পিয়াস মজিদের পড়ার টেবিল

প্রকাশ | ২১ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:৪৭

নাজমুল হাসান

ইদানীং, আমাদের দেশে গ্রন্থালোচনার অভাব নিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা চলছে। সাহিত্য পত্রিকাগুলোর মুখচেনা লেখকদের আবদার রক্ষা, কিংবা দৈনিকগুলোর ফরমায়েশি আলোচনা দায় মেটাচ্ছে বটে। কিন্তু, প্রকট হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার অভাব। পিয়াস মজিদের পড়ার টেবিল থেকের ভূমিকাতেও সে আক্ষেপের দেখা পাই। অথচ, বাংলা সাহিত্যে গ্রন্থালোচনার ঐতিহ্য বেশ পুরনো। স্মরণ করতে পারিÑ বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসুদেরÑ তাঁদের কোন কোন উত্তরপথিককেও। বুদ্ধদেবের কালের পুতুলের মতো অসামান্য গ্রন্থ; যা বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। কোথায় আজকাল সেসব বইয়ের দেখা! কালের অন্তরায়ে গতিতে ভাটা পড়েছে, এ কথা মানতেই হয়। আমরা রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোববার লাইব্রেরি খোলার কথা জানি; যেখানে পাঠের বিকেলগুলো মুড়ির মোয়া কিংবা সদ্য ধূমায়িত দার্জিলিং-টিয়ে; কখনোবা শালের হালকা ওমে বেশ মাখোমাখো। অবশ্য, আবেশটা ক্ষণস্থায়ী। সেকথা থাক। কিছুদিন আগে কথা প্রকাশ থেকে বেরিয়েছে গুণী প্রাবন্ধিক সনৎকুমার সাহার একটু আধটু পড়া; যাতে রয়েছে তাঁর বই পড়া ও বইয়ের জগতে অবগাহনের অভিজ্ঞতার বয়ান। সে বই পড়ে আমরাও ভারি চমৎকৃত হয়েছি। অন্তত, আবেশটা এখনো জারি আছে। ছায়াবীথি থেকে বেরুনো পিয়াস মজিদের পড়ার টেবিল থেকেও এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হয়ে থাকলো।

গ্রন্থালোচক হিসেবে পিয়াস মজিদ আমাদের অপরিচিত নন; তাঁর কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা তকমার সঙ্গে এটিও গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। অন্তত হালের পত্রিকাগুলোতে; দু-বাংলাতেই তার প্রমাণ রয়েছে। পড়ার টেবিল থেকে বইটিতে বিভিন্ন সময়ের ২২ টি লেখার জায়গা হয়েছে, লেখাগুলো বই নিয়ে। অবশ্য, পিয়াস মজিদ লেখাগুলোকে প্রবন্ধ বলতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন, ভূমিকায় তেমনটাই বলেছেন, বক্তব্যে জোরও আছে। লেখাগুলির অধিকাংশই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে কালি ও কলম, উত্তরাধিকারের মতো সাহিত্যপত্রিকা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রথম আলো, আনন্দবাজারের মতো দৈনিকও। প্রশ্ন জাগে, তবে এগুলিও কি নেহাতই ফরমায়েশি লেখা? কিন্তু, লেখক যখন জানানÑ ‘আমার গদ্যচর্চার একটা অংশজুড়ে আছে প্রিয় বইয়ের আলোচনা।’ তখন আমরা অন্তত আশা রাখতেই পারি; প্রিয় বই শুধুমাত্র আবদার রক্ষার, দায়ে পড়া কাজ হতে পারে না। সময়ের বদল লেখাগুলো প্রসঙ্গে বিশেষভাবে বিবেচ্য, যা সকল ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। সে কথাও পরিস্কার করেছেন পিয়াস মজিদÑ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বই থেকে শুরু করে ইমতিয়ার শামীমের গদ্যগ্রন্থও আমার আলোচনায় এসেছে। যার মধ্য দিয়ে একটা পরম্পরার সন্ধান মিলবে বলে আশা রাখি। বইয়ের একটি আলোচনা ২০০৭-এ রচিত আর দু একটি আলোচনা ২০১৭-র এর মধ্য দিয়েও আমার এক দশকের রচনা পরিক্রমার একটি রেখাচিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে হয়তো।’

এই পরিক্রমা খুঁজতে হলে বইয়ের গর্ভে নজর দেয়া দরকার। প্রথম লেখাটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাবাসের দিনলিপি কারাগারের রোজনামচা নিয়ে। কারাবাসকালে নেতাদের স্মৃতিকথা লেখার ইতিহাস বিশ্বে তো বটেই, ভারতবর্ষেও বেশ পরিচিত ঘটনা। তিহার কিংবা আহমেদাবাদের জেলে বসে পণ্ডিত নেহেরুর লেখা বইগুলি ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে; এমনকি মনোহরণ করেছে যোরোপবাসীরও। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে মাইলফলক হয়ে আছে। তারই ধারাবাহিকতাÑ কারাগারের রোজনামচা। পিয়াস মজিদ বইটিকে অভিহিত করেছেন কারাজীবনের মহাভাষ্য হিসেবেÑ সাথে নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে মিলিয়ে দেখেছেন এই মহান নেতার দিনলিপি। পরের লেখাটি আহমদ রফিকের মৃত্যুহীন বিপ্লবী চে গুয়েভারা নিয়ে। এখানে পিয়াস মজিদ মূলত নিয়োজিত, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে একপ্রকার নতুনত্ব খুঁজতেÑ ‘গৎবাঁধা জীবনী লেখেননি তিনি । বরং চে-র সূত্রে এই বইয়ে তিনি লাতিন আমেরিকার নানা দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চিত্রের রেখাঙ্কন করেছেন।’ এরপর তিনি বলেছেন একটি অনূদিত বই নিয়ে। অরূপরতন ঘোষ অনূদিত লুইস বুনুয়েলের আত্মজৈবনিক স্মৃতি শেষ দীর্ঘশ্বাস; এখানে আমরা বুনুয়েলের জীবন-স্মৃতি-পারিপার্শি¦কতা খুঁজে পাই। পড়ার টেবিল থেকের আরেকটি আয়োজন বিচারপতি হাবিবুর রহমানের রবীন্দ্রচর্চা নিয়ে। ‘শিক্ষা ও রবীন্দ্র ভাবনায় মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান’Ñ এখানে পিয়াস মজিদ কথা বলেন রবীন্দ্রনিমজ্জিত এই লেখকের দুটি বই নিয়ে। তবে, পরিসরের স্বল্পতা পাঠককে খানিকটা পীড়া দেয়। এরপর পিয়াস মজিদ হাজির হন অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া সম্পাদিত রোকেয়া: যুক্তিবাদ নবজাগরণ ও শিক্ষা সমাজতত্ত্ব নিয়ে। বইটি বিষয়ে বলতে গিয়ে বাঙালি মুসলমানের সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বেশ মূল্যবান বক্তব্য দিয়েছেনÑ ‘রোকেয়া-চর্চা বাঙালি সমাজে একটি অব্যাহত বিষয়। কারণ রোকেয়ার লড়াই যে মানবমুক্তির লক্ষ্যাভিসারী তা জাতিটির অনার্জিত।’ কথাটির সত্যতা অবশ্য স্বীকার করতে হয়।

বাংলার সাহিত্যিকদের নিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের চর্চা কিংবদন্তীপ্রতীম; এক্ষেত্রে একমাত্র তাঁর তুলনা চলতে পারে বুদ্ধদেব বসুর সাথে। পরের লেখায় আমরা তাঁকেই পাচ্ছি। পিয়াস মজিদ এখানে দুটি প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন মান্নান সৈয়দের নজরুল ও মানিকচর্চা নিয়ে। মান্নান সৈয়দের নিরলস গবেষকের প্রতিকৃতি উন্মোচন হয় তাঁর কলমে। ঠিক পরের লেখাটিতেই আমরা দেখছি সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর সন্ধান করতে। এখানকার উপজীব্য বুদ্ধদেবকন্যা দময়ন্তী বসু সিং সম্পাদিত বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য ‘কবিতা’ থেকে। এরপরের আলোচনা জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের শহীদ কাদরী: লেখা না-লেখার গল্প গ্রন্থটি নিয়ে। বন্ধু শহীদ কাদরীকে কেমন দেখেছেন জ্যোতিপ্রকাশ; পিয়াস মজিদ তার খুঁটিনাটি-চালচিত্র হাজির করেন পাঠকের সামনে।

পিয়াস মজিদের পড়ার টেবিল থেকেতে নানা সময়ের লেখার সমাহারের কথা আগেই জানিয়েছি; সাথে বিষয়ের বৈচিত্র্যও গুরুত্ব দিয়ে দেখার মতো। ‘সামাজিক আন্দোলনের অনন্য ইতিহাস’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন মুনতাসীর মামুনের উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্ম আন্দোলন বইটি নিয়ে। ব্রাহ্ম আন্দোলনের যে কলকাতাকেন্দ্রিক ছবি আমরা জানি, তার খানিকটা মুছতে বইটির গুরুত্ব রয়েছে বৈকি। সেদিক বিবেচনায় পিয়াস মজিদের আলোচনাটিও গুরুত্বের দাবিদার। লেখাটিতে গ্রন্থের পূর্বাপর বিশ্লেষণের পাশাপাশি ঐতিহাসিক হিসেবে মুনতাসীর মামুনের নিষ্ঠতার পরিচয়ও পুনরায় ব্যাক্ত করেছেন তিনি। অন্তে এসে তাঁর মন্তব্যÑ ‘মুনতাসীর মামুনের উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্ম আন্দোলন গ্রন্থটি শুধু বাংলার নয়, একই সঙ্গে উপমহাদেশের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এক প্রামাণ্য দলিল হয়ে রইল।’ ব্যক্তির পরিচয়ের সংকট একটি জটিলতর বিষয়। মজার কথা হলোÑ সন্জীদা খাতুনের (পরিচয়ের যাঁর অন্ত নেই) পরিচয় দিতে গিয়ে সেটিই ঘনীভূত হয়েছে; কোন পরিচয় তাঁর দেয়া যায়! একদিকে তিনি যেমন প্রবাদতুল্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, তেমনি আবার গবেষক হিসেবেও অতুল্য। পারিবারিক কৌলীণ্যেও বা কম কিসে! তাঁর স্মৃতিপটে গুণীজন গ্রন্থটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পিয়াস মজিদকেও খানিকটা ধন্দে পরতে হয়, বেদনা নিয়েই বলেনÑ সন্জীদা খাতুনের সাংস্কৃতিক ইমেজ তাঁর ‘প্রাবন্ধিক-গবেষকসত্তাকে প্রায়শই আড়াল করে রাখে।’ লেখাটি পাঠে নানা গুণীজনের এত খবর যে মোটামুটি আমাদেরও একটা জার্নি হয়ে যায়; এক স্বর্ণযুগের নস্ট্যালজিয়ায়।

মানুষ হিসেবে সনৎকুমার সাহা সম্পর্কে আমাদের জানা কথাÑ তিনি দেবতুল্য। লেখক-সত্তা হলেও, এমন মানুষকে মূল্যায়ন করা স্বভাবতই কঠিন। তবে, সনৎবাবুর লেখার বিষয় পেড়িয়ে কলাপ্রকৌশল নিয়ে পিয়াস মজিদের মন্তব্যে লেখক হিসেবেও তাঁর মহত্বের খানিক আঁচ পেতে পারিÑ ‘সনৎকুমার সাহা গদ্য অঙ্কণ করেন; অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে ছবি লিখতেন।’ বেশ পরিণত লেখা এটি, শব্দচয়ন যেন পুষ্পযাপনের আমেজ আনে। ‘মফিদুল হকের প্রবন্ধে শিল্পের সারসত্তা’ লেখাটি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিদুল হকের আশেক লেনের গৃহ ও অন্যান্য শিরোনামের প্রবন্ধপুস্তক নিয়ে। এখানে পিয়াস মজিদ মূলত মফিদুল হকের প্রাবন্ধিক সত্তার মূল্যায়নের প্রয়াস দেখিয়েছেন। পশ্চিমবাংলার বুদ্ধিজীবী হিসেবে ইমানুল হক দু-বাংলাাতেই বেশ খ্যাত। তাঁর অপ্রথাগত চিন্তাচেতনা, মাঠের-পথের লড়াকু ভূমিকা সর্বদাই আমাদের আলোড়িত করে। তাঁর কথাসাহিত্যের ফাঁপা দুনিয়া বইটিও স্থান পেয়েছে পিয়াস মজিদের পড়ার টেবিলে। একজন আধুনিক বাঙালি চিন্তক হিসেবে ইমানুল হকের ভাবনা মুগ্ধ করেছে পিয়াস মজিদকেওÑ ‘বাংলা সাহিত্যকে বৈশ্বিক প্রেক্ষিতেও পর্যালোচনায় ব্রতী ইমানুল। তাই বিভূতিভূষণের অন্বয় কিংবা দূরত্ব সন্ধান করেন রমা রঁল্যা আর আলবেয়ার কাম্যুর সঙ্গে।’

কয়েকটি লেখার কথা আলাদা করে বলতে হবে। পিয়াস মজিদের মেধা-পরিশ্রমের ছাপ এগুলোতে বিশেষভাবে স্পষ্ট। প্রথমেই বাংলা একাডেমি প্রকাশিত, শাহিদা খাতুন ও ফিরোজ মাহমুদ সম্পাদিত ফোকলোর নিউ চ্যলেঞ্জেস বইটি নিয়ে লেখার প্রসঙ্গ। বইটি কেন বৈশ্বিক মান পাবার যোগ্য পিয়াস মজিদ তার আদ্যাপান্ত নিখুঁত আলোচনা করেছেন এখানে। আবুল হাসনাত সম্পাদিত নভেরা আহমেদ কিংবা কবি জয় গোস্বামীর গোঁসাইবাগান সিরিজ নিয়েও কথাগুলো পূর্ণ খাটে। সবশেষে রয়েছে ইমতিয়ার শামীমের ত্রয়ী ননফিকশন যুদ্ধে উপেক্ষিতা নীল নীল অপরাজিতা, মূলত মানুষ, মূলত মানস, শান্ত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সন্ত্রাস নিয়ে পাঠঋদ্ধ আলোচনা। কালের ভিন্নতা রয়েছেÑ ফলে পড়ার টেবিলে থেকেতে পিয়াস মজিদের যে গদ্যেলৈীর দেখা পাই, তা পাঠের গতি একরৈখিক করে না; মাঝে মাঝে বাঁক বদল করায়। এতে, পাঠের একটি আলাদা স্বাদ জোটে। তবে, কখনো কখনো বলার স্বল্পতা, প্রকাশের স্বল্পতা হয়ে দেগে দিয়ে যায়। সে দোষ নেহাতই লঘু। সব দিক নিয়ে বইটি মননশীল পাঠকদের আগ্রহ জাগাবেÑ এটিই প্রত্যাশা।