সাতক্ষীরায় সরকারি প্রকল্পের কোটি টাকা কর্মকর্তাদের পকেটে

এম বেলাল হোসাইন, সাতক্ষীরা
 | প্রকাশিত : ১২ ডিসেম্বর ২০২০, ১৭:৪১

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার তলুই গাছা গ্রামের আকলিমা খাতুন ২০১৪ সালে ‘একটি বাড়ি একটি খামার সমিতির’ সদস্য হয়েছেন। প্রতি মাসে সঞ্চয় হিসেবে টাকা জমা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তবে অফিস থেকে টাকা জমা দেয়ার বই আজও পাননি। আবার অডিট অফিসার এসে বলে গেছেন, তার নামে ১০ হাজার টাকার ঋণ উঠানো হয়েছে। ঋণ নেয়া সম্পর্কে কিছুই তার জানা নেই।

একই গ্রামের কামরুজ্জামান জানালেন সমিতির কর্মকর্তারা তার বাবা, ভাই ও বোনের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। বৃদ্ধ নাসের সরদার জানালেন, তিনি কখনও অফিসে যাননি। কোনো কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেননি। অথচ তার নামে ঋণ নেয়া হয়েছে ২০ হাজার টাকা। সদস্য বই তার বাড়িতে আছে। কিভাবে এই ঋণের টাকা দেয়া হলো? আর কে উঠালো এই টাকা? নাসের সরদারের সঙ্গে কথা বলার সময় রিক্তা খাতুন নামে একজন বললেন, তার নামেও ঋণ উঠানো হয়েছে।

আহাদ আলী নামে আরেকজন এ প্রতিবেদককে জানান, তাদের স্বাক্ষর ছাড়া কিভাবে এই প্রতারকদের কাছে ঋণের টাকা দেয়। মনিরুজ্জামান নামে একজন জানান, একটি বাড়ি একটি খামার সরকারি প্রতিষ্ঠান। তার সদস্য বই কেন অফিসের লোকজনদের কাছে থাকবে? আর এভাবে কেন সদস্যদের নামে টাকা তুলে পকেট ভর্তি করবেন অফিসাররা।

আলী হোসেন ও হামজের আলী জানালেন, তারা ঋণ নিয়েছিলেন। ঋণের টাকা সুদসহ পরিশোধ করেছেন। তবে অফিসে জমা হয়নি। এমনই অভিযোগ করলেন তৈয়েব আলী, পারভীন খাতুন, হাছিনা খাতুন, নাজমা খাতুন, আবেদাসহ বহু সদস্য।

একই অভিযোগ করেছেন বাশদহা ইউপি চেয়ারম্যান মোশারাফ হোসেন। তার নামে ও তার মায়ের নামে কে বা কারা এই অফিস থেকে ঋণ নিয়েছেন, যার কোনো কিছুই তার জানা নেই। ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের ঢাকা অফিস থেকে অডিট অফিসার আসার পরে গ্রাহকরা এসব তথ্য জানতে পারেন।

‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের গ্রাহকদের এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে এই প্রতিবেদক যান সদর উপজেলা অফিসে। অফিসের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলতেই বেরিয়ে আসে গ্রাহকদের ভোগান্তি আর অনিয়মের কাহিনি।

অফিসের কর্মকর্তারাই ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের এক কোটি ২৭ লাখ টাকা আত্নসাৎ করেছেন। সদস্যদের কাগজপত্র জালজালিয়াতি করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন অসাধু এই অফিসাররা। গ্রাহকের নিকট থেকে সঞ্চয় ও ঋণের টাকা নিয়ে ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজেদের পকেট ভারি করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ২০১৪ সালে শুরু হয় একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প। পরবর্তীতে এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ‘আমার বাড়ি আমার খামার’। সরকারিভাবে পরিচালিত হওয়ায় উপজেলার গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে এই সমিতি।

বর্তমানে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ১২ হাজার সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার সদস্যের টাকা তছনছ করেছেন আগের কর্মকর্তারা। সেই অডিট অনুযায়ী এক কোটি ২৭ লাখ টাকা খোয়া গেছে প্রকল্পের গ্রাহকদের। এর মধ্যে ১৯ লাখ টাকা উদ্ধার করেছেন বর্তমানে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা।

এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শাখা ব্যবস্থাপক ও উপজেলা সমম্ময় কারি মেহেদী হাসান, জুনিয়র অফিসার আব্দুল মুকিব, সুপার ভাইজার রফিকুল ইসলাম ও শরিফুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। ফৌজদারি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

বরখাস্ত হওয়া শাখা ব্যবস্থাপক ও উপজেলা সমন্বয়কারী মেহেদী হাসান জানান, তিনি কোনো টাকা আত্মসাৎ করেননি। যারা টাকা নিয়েছে তারা স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তবে তার মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল ছিল বলে তিনি স্বীকার করেছেন।

জুনিয়র অফিসার আব্দুল মুকিব জানান, তিনি ৫৩ লাখ টাকার মতো নিয়েছেন। এই টাকা বাড়ির কাজে ব্যবহার করেছেন। তিনি ইতিমধ্যে কিছু টাকা ফেরত দিয়েছেন। তবে তার নিকট অতিরিক্ত টাকা দাবি করা হচ্ছে। তার পক্ষে অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব নয়।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ‘আমার বাড়ি, আমার খামার’ প্রকল্পের সিনিয়র অফিসার বিশ্বজিত সরদার জানান, বৈকারি, কুশখালী, বাঁশদহা ইউনিয়নে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এক কোটি ২৭ লাখ টাকার মধ্যে ১৯ লাখ টাকা উদ্ধার হয়েছে। ইতোমধ্যে চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয় মামলা দিয়েছে প্রধান অফিস। তাদের নামে ফৌজদারি মামলার প্রস্তুতি চলছে।

বিশ্বজিত সরদার বলেন, এই টাকা উদ্ধার করার জন্য সব ধরনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে কিছু এলাকায় আমার বাড়ি, আমার খামার প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনা করতে অসুবিধা হচ্ছে।

(ঢাকাটাইমস/১২ডিসেম্বর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :