‘পৃথিবীর প্রথম অ্যান্টিজ্যামার জিপিএস সিকিউরিটি লক তৈরি করেছে ট্যাসলক’

আলাউদ্দিন আল আজাদ আলিফ
| আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:৫৬ | প্রকাশিত : ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:৫৩

মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, বাস, ট্রাকসহ সকল মোটরযানের জন্য সিকিউরিটি লক তৈরি করে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ট্যাসলক। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রাদবি রেজা ঢাকা টাইমসকে জানিয়েছেন এই ডিভাইস উদ্ভাবন এবং এটা কীভাবে বাহনকে সুরক্ষা দেয় সে সম্পর্কে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ আলিফ। সঙ্গে ছিলেন আসাদুজ্জামান

দুই চাকার বাহন মোটরসাইকেল কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি চুরি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। তাই মোটরযানের নিরাপত্তা নিয়ে আপনার প্রতিষ্ঠান ট্যাসলক দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। আপনি দাবি করছেন পৃথিবীর অন্যান্য যেসব সিকিউরিটি লক আছে তার চেয়ে এটি বেশি নিরাপত্তা দিতে সক্ষম। বাহনের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করার আগ্রহের শুরুটা জানতে চাই।

রাদবি রেজা: আমরা মোটরসাইকেলের পাশাপাশি মোটরগাড়ি যেমন বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকারের নিরাপত্তা নিয়েও কাজ করি। এমনকি জাহাজের সিকিউরিটি নিয়েও কাজ করে থাকি। আমাদের শুরুটা ছিল মোটরসাইকেল দিয়েই। ২০১৪-১৫ সালের দিকে আমরা শুরু করি। এর পেছনে একটা ঘটনা আছে। আমার এক বন্ধুর একটি মোটরসাইকেল চুরি হয়। চুরি হওয়ার পর সে আমার কাছে এসে বলল ঘটনা। তখন সে আমায় অনুরোধ করল বাইকের সিকিউরিটির লক নিয়ে কাজ করতে। এদিকে আমরা চুরি যাওয়া মোটরসাইকেল উদ্ধারে বিভিন্ন থানায় খোঁজ করলাম। জিডি করলাম। কিন্তু চুরি হওয়া বাইকটা উদ্ধার করা গেল না। যখন আমরা থানায় জিডি করতে গেলাম, তখন দেখলাম বাইক চুরি সংক্রান্ত শত শত জিডি করা হচ্ছে। এসব জিডি করা হচ্ছে বাইক, গাড়ি চুরি ও ছিনতাই নিয়ে। তখন আমার মাথায় চিন্তা আসল এমন কিছু করা যায় কি না, যাতে এসব বাহনের সেফটি নিশ্চিত করা যায়। তখন থেকেই আমাদের কার্যক্রম শুরু।

আমি খুব অল্প পুঁজি দিয়ে শুরু করেছি। ছয় বছর আগে আমার শুরুটা ছিল ২০ হাজার টাকা দিয়ে। সেই বিনিয়োগটা ছিল আমার এক বন্ধুর। তার নাম বিমল বর্মণ। তার টাকা দিয়েই আমরা শুরু করি। তখনই ট্যাসলকের যাত্রা শুরু হয়।

আপনি সিকিউরিটি ডিভাইস নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করলেন। আমাদের জানা মতে আপনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। শুধু নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আপনি এই ডিভাইস উদ্ভাবন করলেন। আপনি প্রথম যে ডিভাইসটি বানিয়েছিলেন নিরাপত্তার জন্য সেটা কতটা কার্যকর ছিল।

