়ে করে ভালোই লাগছে। সবাই দোয়া করবেন। যেন সুখে-শান্তিতে সংসার করতে পারি।’ কনে বলেন, ‘আমরা চাই যেন বাকি জীবনটা ভালভাবে কাটাতে পারি।’

সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা বলেন, উচ্চ আদালত আমাদের দিলীপের বিয়ে সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিন দিন আগে আদেশের কপি পাওয়ার পরই দুইপক্ষকে ডাকি। সুষ্ঠুভাবে বিয়েও সম্পন্ন হলো। এখন যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের কাগজপত্র উচ্চ আদালতে পাঠানো হবে।

দিলীপ কুমার এবং ভিকটিম সম্পর্কে আত্মীয়। তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। সম্পর্কের এক পর্যায়ে ২০১১ সালে গর্ভবতী হয়ে পড়েন ওই নারী। এরপর থেকে দিলীপ আর বিয়ে করতে রাজি হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সালিশ করার কথা বলে সময়ক্ষেপণ করা হয়। শেষ পর্যন্ত সালিশ বৈঠক না হওয়ায় ভিকটিম ওই বছরের ২৩ অক্টোবর প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা করেন। এরপর ২৫ অক্টোবর গোদাগাড়ী থানায় হাজির হয়ে দিলীপ খালকোর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন।

মামলায় আসামির বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর বিচার শেষে ওই বছরের ১২ জুন এক রায়ে দিলীপ খালকোকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন আদালত।

যখন ভিকটিম ধর্ষণের শিকার হন তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর। কিন্তু সেই বয়সেই তার কোলে আসে পুত্র সন্তান। মেয়েটির আর পড়াশোনা করা হয়নি। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা মেয়েটি কৃষিশ্রমিক হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন। দিনে দিনে বড় হতে থাকে তার সন্তান। তার সন্তানের বয়স এখন আট বছর। দিলীপেরও আট বছর জেল খাটা হয়ে গেছে। এতদিন পর দুই পরিবারের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। কনের সম্মতিতেই আদালত তাদের বিয়ের আদেশ দেন। এখন বিয়ের কাগজপত্র উচ্চ আদালতে গেলে জামিন পেতে পারেন দিলীপ খালকো।

ঢাকাটাইমস/৫ডিসেম্বর/আরআর/এমআর