সৌহার্দ্য হোক চলার পথের মূলমন্ত্র

প্রকাশ | ০৭ জানুয়ারি ২০২১, ১২:০১

মফিজুর রহমান পলাশ

মহামারী করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে যশোর জেলার মনিরামপুরের একটি ঘটনা সারাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিলো। প্রশাসনের একজন নবীন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিলো তিনি মাস্ক না পরার অভিযোগে  স্থানীয় দুই বৃদ্ধকে কান ধরিয়ে হাটের মাঝে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। সেই ঘটনার ছবিও ওয়েবসাইটে দেখা গিয়েছিলো। সঙ্গত কারণেই দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছিলো। যদিও প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছিলো ঘটনাটি ছিলো একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।

তবে এবারের ঘটনার প্রেক্ষাপট ও চরিত্র কিছুটা ভিন্ন। সম্প্রতি পুলিশের একজন শিক্ষানবিস নারী কর্মকর্তার একটি প্রবন্ধের অংশবিশেষ সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। থানা কেন্দ্রীক পুলিশিং নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি কনস্টবল থেকে পুলিশ পরিদর্শক পর্যন্ত সবাইকে ঢালাওভাবে এক পাল্লায় মেপে ফেলেছেন যা অনেকের কাছেই আপত্তিকর মনে হয়েছে। তাঁর এহেন মন্তব্যে অনেকেই কষ্ট পেয়েছেন যা খুবই স্বাভাবিক। পুলিশের একজন হিসেবে এই ঘটনা আমাকেও নিদারুণ আহত করেছে। একজন বিসিএস কর্মকর্তার কাছ থেকে মানুষ অধিকতর দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করেন।

বলছি না পুলিশের সবাই ফেরেশতা, কোনো পেশায়ই শতভাগ ভালো মানুষ পাওয়া সুকঠিন। তবে এটাও সত্য যে, বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যই সততার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। অনেকেই হয়তো অবগত নন বা বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে, পুলিশের মোটামুটি ৮০- ৯০% ইউনিটের নিয়মনীতি, ধরন ও সাংগঠনিক কাঠামো এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে সেখানে কর্মরত সদস্যরা চাইলেও দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এমন কয়েকশ উদাহরণ দেখাতে পারবো যে পেটে ক্ষুধা নিয়েও পুলিশ সদস্যরা হাসিমুখে দায়িত্ব পালন করছেন। ওদের সাথে কথা বলে আপনি বুঝতে পারবেন না আমার কনস্টেবল টাকার অভাবে না খেয়ে ডিউটি করছেন। ওরা পেটের ক্ষুধা পেটে চাপা রেখে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে সমাজকে দেখিয়ে বেড়ান তাঁরা খুব সুখে শান্তিতে আছেন। চোখ-কান খোলা রেখে চললে আপনিও সেটা দেখতে পারতেন। এঁদেরকে অপবাদ দিলে পাপ হবে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য অভিযুক্ত ওই নবীন কর্মকর্তার লেখাটিতে ঢালাওভাবে সবাইকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি এমন বিষয়ের অবতারণা করেছেন যে বিষয়ে কোনোভাবেই তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকার কথা নয়। কেননা তিনি সবেমাত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। পুলিশের সবগুলো  ইউনিট সম্পর্কে তাঁর আদতেই জানার কথা নয়। অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি পুলিশের সামগ্রীক ইউনিট ও কর্মপরিধি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হলে দীর্ঘ বছর কাজ করতে হয়।

অভিযুক্ত কর্মকর্তার ব্যাচের সব অফিসারের লেখা ধারাবাহিকভাবে পুলিশের মাসিক পত্রিকা ডিটেকটিভে প্রকাশিত হয়ে আসছে। ফলে পত্রিকার জন্য একটা লেখা জমা দেয়ার জন্য হয়তো তাঁর ওপর একটা চাপও ছিল। এসব কারণে আমার ধারণা হয় তিনি অসম্পূর্ণ জানাশোনার আলোকে তড়িঘড়ি করে এমন কথা লিখেছেন অথবা তিনি এমন কাউকে দিয়ে লেখাটি লিখিয়ে নিয়েছেন যিনি পুলিশ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পোষণ করেন না। তবে, কারণ যেটাই হোক, এমন মন্তব্য শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, দুঃখজনকও বটে। তবে, মন্দের ভালো খবর হলো গতকাল এক অফিস আদেশে ডিটেকটিভ পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আলোচিত সংখ্যাটির সবগুলো কপি ফেরত চেয়ে ইউনিটগুলোতে চিঠি দিয়েছে।

পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সব সময় বলে থাকেন ব্যক্তির বিচ্যুতির দায় কখনোই বাহিনীর নয়। এই নবীন নারী কর্মকর্তার ঘটনাকেও আমার কাছে ব্যক্তির দায় বলে মনে হয়েছে। আমি তীব্রভাবে অনুভব করি দুই লক্ষাধিক সদস্যের পুলিশ বাহিনী একটি পরিবারের মতো। এখানে পদবী অনুসারে সবাই স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করেন। এই বিশাল পরিবারে কারো অবদানকে খাটো করে দেখার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।

মনিরামপুরের সেই ঘটনায় অভিযুক্ত নবীন কর্মকর্তা ছিলেন একজন নারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন তাঁর মুন্ডুপাত চলছিল, ঠিক সেই সময়ে নীরবতা ভেঙে এগিয়ে এলেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের একজন সম্মানিত কর্মকর্তা। তিনি প্রতিবাদী জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশ করলেন এবং অভিযোগের তীর যার দিকে সেই কর্মকর্তাকে তিনি মেয়ে সম্মোধন করে আহবান করলেন সবাই যেন তাঁর মেয়েকে ক্ষমা করে দেন। একজন তরুণ কর্মকর্তার পক্ষে একজন সিনিয়র কর্মকর্তার এমন মহানুভবতা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মুগ্ধ করেছিল। উক্ত ঘটনাটি অবশ্যই অনুকরণযোগ্য।

পুলিশের একজন ক্যাডার অফিসার হয়ে সাম্প্রতিক ঘটনায় আমার সহকর্মীদের মতো আমিও চরম বিব্রত বোধ করছি। অভিযোগের আঙ্গুল যার দিকে তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তবু আমার বিশ্বাস তিনিও ইতোমধ্যে তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন। একটা অনুরোধ করতে চাই। মানুষ মাত্রই ভুল করেন। এই নবীন কর্মকর্তা আমার, আপনার বোনের মতোই। আসুন প্রশিক্ষণরত একজন নবীশ কর্মকর্তার মন্তব্য ভুলে গিয়ে মহানুভবতা প্রদর্শন করি।

পরিশেষে একজন সদস্য হিসেবে আমার বিশ্বাস পুলিশে কর্মরত সব পর্যায়ের সদস্য ও কর্মকর্তাদের মাঝে সুন্দর, সুষম ও সৌহার্দপূর্ণ বন্ধন বিদ্যমান। কোনো ঘটনায় এই বাহিনীর সুনাম, শৌর্য, অগ্রগতি ও শৃঙ্খলা নষ্ট হতে পারে না। একজন সদস্যের দোষে যেমন পুরো বাহিনীর সব সদস্য দোষী হতে পারেন না, তদ্রুপ একজন অনভিজ্ঞ ক্যাডার অফিসারের একটি মন্তব্যের জন্য পুরো বাহিনীর সব অফিসারকে কোনোভাবেই দোষ দেয়া যায় না। পারস্পরিক সম্মান, স্নেহ ও সৌহার্দ্য হোক চলার পথের মূলমন্ত্র।

লেখক: সিনিয়র এএসপি, রংপুর আরআরএফ