রাদবি রেজা: প্রথমে আমরা যে ডিভাইসটি তৈরি করি, সেটা ছিল ম্যাগনেটিক সেন্সর। আমরা লোকাল মার্কেট থেকে সিকিউরিটি ডিভাইস কিনে নিয়ে আসতাম। ধরলে অ্যালার্ম বাজে বাইকে এমনটা। এরপর সেই ডিভাইস আমাদের ল্যাবে এনে খুলতাম। মডিফাই করতাম। সার্কিটটা আপডেট করতাম। সেটার কোডিংগুলো চেঞ্জ করতাম। এরপর ওই ডিভাইসের সঙ্গে আমরা অ্যাডঅন নিয়ে এসেছি ম্যাগনেটিক সেন্সর। যেটা হচ্ছে যদি কোনো মানুষ ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে, সে যদি বাইক থেকে নেমে দৌড় দেয় তবে বাইক অটোমেটিক লক হয়ে যাবে। আমাদের সম্পূর্ণ সিস্টেম ছিল অটোমেটিক। সেটা ছয় বছর আগের ডিভাইস। আমি ছিলাম টেকনো ফ্রিক। টেকনোলজির প্রতি আমার ছোটবেলা থেকেই আকর্ষণ। ছাত্রজীবনে আমি প্রথম সায়েন্সের স্টুডেন্ট ছিলাম, এরপর কমার্সে পড়েছি। শেষে আবার সায়েন্সে। আমি ইংল্যান্ডে গিয়ে আইসিটিতে অনার্স করেছি। ইংল্যান্ড থেকে আসার পরেই আমার কাজ শুরু হয়। ইংল্যান্ডে গিয়ে আমি ওদের টেকনোলজি দেখেছি। তখন আমার মনে হতো আমরা ওদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। কিন্তু কেন আমরা পেছনে আছি? সেই চিন্তা থেকেই মোটরযানের নিরাপত্তা দিতে কাজ শুরু।

আমাদের কাজ হচ্ছে এক্সিটিং ডিভাইসকে আপডেট করা। ইনোভেট করা। নতুন কোনো কিছু ইনোভেট করা। আমাদের প্রডাক্টের আপডেট করতে করতে ২০২০ এসে পৌঁছেছি। আমরা চ্যালেঞ্জ করতে পারি পৃথিবীতে আমাদের মতো সাশ্রয়ী দামে আর কোনো প্রডাক্ট নেই। এমন সিকিউরিটি কারো কাছেই নেই। এটা আমাদের ওপেন চ্যালেঞ্জ। আপনি ইন্টারনেটে গুগল করে দেখতে পারেন। আপনি অ্যামাজন বলেন, ই-বে বলেন, কিংবা তাও বাও। আপনি পৃথিবীর নামিদামি ই-কমার্স সাইটেও আমাদের মতো প্রডাক্ট পাবেন না। যদিও পান তবে দেখবেন ওসব প্রডাক্টের সঙ্গে আমাদের প্রডাক্টের অনেক পার্থক্য। আমাদের ফিচার দেখবেন আর ওদের ফিচার দেখবেন।

মোটরসাইকেলের সিকিউরিটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্টিল মেটের সঙ্গে যদি ট্যাসলকের তুলনা করতে বলা হয় তবে আপনি ট্যাসলক নিয়ে কী বলবেন?

রাদবি রেজা: আমি চীনে গিয়ে স্টিল মেটের ফ্যাক্টরি ভিজিট করেছি। ওদের ফ্যাক্টরি চীনের জংশংয়ে। গুয়ান জু থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। আমি ওদের কোয়ালিটি চাক্ষুষ করেছি। স্টিল মেট যথেষ্ট ভালো কোম্পানি। এছাড়াও স্কোরপিও, স্পাই এমন অনেক কোম্পানি আছে বিশ্বে। বিশ্বে তারাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে। পৃথিবীতে বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ। তার মধ্যে ট্যাসলক আরো ছোট প্রতিষ্ঠান। ওদের সঙ্গে তুলনা করলে আমি বলবো ওদের চেয়ে কোনো অংশেই আমরা কম না। তাদের চেয়ে অনেক অ্যাডভান্সড আমাদের সিকিউরিটি। আমরা সবসময় ফোকাস করি কাস্টমারের ডিমান্ড অনুযায়ী। কাস্টমার কী চায় সেটা আমরা দেখি। আমরা কী চাই সেটা কখনোই দেখি না। আমাদের গ্রাহকরা কী চাচ্ছেন সেটার ওপর ফোকাস করেই আমরা ডিভাইস তৈরি করি।

বাংলাদেশে যতগুলো জনপ্রিয় সিকিউরিটি লক রয়েছেÑমোটরসাইকেলের নিরাপত্তার জন্য বিশ্বস্ত সিকিউরিটি সিস্টেমের মধ্যে ট্যাসলক অন্যতম। আমরা জানি ট্যাসলকের গ্রাহক বাড়ছেই। মানুষ আপনার প্রতি বিশ্বাসের কারণেই ট্যাসলক ব্যবহার করে থাকে। আমরা যদি ইন্টারনেটে এর রিভিউ দেখি তবে দেখব এর পজেটিভ ও নেগেটিভ উভয় ধরনেরই রিভিউ রয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন লকডাউনের শেষে মানুষ ঘর থেকে বের হতে শুরু করেছে। এখন যানবাহনের নিরাপত্তাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নতুন কী কী ডিভাইস আপনাদের রয়েছে?

রাদবি রেজা: গত ছয় বছরে আমরা অনেক ধরনের ইনোভেশন নিয়ে কাজ করেছি। আমাদের একটা ফোকাস থাকে। বিদেশিরা কী করছে তার ওপর আমরা ফোকাস করি না। আমরা কাউকে ফলো করি না। আমরা কাস্টমারদের ফলো করি। আমরা দেখি হ্যাকিংয়ের দিকের দুর্বলতাগুলো। চোর কী কী উপায়ে মোটরসাইকেল চুরি করতে পারে সেসব বিষয়ে মনোযোগ দেই। ওসব বিষয় মাথায় রেখে আমরা প্রডাক্ট নিয়ে আসি।

আমরা শিগগিরই ট্যাসলক ডিফেন্ডার নামে নতুন একটি ডিভাইস আনছি। এজন্য আমরা একটা মোল্ড ডিজাইন করেছি। যেটা আমাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব ডিজাইন। নতুন এই ডিভাইসের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-মোটরসাইকেল কিংবা গাড়ি আপনাকে লক করতে হবে না। আপনি লক করেন বা না করেন অটোমেটিক গাড়ি লক হয়ে যাবে। আপনি যখন গাড়ি বা বাইকের কাছে আসবেন তখন অটোমেটিক আনলক হয়ে যাবে। এমনকি আপনি যখন দূরে যাবেন অটো লক হয়ে যাবে।

নতুন এই সিকিউরিটি ডিভাইসে ২৬-২৭টি ফিচার থাকছে। এর রিমোর্টে ডিসপ্লে থাকবে। এই ডিসপ্লেতে নানা তথ্য প্রদর্শিত হবে। বাইকের ব্যাটারির অবস্থা, চাকার হাওয়ার পরিমাণÑ এমন অনেক কিছুই দেখা যাবে এই ডিসপ্লেতে। এই ধরনের সিকিউরিটি ডিভাইস আমি পৃথিবীতে এখনো দেখিনি। আমরা এটা নিয়ে অনেক ধরনের গবেষণা করে দেখেছি। এটা হবে প্যাসিভ কি লেস এন্ট্রি। সঙ্গে থাকবে বিল্টইন ইমোবোলাইজার।

দ্বিতীয় আরেকটি প্রডাক্ট নিয়ে আমরা কাজ করছি। সেটা হচ্ছে জিপিএস ট্রাকার। এটা আমাদের নিজস্ব মোল্ডে ডিজাইন করা। এর যন্ত্রাংশ হংকং থেকে আসে। এরপর চায়নাতে অ্যাসেম্বল হয়। রেডি হওয়ার পর বাংলাদেশে আসে।

এর মধ্যে স্পেশাল কিছু ফিচার আছে। আমরা সাধারণত জিপিএস ট্রাকার দিয়ে গাড়ি বা বাইক ট্রাক করি। যেমন এটা বাহনে ইনস্টল করা থাকলে গাড়ি লক করতে হবে না। এটা দিয়ে লাইভ ট্রাক তো হবেই। এটার সাহায্যে আপনি গুগল থেকে আপনার বাহনের লাইভ ভিডিও দেখতে পারবেন। গাড়ি কোথায় যাচ্ছে সেই রাস্তার ছবি দেখতে পারবেন। আরো আছে জি ফেঞ্চ, অ্যালার্ট, অটোমোটিক আর্মিসহ অনেক ফিচার। পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকেই মোবাইলের মাধ্যমে আপনার গাড়ি লক করতে পারবেন। আমরা এই ডিভাইস আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই বাজারে নিয়ে আসব। এটা হবে পৃথিবীর প্রথম অ্যান্টিজ্যামার জিপিএস ট্রাকার।

গাড়ির ইঞ্জিন লক হয়ে যাবে। যদি নেটওয়ার্ক নাও থাকে। সাধারণত জিপিএস নেটওয়ার্কে সিমকার্ড থাকে। সেই সিমকার্ডে নেটওয়ার্ক না পেলেও গাড়ি বা বাইক লক হয়ে যাবে। এই ডিভাইসের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, আমরাই বাংলাদেশের একমাত্র কোম্পানি যারা জিপিএস ট্রেকিংয়ের জন্য মাসে মাসে বিল নেই না। সবাই জিপিএস ট্রাকারের জন্য মাসে মাসে বিল নিচ্ছে। আমি আগেও বলছি, এখনো বলি আমরা সবসময় কাস্টমারকে ফোকাস করি। আমাদের প্রফিট না হোক আপত্তি নেই। কাস্টমারের প্রফিট হোক সেটাই আমরা চাই।

ট্যাসলক ডটকমে গেলে আপনি আমাদের নিত্যনতুন ডিভাইসের ফিচার সম্পর্কে জানতে পারবেন। নতুন জিপিএস ট্রাকারের মধ্যে বিল্টইন ব্যাটারি আছে।

আমরা সাধারণত জানি জিপিএস ট্রাকার বাইক বা গাড়ির ব্যাটারি ডাউন করে দেয়। পৃথিবীর সব জিপিএস ট্রাকারের একই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমাদেরটা পৃথিবীর প্রথম জিপিএস ট্রাকার যেটা জিরো পার্সেন্ট ব্যাটারি ব্যবহার করবে গাড়ির।

প্রশ্ন জাগতে পারে। কাজটা আমরা কীভাবে করলাম? আমাদের জিপিএস ট্রাকারে আমরা একটা নতুন ধরনের সার্কিট ব্যবহার করেছি। যদি কেউ গাড়ি বা বাইক টাচ না করে তবে এই ট্রাকার অ্যাকটিভ হবে না। যতক্ষণ গাড়ি কেউ ধরবে না ততক্ষণ স্লিপিং মোডে থাকবে। কেউ গাড়ি চুরি করতে চাইলে ট্রাকারটি গাড়ির মালিককে ফোন দেবে। গাড়ির মালিকের ফোন যদি বন্ধ থাকে তবে তার দ্বিতীয় ফোনে কল যাবে। কিংবা গাড়ির মালিকের বাবা-মা কিংবা স্ত্রীর কাছে ফোন যাবে। পাঁচটি নম্বরে সে কল দেবে।

যদি মোটরগাড়ি এমন জায়গায় রাখা থাকে যেখানে নেটওয়ার্ক নেই। তাহলে এই ট্রাকার কীভাবে কাজ করবে?

রাদবি রেজা: সেক্ষেত্রে আমাদের গাড়ি লক করা যাবে। যেটাকে আমরা কম্বো বা নেক্সা বলি। আমাদের জিপিএস ট্যাকারে অ্যালার্ম আছে, রিমোর্ট, অটোমেটিক ইমোবোলাইজার আছে।

আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই।

রাদবি রেজা: আন্তর্জাতিক মানের মোটরযানের সিকিউরিটি দিয়ে আমরা দেশকে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করতে চাই। এজন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। আমাদের বিশ্বাস পৃষ্ঠপোষকতা পেলে যানবাহনের পাশাপাশি ঘরবাড়ি, কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেও আমরা সিকিউরিটি ডিভাইস সরবরাহ করতে পারব।

সময় দেওয়ায় জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

রাদবি রেজা: ঢাকা টাইমস এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।

(ঢাকাটাইমস/৩০ডিসেম্বর/এজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :