জেসনরা কি রত্ন খুঁজে পেল?

প্রকাশ | ০৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:৪৮ | আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:০৮

দেলোয়ার হোসেন, টরন্টো, কানাডা

‘তোমার কাছে কি খুচরা ডলার হবে?  আমাকে কিছু কয়েন দিবে?’ স্টোর থেকে পা বাড়িয়ে আবার থমকে দাঁড়ালাম। পুরো সুস্থ সবল যুবকটির ভিক্ষাবৃত্তি আমার মনটাই খারাপ করে দিল নিমিষে। বললাম, ‘হ্যাঁ, আমার কাছে কিছু কয়েন আছে বটে কিন্তু তোমাকে দেওয়ার মতো নয়।’

মার্ক জেসন। টরন্টোর সিটির হোমলেস পরিবারের নতুন সদস্য। ৩০ বছর বয়সী এ কানাডিয়ান সবে গত মাসে স্বেচ্ছায় হোমলেস জীবন বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজের জীবন ধ্বংসের সিদ্ধান্তটা নিয়ে বরং সে রোমাঞ্চিত ও পুলকিত!  এ পথের সন্ধানেই নাকি ব্যাকুল ছিল তার দেহ মন!

জেসন জানালো, এখনও তার মা বাবা জীবিত। এক সময় সে ভালো চাকরী করত। ছিল ভালো রোজগার, গাড়ি, গার্লফ্রেন্ড। কিন্তু এ সব নাকি তাকে শান্তি দিতে পারেনি। অবশেষে সে খুঁজে পেয়েছে আসল পথ। সব বিসর্জন দিয়ে টরন্টোর রাজপথে নেমে পেড়েছে। এবং নেমে পড়েছে চিরদিনের জন্য। মানুষের দেওয়া খাবার, রাতে সাবওয়ে স্টেশনে ঘুমানো, সারাদিন যেদিকে মন চায় ঘোরা। জানালো- এখনকার এ জীবনটা তার কাছ জাস্ট ওসাম। আগের ছকে বাঁধা জীবনটা নাকি কিছুই দিতে পারেনি!

আহ, কি তরতাজা যুবক। এই সর্বনাশী বিকৃতি চিন্তা তার মাথায় কে ঢুকিয়ে দিল? বিস্ময়ে আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম । এবং ক্রমেই আমার দৃষ্টি নিচের দিকে নেমে এলো।

টরন্টোতে সিটিতে ১০ হাজারের বেশি হোমলেস রয়েছেন যাদের অনেকেই মার্কের মতো স্বেচ্ছায় এ জীবন বেঁছে নিয়েছেন। কেউ হোমলেস হয়েছেন চাকরী হারিয়ে, কেউ দেনায় ডুবে, কেউবা নেশার কবলে পড়ে, আবার কেউ হয়েছেন সুস্থ চিন্তা শক্তি হারিয়ে। হোমলেসের রাস্তায় আসার ধরন একেক জনের একেক রকম। কিন্তু এখানে আসার পর সবার জীবনই প্রায় রকম। এবং সেটা কষ্ট, কষ্ট আর কষ্ট।

কানাডার মতো অতি শীতপ্রধান দেশে হোমলেস হওয়াটা আরও বেশি কঠিন। বছরের আট মাসই এখানে প্রচণ্ড শীত। বরফ তো নিত্য দিনের ঘটনা। তাপমাত্রা চলে যায় হিমাঙ্কের অনেক নিচে । ঘরে হিটার ছাড়া যেখানে চিন্তাই করা যায় না, সেখানে মাসের পর মাস বাইরে কাটানো এক কথায় ভয়াবহ। কষ্টের রাত কতটা দীর্ঘ তা কেবল জেগে থাকা ওই মানুষগুলোই ভালো করে জানেন।

টরন্টো সিটি আবার অন্য আট দশটি মেগাসিটির মতো নয়। পুরো সিটিতে একটিও পাবালিক টয়লেট খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনটি বেশিরভাগ সাবওয়ে স্টেশনেও টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। বাসে, রাস্তায়, ট্রেনে চলাফেরা মানুষের কথাই বাদই দিলাম। কিন্তু হাজার হাজার এ হোমলেস লোকগুলোর নিয়তই বিপদ। কোথায় গিয়ে তারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবে?  আর গোসল? ২০ বছর আগে ঘর ছাড়া একজন হোমলেসের এ দীর্ঘ সময়ে হয়তো একবারও গোসল করার সুযোগ হয়নি।

দুনিয়ার নানা প্রান্তে দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে কানাডা। একটি উদার, জনক্যালণমূক রাষ্ট্র হিসেবে কানাডার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে দুনিয়া জুড়ে। অথচ সেই দেশেরই হাজার হাজার মানুষকে কিনা দুবেলা আহারের জন্য হাত পাততে হয় অন্যের কাছে! রাতের খাবার খুঁজতে হয় ডাস্টবিনে। অথবা পেট ভরতে হয় স্টোরের ফেলা দেওয়া মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার খেয়ে!

কিন্তু এই হতভাগ্য মানুষগুলোর জন্য কোরো তেমন কোনো সহানুভূতি নেই। কারণ তারা নিজেরাই নিজেদের সুস্থ -স্বাভাবিক জীবনের হত্যাকারী! তারা সব নেটওয়ার্কের বাইরে, বিচ্ছিন্ন ও বিকৃত চিন্তার এমন একটা শ্রেণি যারা কানাডা সরকারের জন্য কেবলই মাথাব্যথার কারণ।

কানাডা এমন একটি জনদরদী রাষ্ট্র যেখানে কোনো স্বাভাবিক মানুষের অনাহারে থাকার আসলে সুযোগ নেই। আপনার কাজ নেই? টানা দিচ্ছে সরকার। খাবার নেই? ফোন করলেই আপনার দরজায় খাবার পৌঁছে দেবে ফুড ব্যাঙ্ক। শীতের পোশাক দরকার? ফোন করলেই আপনার অ্যাকাউন্টে কমপক্ষে ৩০০ ডলার ঢুকিয়ে দিবে সরকারের ওয়েলফেয়ার বিভাগ। চিকিৎসা ব্যয়ের চিন্তাও সরকারের মাথায়।

এ সব সুযোগ সুবিধা ছেড়ে, সুন্দর ও উন্নত জীবন ফেলে এ মানুষগুলো এ কোন জীবন বেছে নিল? মার্ক জেসনরা কি রত্ন, আর কি সুখ খুঁজে পেল এ জীবনের মধ্যে?

 লেখক: সাংবাদিক