মহামারীর বছরে সমাজ ও নৈতিকতা

জিনান বিনতে জামান
 | প্রকাশিত : ০৩ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:৫৯

মানুষ প্রকৃৃতির এমন এক সৃষ্টি যা অন্য সকল সৃষ্টির চেয়ে স্বতন্ত্র। মানুষকে এ স্বাতন্ত্র্যের সীমারেখা দিয়ে আলাদা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করেছে যে গুনটি, তা হলো- বুদ্ধি। আর এ বুদ্ধির উপজাত হিসেবে মানুষ বিবেক তথা বিবেচনা বোধের অধিকারী হয়েছে। বুদ্ধি নি:সৃত বিবেচনা বোধের কারনেই মানুষ নিজেকে আবদ্ধ করে কিছু নৈতিক নিয়মের আবর্তে। এ কারনেই মানুষ শুধু বুদ্ধিমান প্রাণীই নয়, বরং নৈতিক প্রাণীও বটে। ধর্মমতেও মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীবের সম্মান দেওয়া হয়েছে। এ সম্মান শুধু মানুষকে মহিমান্বিত করে তাই নয়, বরং তাকে এক কর্তব্য বোধেও আবদ্ধ করে। যেহেতু মানুষের বুদ্ধি ও নৈতিক জ্ঞান আছে তাই অন্য মানুষ এমনকি অন্যান্য সকল সৃষ্টির প্রতি মানুষের দায়িত্ব পালনের বাধ্যতা রয়েছে।

তবে মানবিক বা নৈতিক দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয়তা সবসময় থাকলেও বিশেষ বিশেষ সংকট মুহূর্তে এ প্রয়োজনীয়তা অনেক প্রকট হয়ে ওঠে। ২০২০ সালে উদ্ভবকৃত বিশ্ব মহামারী পরিস্থিতি নি:সন্দেহে এমনই এক ভয়াবহ সংকট কাল। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। কোন ব্যক্তি সৎ, এ কথা তখনই বলা যায় যদি অসৎ হওয়ার সমস্ত অনুকূলতা থাকার পরেও সে অসৎ পন্থা অবলম্বন না করে। তেমনি করোনা মহামারীর এ সময়ে যখন ব্যক্তির নিজের সুরক্ষাই প্রধান জরুরী বিষয়, তখনই মানবিক নৈতিকতা নিরূপনের উত্তম সময়। কারণ, এ সময়ই একজন নৈতিক চেতনায় সিক্ত মানুষ নিজের পাশাপাশি অন্যদের প্রতি তার নৈতিক দায়িত্ব পালনে যথার্থ আচরন প্রদর্শন করতে পারে।

মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা বোধ থেকেই সে অপরাপর সৃষ্টির সাথে একাত্মবন্ধন অনুভব করতে সক্ষম। তাই অন্যান্য প্রাণী যেখানে শুধু খাদ্য বা নিরাপত্তার প্রয়াজনে যূথবদ্ধ হয়, মানুষ সেখানে জৈবিক চাহিদার পাশাপাশি নৈতিক প্রয়োজনেও একীভূত হয়ে গড়ে তোলে সমাজ। এজন্য মানুষকে সামাজিক জীবের মর্যাদা দিয়ে মহাজ্ঞানী এরিস্টটল বলেন, “মানুষ মাত্রই সামাজিক জীব, যে সমাজে বাস করেনা, সে হয় পশু নয়তো দেবতা।”

সমাজের রাজনৈতিক রূপ রাষ্ট্রকেও অনেক দার্শনিক-চিন্তাবিদ নৈতিক প্রতিষ্ঠান রূপে প্রমানের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে আধুনিক কালের প্রভাবশালী দার্শনিক হেগেলের কথা বলা যায়। মোট কথা মানুষ হিসেবে নিজ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও তা উপলব্ধির জন্য সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ে উঠে। তাহলে স্বভাবতই সমাজের স্বার্থরক্ষায় মানুষের নৈতিক আচরন চর্চার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তবে নৈতিকতার ভিত্তি ভূমি মানুষ নিজেই, সমাজ এর প্রয়োগ ক্ষেত্র মাত্র। একটু ভিন্নভাবে বলা চলে নৈতিকতা ব্যক্তিগত আর সামষ্টিক উভয়ই হয়ে থাকে। তবে ব্যক্তিগত নৈতিকতাই সামাজিক নৈতিকতাকে প্রভাবিত করে। অনুরূপভাবে, পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতিও মানুষের ব্যক্তিগত নৈতিকতা নির্ধারণে অনেক সময় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে।

বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ নামে এক নতুন ভাইরাসের আক্রমনে সমগ্র মানব জাতি আতঙ্কিত জীবনযাপন করছে। ২০১৯ সালের শেষ ভাগে চীনের উহানে এ ভাইরাসের প্রথম সন্ধান পাওয়া গেলেও এর প্রলয়ংকরী রূপ সারা বিশ্ব ছড়িয়ে পড়ে ২০২০ এর শুরুর দিকেই, যার পরিনতিতে ২০২০ এর মার্চ মাস থেকেই সারা বিশ্বের প্রায় সব দেশে একযোগে “লকডাউন” আরম্ভ হয়। স্বাস্থ্যবিধিতে যোগ হয় নতুন নতুন নানান নিয়ম। কখনো আবার পুরাতন স্বাস্থ্যবিধিগুলোই নতুন আঙ্গিকে মেনে চলার বাধ্যতা দেখা দেয়।

এ সময় দেশে দেশে আন্তঃসম্পর্কেও আসে বিধি নিষেধ। আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় সাময়িকভাবে। এমনকি ভয়াবহ এ মহামারী কাছের প্রতিবেশী থেকে শুরু করে একান্ত আপনজনের সাথেও দৈহিক দূরত্বে বাধ্য করে আমাদের। মারাত্মক ছোঁয়াচে এ রোগের কারণে আমরা যেন আমাদের সম্পর্কগুলোকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শিখেছি। নৈতিকতার নিরিখে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে ভাবার অবকাশও যেন কোভিড-১৯ এর কারণেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানবিকতার কাছে মহামারী পরাস্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গের শুরুতেই চিকিৎসকদের কথা বলতে হয়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রারম্ভিক নৈতিক শপথ বা “হিপোক্রটিক ওথ” অনুসারে একজন রোগীর গোপনীয়তা সংরক্ষণ একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব হলেও মহামারীর এ সময় আক্রান্ত্র রোগীর তথ্য গোপনের পাশাপাশি সকলের এবং নিজেদের সুরক্ষার বিষয়টি অতি দুরূহ হলেও চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ বিষয়ে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। কোন কোন সময় সুরক্ষা সামগ্রীর অপ্রতুলতা জেনেও চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মহামারী মোকাবেলায় আত্মনিয়োগ করেন। সত্যি বলতে মানবিক নৈতিকতার কাছে এখানে পরাভূত হয়েছে ব্যক্তি স্বার্থ।

অন্যান্য পেশাজীবিদের ক্ষেত্রেও মানবিক নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা গেছে। যেমন: শিক্ষক, প্রশাসক, ব্যবসায়ী, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে প্রায় সকলেই মানুষের প্রয়োজনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে এসেছে। তবে সব গল্পই যে ইতিবাচক, তা কিন্তু নয়। নীতিহীন মানুষের পদভারে এ মহামারীকালেও মানবতা ব্যহত হয়েছে। যেমন- শুরুর দিকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা মাস্ক, স্যানিটাইজার ও হ্যান্ড ওয়াশের মতো সহজলভ্য সামগ্রীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অন্যায়ভাবে মুনাফা লাভের পায়তারা করে। কিছু অসাধু হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও ভুয়া করোনা রিপোর্ট দিয়ে শুধু ব্যবসায়িক ফায়দা আদায়ের চেষ্টা করে। আমাদের হাজারও নৈতিক আর মানবিক গল্প চাপা পড়ে যায় এমন কতিপয় নীতিহীনতার গল্পের ভিড়ে।

তাই, সার্বিকভাবে মহামারীকাল এ ২০২০ সাল নৈতিকচর্চা ও উত্তরণের নতুন সময় হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে আগামী বছরটি আরও জরুরী ও জটিল একটি সময় শুরু হতে চলেছে। কেননা, ইতিমধ্যে মহামারী করোনার কিছু প্রতিষেধক আবিস্কার হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান আছে। এ সব প্রতিষেধক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কাদের, কি ভিত্তিতে দেওয়া হবে, তার অগ্রাধিকার কেমন হবে সে সম্পর্কে আরো বেশি নৈতিক চিন্তার অবকাশ রয়েছে। সেই সাথে মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ধনী-দরিদ্র বৈষম্যের অবস্থা নির্ধারনেও নৈতিকতার নীতি প্রয়োগের আবশ্যকতা দেখা যেতে পারে। প্রকৃতঅর্থে, নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা কোন কালিক সীমানায় আবদ্ধ নয়, বরং এর পরিধি মানবের সহজাত। তাই মহামারী কাল কেটে গেলেও অক্ষুন্ন থাক সামাজিক নৈতিকতার মূল ভিত্তি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা কলেজ। ইমেইল: [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :