‘মেধাবীদের বিকশিত করতে না পারার দায় এড়ানো যাবে না’

প্রকাশ | ১৯ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:২৬ | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:১৩

তানিয়া আক্তার
ঢাকাটাইমস

স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় সব ক্ষেত্রেই উন্নতি হলেও দেশের শিক্ষাক্ষেত্র পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ। শিক্ষাক্ষেত্রের এই যে ক্ষতি তার জন্য রাজনীতিকীকরণকে দায়ী করে মেধাবীদের বিকশিত করতে না পারা প্রকারান্তরে শিক্ষকদের দায় বলেও ভাষ্য তার।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জন এবং প্রত্যাশা নিয়ে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরে ঢাবির এই সাবেক উপাচার্য ঢাকা টাইমসের কাছে এসব কথা বলেন। তানিয়া আক্তারের সঙ্গে আলাপনে এস এম এ ফায়েজ শিক্ষাক্ষেত্রের অর্জন, ঘাটতি আর বিদ্যমান ব্যবস্থার ওপর আলোকপাত করেন।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করা উপাচার্যদের একজন আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি দীর্ঘসময় দেশের উচ্চশিক্ষার অবস্থাও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন সেক্ষেত্রে শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে আপনার ভাবনা কেমন?

এস এম এ ফায়েজ: অর্জনের দিকে যদি তাকাই তাহলে শিক্ষাঙ্গন হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বে যেকোনো দেশ যা করতে পারেনি তা এই বিশ্ববিদ্যালয় করেছে। সবই অতীত। কিন্তু এই অর্জনগুলোর পরে আমরা কি করেছি তা কতটুকু অদূর ভবিষ্যতে আমাদের উজ্জীবিত করবে তা কিন্তু খুবই চিন্তার বিষয়। কারণ খুবই দুঃখের বিষয় অতীতের তুলনায় খুব উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই করিনি। অথচ একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে এতটা উন্নতি হওয়া খুবই আশ্চর্যের বিষয়। কারণ একটা দেশ দাঁড়াতে পারবে কিনা সেটা নিয়েই সন্দেহ ছিল। কিন্তু আমরা কী চমৎকারভাবে টিকে গেছি! ফলে অনেকক্ষেত্রেই উন্নয়ন হয়েছে শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই চরমভাবে পিছিয়ে পড়েছি। প্রতিনিয়ত শিক্ষাকে অবহেলা করে এসেছি। ফলে আজকের এই দুরবস্থা।

শিক্ষাক্ষেত্রে এই হতাশাজনক অবস্থার প্রেক্ষাপটটা কেমন?

এস এম এ ফায়েজ: স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করি। স্বাধীনতার পর স্বাধীনতাকামী তরুণদের যে উদ্যম ছিল সেটাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিফলন ঘটানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। সুতরাং সেই তরুণদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী করতে স্বাভাবিকভাবেই একটা সময় নিয়েছে। তারপর যা হলো প্রতিভাবানদের চরমভাবে অবমূল্যায়ন করা হলো। ফলে যে ধরনের শিক্ষক আমরা আশা করি সে ধরনের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। এটাও দীর্ঘ সময় নিয়েছে। এরপর আবারও মেধাবী মূল্যায়ন শুরু হয়েছিল কিন্তু সেটা আবার কমে গিয়েছে।

একজন উপাচার্যের চোখ থেকে যদি দেখি তাহলে বলতে পারি যে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দলের শক্তি বাড়াতে হবে শিক্ষকদের এই ভাবনাটা বেড়েছে খুব বেশি পরিমাণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাতালিকায় প্রথম হয়েও সেই শিক্ষার্থী নিশ্চিত হতে পারছে না যে সে শিক্ষক হতে পারবে। আর এটার ফলে হতাশা তৈরি হচ্ছে। আর এদিকে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে নিয়মিত ভাবেন তারা যে দলেরই হোক না কেন এই দলকেন্দ্রিক মনোভাব নিয়ে যে কর্মকাণ্ড তা নিয়ে তারাও ভীষণ বিরক্ত। যে এটা কী হচ্ছে, কী দেখছি আমরা! আর শিক্ষকদের এই দলীয় মনোভাব এবং এর তিক্ত প্রভাব কতদিন চলমান থাকবে তা জানা নেই। তবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রধান কাজটি হচ্ছে একজন উপাচার্যের। তিনি সমস্ত কিছুকে ভালোর পথে চালিত করতে পারেন।

অবস্থা থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে কী করা দরকার বলে মনে করেন?

এস এম এ ফায়েজ: স্বাধীনতার এতগুলো বছর কেটে গেছে আমরা একটা কার্যকর শিক্ষা কমিশন করতে পারিনি। কুদরাত-এ-খুদা কমিশন ভালোর দিকে ছিল কিন্তু অন্য কমিশনগুলো এক সরকার করলো অন্য সরকার বাদ দিল। কুদরাত-এ-খুদা কমিশন থেকে বেরিয়ে আসি কারণ সেটা অনেক আগের বিষয়। এখন বর্তমানকে নিয়ে ভাবতে হবে। আর বর্তমান নিয়ে ভাবতে গেলে সত্যিকারভাবে যারা যোগ্য তাদের নিয়ে একটা কমিশন করা উচিত। এদিকে শিক্ষানীতি তৈরির ক্ষেত্রেও যোগ্য লোকের উপস্থিতি কম হওয়ায় একটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এভাবে রাজনৈতিক কারণে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্র। তাই দলীয় মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তবে শিক্ষার সুন্দর ভবিষ্যৎ সম্ভব।

উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করেন?

এস এম এ ফায়েজ:  প্রথমেই শিক্ষক নিয়োগে মেধাবীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ আগে যে শিক্ষকরা মেধার মূল্যায়নে নিয়োগ পেয়েছেন তারা দেশের বাইরে গেলেও মেধার স্বাক্ষর রাখছেন। আবার যে শিক্ষার্থীরা মেধাবী তারাও দেশের বাইরে গেলে বিশ্বের অন্য দেশগুলো থেকে বেশ  মূল্যায়ন পাচ্ছে। কিন্তু দেশে সেটা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আবার শিক্ষাঙ্গনে একাডেমিক পরিবেশটা যদি দেখি তাহলে কার কাছ থেকে কী আশা করবো! তাই সেই সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে; যাতে তার প্রতিভার বিকাশ করতে পারে।

আরেকটা বিষয় হলো গবেষণার মানের প্রতি মনোযোগ দেয়া। এটা খুবই ব্যয়বহুল একটা বিষয়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য অত্যাধুনিক গবেষণাগারের জন্য যে যন্ত্রগুলো দরকার সেগুলো রাখতে হবে। কারণ গবেষণার খুব ভালো পাবলিকেশন্স না থাকলে আন্তর্জাতিকভাবে টিকে থাকা কঠিন। এছাড়া পুরো বিশ্বে পরিচিতি গড়তে হলেও এই পাবলিকেশন্স দরকার। কিন্তু এটা আমরা সবসময়ই অবহেলা করেছি কিংবা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এর মূল কারণ যথেষ্ট অর্থের জোগান। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে আর্থিক জোগান দরকার। তা না হলে মানসম্মত গবেষণা থেকে পিছিয়ে থাকতে হবে। আশার কথা হলো, কিছু শিক্ষক এই কাজটি করে যাচ্ছেন। তবে তা সম্পূর্ণই ব্যক্তি উদ্যোগে। ফলে এটা খুবই সীমিত। রাজনীতিকদেরও এ বিষয়ে ভাবতে হবে যে শিক্ষার আলোর মধ্যে অন্য কোনো কিছু থাকবে না।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাসস্থান এবং পুষ্টির বিষয়টাও মনোযোগ দেয়া দরকার। কারণ মেধাবীদের লালন করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলগুলোতে যেভাবে শিক্ষার্থীরা থাকছে, যে ধরনের খাবার খাচ্ছে এর মানোন্নয়নও দরকার।

সমাজকে সুশিক্ষায় এগিয়ে নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের কীভাবে ভাবা উচিত?

এস এম এ ফায়েজ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে সমাজের সমস্যাগুলো দূর করা। কিন্তু সমাজের চেয়ে নিজের সমস্যা দূর করার মানসিকতা হয়ে গেছে এখন। অনেকেই নিজের জন্য কিছু করার জন্য বেশি ব্যস্ত হয়ে গেছে। ফলে বর্তমানের যে মেধাবী তরুণরা আছে তাদের বিকশিত না করতে পারার দায় আমাদের। আমরা যারা শিক্ষক, যারা প্রশাসনিক দায়িত্বে আছি তাদের। ফলে প্রতিভা থাকা সত্ত্বে মেধাবীরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বাক্ষর রাখতে পারছে না। একজন সাবেক উপাচার্য হয়ে আমি দেখবো যে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীটা শিক্ষক হয়ে এসেছে তাহলে তার প্রতি একধরনের প্রত্যাশা থাকবে; মেধাকে বঞ্চিত করে যে আসে তার ব্যাপারে আমার প্রত্যাশা সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। এই বিষয়ে মনোযোগী হওয়া দরকার। এমনিতেই আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। আর দেরি করার সুযোগ নেই। কারণ এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে কিংবা দেশের নাগরিক হয়ে গর্ব করার সুযোগটা আর থাকে না। তাই দেশের প্রয়োজনে এটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

দেশের সর্বস্তরের শিক্ষার মানোন্নয়নে আপনার পরামর্শটা কী থাকছে?

এস এম এ ফায়েজ: উচ্চশিক্ষা যদি ভালোভাবে পরিচালনা করা যায় তাহলে সর্বস্তরের শিক্ষার মানোন্নয়ন অনেকটাই সম্ভব। কারণ এখানকার শিক্ষার্থীরাই শিক্ষার সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু মেধা যাচাই করে প্রবেশ করার পথটা আমাদের তৈরি, তাই শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে কোনো সংশয় নেই কিন্তু সেই মেধাকে সুপথে পরিচালিত করা, যোগ্য নেতৃত্ব দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এখানে একজন উপাচার্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কারণ একজন উপাচার্য যদি মেধাকে মূল্যায়ন না করে প্রতিনিয়িত অন্যকিছুকে মূল্যায়ন করেন তাহলে এটা খুবই হতাশার। এভাবেই আমরা বছরের পর বছর পিছিয়ে পড়ছি। তাই এই হতাশাজনক অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসাটাও খুব কষ্টের। তবুও বের হয়ে আসতে হবে কারণ আর কোনো বিকল্প নেই।

আরেকটা বিষয় যতক্ষণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হচ্ছে ততক্ষণ যতই দলীয় নিয়োগ হোক না কেন অবশ্যই নিয়োগ হওয়ার পর আর কোনো প্রকারের দলীয় মনোভাব রাখা যাবে না। শিক্ষাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। তাহলেই সম্ভব। তবে আমার বিশ্বাস এখনকার তরুণ প্রজন্মই এ অবস্থান থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারবে। কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী উল্লেখযোগ্য কিছু যদি বলা যায় তা হলো কোটা আন্দোলন এবং ছাত্র আন্দোলন। এখনো তরুণদের মধ্যে যে প্রয়োজনের খাতিরে দেশকে নিয়ে ভাবতে হয় এবং তা তারা দেখিয়েছে। এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

(ঢাকাটাইমস/১৯ডিসেম্বর/ডিএম/জেবি)