সড়কে মৃত্যুর মিছিল, এর শেষ কোথায়?

শাহাবুদ্দিন শুভ
 | প্রকাশিত : ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:০৬

প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে কোনো না কোনো তাজা প্রাণ। প্রতি বছর হাজারো মানুষ পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব দুর্ঘটনার ফলে থমকে যাচ্ছে বহু পরিবারের এগিয়ে যাওয়া। সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছে এবং যারা আহত হয়ে পঙ্গু জীবনযাপন করছে, একমাত্র তারাই এর কঠিন যন্ত্রণা এবং বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে। এই কঠিন বাস্তবতা আপনার আমার জীবনে যেকোনো সময় ঘটতে পারে।

বিগত কয়েক দিনের সড়ক দুর্ঘটনার খবরের দিকে নজর দিলে সহজেই আমরা অনুধাবন করতে পারি আমাদের দেশের সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ কি হারে বাড়ছে:

নবীগঞ্জে বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ৮ (সিলেট ভয়েস, ৭ ডিসেম্বর, ২০২০)

ঘন কুয়াশায় টাঙ্গাইলে দুই ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত ৫ ( মৃদুভাষণ, ৮ ডিসেম্বর ২০২০)

সারা দেশে সড়কে ঝরল ২১ প্রাণ (ঢাকাটাইমস, ৪ ডিসেম্বর ২০২০)

ছুটির দিনে সড়কে ঝরল ২১ প্রাণ (যুগান্তর ৪ ডিসেম্বর ২০২০)

মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ফিরে আসলো ৬ লাশ (কালের কণ্ঠ ৪ ডিসেম্বর, ২০২০)

পাঁচ দিনে সড়কে ঝরল ৫৫ প্রাণ (কালের কণ্ঠ ৫ আগস্ট ২০২০)

উপরের শিরোনামগুলো থেকে সহজেই আমরা অনুমান করতে পারি সারা বছরে দেশে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা কীভাবে বাড়ছে। ৪ ও ৭ ডিসেম্বরের দুটি খবরের দিকে যদি চোখ রাখি তাহলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে-

৭ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে সিলেট ভয়েস শিরোনাম করে ‘নবীগঞ্জে বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ৮’ খবরের বিস্তারিত বলা হয় ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নের সাতাহাইল এলাকায় অটোরিকশা ও বিআরটিসি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের তিনজনসহ ৮ জন নিহত হয়েছেন। সোমবার (৭ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নবীগঞ্জ উপজেলার সাতাহাইল এলাকায় এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। নিহতদের মধ্যে ৬ জনের পরিচয় জানা গেছে।’

৪ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে ঢাকাটাইমস তাদের শিরোনামে লিখে ‘সারা দেশে সড়কে ঝরল ২১ প্রাণ’। খবরের বিস্তারিত লেখা হয়েছে ‘দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমছেই না। প্রতিনিয়ত সড়কে ঝরছে প্রাণ। শুক্রবারও দেশের আট জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে সকাল থেকে বিকালের মধ্যে। যেসব জেলায় এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে মানিকগঞ্জে। এখানে সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন একই পরিবারের ছয়জনসহ সাতজন। বাকি দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে টাঙ্গাইল, নাটোর, মাগুরা, ভোলা, ফরিদপুর, বগুড়া ও রাজধানী ঢাকায়।’

আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়, যেকোনো উৎসবের সময় মানুষ যখন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করেন বিশেষ করে ঈদ বা পূজার ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনা পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। চলতি বছরের করোনাকালীন সময় যেখানে মানুষ অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বাড়িমুখী কম ছিল তার পরও ৫ দিনে ঈদুল আজহার ছুটির শুরু থেকে পাঁচ দিনে দেশের ৩১ জেলায় ৩৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫৫ জন এবং আহত হয়েছে ৫২ জন।

বাংলাদেশে শীতকালে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়তে থাকে। লেখার শুরুতেই যে ২টি খবর দিয়ে লেখা শুরু করা হয়েছে সেগুলোর অন্যতম কারণ কুয়াশা ও ওভারটেকিং। যদিও কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক পরিচালক শেখ মাহবুব-ই-রাব্বানী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঘন কুয়াশায় গাড়ি চালানোর বিষয়ে নানা ধরনের সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব নিয়মকানুনের মধ্যে রয়েছে-

কুয়াশায় দৃষ্টিসীমার মধ্যে থামানো যায় এমন ধীর গতিতে সব সময় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে রাস্তায় গাড়ি চালাতে হবে।

ফগ লাইট এবং পার্কিং লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হবে।

লেন পরিবর্তন বা ওভারটেকিং করা যাবে না। কারণ পেছনের গাড়ি ঘন কুয়াশায় সামনের গাড়িকে নাও দেখতে পারে।

হাই বিম কুয়াশাকে আরো বেশি ঘন করে বিধায় হাই বিমে গাড়ি চালানো যাবে না। সব সময় লো-বিমে গাড়ি চালাতে হবে।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আবার সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএ’র হিসাব মতে, প্রতিদিন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রায় ৩০ জন। সে হিসাবেও বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮শ জন। আবার বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বছরে ১২ হাজার, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রেকর্ড অনুযায়ী ২০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। অন্যদিকে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ১২ হাজার মানুষ নিহত হন। বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে নিহতের সংখ্যা কিছু তারতম্য থাকলেও বছরে ১০-১২ হাজার মানুষ শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার তথ্য আমাদের পিলে চমকে দেওয়ার মতো। সড়ক দুর্ঘটনায় এত মানুষের মৃত্যু হলেও যেখানে প্রশাসন বা চালকদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এটা ঠিক যে, পৃথিবীর সব দেশেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু সে সব দেশে যথাযথভাবে বিচারের মুখোমুখি হোন চালকরা। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে ব্যতিক্রম।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ কুয়াশার মধ্যে গাড়ি কীভাবে চালাতে হবে তার জন্য গাড়িচালকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতেই এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে। তবে এগুলো না মানলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান নেই। আমাদের দেশের চালকদের আসলে আইন মানারই প্রবণতা কম, সেখানে শুধু নির্দেশনা দিলেই হবে? আমার তো মনে হয় আমাদের সড়কে শৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা কমাতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধি যত দিন পর্যন্ত বাড়ানো না হবে তত দিন সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হবে না।

লেখক: শাহাবুদ্দিন শুভ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটপিডিয়া

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :