করোনার রিপোর্ট ও হিসাব নিকাশ

আব্দুন নূর তুষার
 | প্রকাশিত : ০৭ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:০০

স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন ব্লুমবার্গ এর কোভিড রেজিলিয়েন্স তালিকাতে ২০ নম্বরে থাকা স্বাস্থ্যখাতের সাফল্য। হাস্যকর এই দাবি করার আগে ব্লুমবার্গের এই তালিকা কিভাবে তৈরি হয় সেটা তার বুঝে নেয়া দরকার ছিল।

ব্লুমবার্গ এর কোভিড রেজিলিয়েন্স তালিকাতে বিশ নম্বরে থাকা মানে স্বাস্থ্যখাতের কোনো অর্জন না বরং এটা একেক দেশের জন্য একেক রকম। স্বাস্থ্যখাতে অমনোযোগী একটি দেশও এখানে তালিকাতে প্রথম দিকে থাকতে পারে।

ভালো করে পড়েন। এই রিপোর্টের আগের মাসে মানে নভেম্বর মাসে দেশগুলোকে এখানে বিবেচনা করা হয়েছে।

ব্লুমবার্গ একটি অর্থনৈতিক ও ব্যবসাভিত্তিক গণযোগাযোগ ও বিনিয়োগ বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম। সারা পৃথিবীতে গত এক বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে কোভিডের কারণে মন্দা দেখা দেয়ায় তারাও মন্দার কবলে পড়েছিল। তাই সব কিছুতেই গরুর রচনা লেখার মতো তারা একটা কোভিড রেজিলিয়েন্স দেশের তালিকা প্রতিমাসে প্রকাশ করতে শুরু করেছে যেখানে ২০ নম্বরে বাংলাদেশের নাম আছে।

২. তারা ২০০ বিলিয়ন ডলারের নিচে অর্থনীতির সাইজ এমন দেশগুলোকে শুরুতেই বাদ দিয়ে দিয়েছে। ফলে একশর বেশি দেশ আগেই তালিকা থেকে বাদ। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাইজ ২০০ বিলিয়নের ওপরে বলে আমরা ৫৩ টি দেশের মধ্যে ঢুকতে পেরেছি। স্বাস্থ্যখাতে সফল অনেক দেশ এই ৫৩ টির তালিকাতেই নাই। কারণ তাদের অর্থনীতি আমাদের চেয়ে ছোট। আফ্রিকার দেশ আছে মাত্র একটা, মিশর। আর জার্মানী আমাদের পেছনে।

৩. বুঝতেই পারছেন এটা একটা অর্থনৈতিক তালিকা, স্বাস্থ্যখাতের তালিকা নয়।

৪. তারা দশটি বিষয়ে মূল্যায়ন করেছে। যার মধ্যে প্রতি মিলিয়নে কত টেস্ট পজিটিভ, কারা বেশি সময় লকডাউন দিয়েছে, কাদের কেস ফেটালিটি বেশি এসব তারা বিবেচনায় নিয়েছে। মজার ব্যপার হলো কোনো দেশ বেশি বেশি লকডাউন দিলেও বেশি বেশি টেস্ট করালে তাদের নম্বর কমে যাবে। কারণ হলো ব্লুমবার্গ এর এই লিস্ট হলো সেসব দেশের জন্য যারা মানুষ এর জীবনকে তেমন বেশি বিব্রত বা বন্ধ না করেই কোভিড নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে তাদের লিস্ট।

৫. ব্লুমবার্গের মতে লকডাউন বেশি দেয়া মানে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি। টেস্ট বেশি করা মানে মানুষকে বেশি বেশি কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেট করা। যেটা অর্থনীতির জন্য ভালো না কারণ মানুষ এরকম হলে কাজে যেতে পারে না। তাই বেশি টেস্ট ও বেশি বেশি লকডাউনসহ কঠিনভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা করানোর ফলে জার্মানী ২১ নম্বরে ও ইউকে ৩০ নম্বরে।

৬. নিউজিল্যান্ড ও সিংগাপুর তারপরেও লিস্টে আগের দিকে আছে। নিউজিল্যান্ডের কারণ তাদের জনসংখ্যা কম। শুরুতেই লকডাউন ও কঠিন ব্যবস্থা নিয়ে তারা সফল হওয়ায় তাদের আর নতুন করে লক করতে হয় নাই। তাই তারা নম্বর বেশি পেয়েছে। সিংগাপুরেও একই কাহিনী। তাইওয়ান অস্ট্রেলিয়া নরওয়ে সবাই এ কারণে তালিকার আগে। দ্বীপ রাস্ট্র হওয়ায় বিমানযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেই তারা বাইরে থেকে করোনা আসা যাওয়াকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু এটা যেহেতু লকডাউন না তাই এটার জন্য তাদের নম্বর কাটা যায় নাই।

৭. বাংলাদেশ তাহলে কেন নম্বর পেলো। কারণ বাংলাদেশে টেস্ট কম। বাংলাদেশে লকডাউন হয়ই নাই। এখনতো সবাই যেমন খুশি তেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে এখানে বাংলাদেশ অনেক নম্বর পেয়েছে। কারো কাজে বাধা নাই যা অর্থনীতির জন্য ভালো।

৮. এই রিপোর্টের আগের মাসে মানে নভেম্বরে বাংলাদেশে প্রতি দশলাখে কেস ধরা পড়েছে মাত্র ৩৪ টা। এর মানে এখানে টেস্ট কম হচ্ছে, কেসও কম ধরা পড়ছে। জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতি দশলাখে তাই কেস ধরা পড়ার সংখ্যা এমনিতেও কমে যাচ্ছে। তাই এখানেও বাংলাদেশের নম্বর বেশি।

৯. জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতি মিলিয়নে মৃত্যুর পরিমাণও বাংলাদেশে কম। কারণ মৃত্যু কেবল হাসপাতাল থেকে রিপোর্টেড হয়। টেস্ট হয় না তাই বহু মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই গণ্য হয়। আর বেশি বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি হওয়ায় এটা নিয়ে মানুষ তেমন কিছু মনেও করে না।

১০. শতকরা পজিটিভ কেসের সংখ্যায় কিন্তু বাংলাদেশ অনেক বেশি। প্রথম তিন এর মধ্যে । প্রতি ১০০ টেস্টে বাংলাদেশে পজিটিভ ১০.২ শতাংশ। বাংলাদেশের ওপরে আছে কেবল কানাডা । এটা কি প্রমাণ করে। প্রমাণ করে যে লকডাউন না থাকায়, ইচ্ছামতো দোকানপাট খোলা রাখায় সংক্রমণের হার বাংলাদেশে অনেক বেশি।

৯. এত কথার অর্থ হলো বাংলাদেশে কোন ডিসট্যান্সিং লকডাউনের বালাই নাই। টেস্ট কম তাই পজিটিভ কম। কিন্তু সংক্রমণ বেশি অর্থাৎ স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেশি। জনসংখ্যা বেশি টেস্ট কম হওয়ায় আইসোলেশন কোয়ারেন্টিন কম। অর্থাৎ মানুষ তীব্র স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আগের মতোই জীবন কাটাচ্ছে, ইচ্ছামতো ঘোরাঘুরি ব্যবসা বানিজ্য করছে। যা অর্থনীতির জন্য ভালো। আর যেহেতু জিডিপি ফোরকাস্ট বাংলাদেশে বেশ ভালো ও পজিটিভ , এখানে বাংলাদেশ নম্বর বেশি পেয়েছে। তাই বাংলাদেশ ব্লুমবার্গের অদ্ভুত নিয়মের খেলায় ” অর্থনীতিকে কম বিপর্যস্তকারী” দেশের তালিকায় ২০ নম্বরে আছে।

১০. এই তালিকার সাথে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সাফল্যের কোনো সম্পর্ক নাই। বরং বাংলাদেশের টিকার প্রাপ্যতা মাত্র ৫ শতাংশ। তার মানে ভবিষ্যতে টিকা আসলেও মানুষ সেটা পাবে বলে ব্লুমবার্গ মনে করে না।

১১. বাংলাদেশ নম্বর পেয়েছে কমিউনিটি মোবিলিটিতে। মানে মানুষ যেখানে ইচ্ছা যখন খুশি যেতে পারে। কোনো বাধানিষেধ নাই।

অতএব ব্লুমবার্গ এর তালিকায় বাংলাদেশ ওপরে আছে অর্থনৈতিক বিবেচনায়। স্বাস্থ্যব্যবস্থার চুড়ান্ত অব্যবস্থার জন্যই তারা অর্থনীতির বিবেচনায় ভালো। কারণ ব্লুমবার্গের কাছে অর্থনীতিকে বিব্রত না করাটাই বড়। স্বাস্থ্যের বারোটা বাজলে তাদের কিছু আসে যায় না। তারা তাদের সিলেকশন ক্রাইটেরিয়াও এমনভাবে বানিয়েছে যে এখানে লকডাউন দিলে আপনি খারাপ। বেশি টেস্ট করলে আপনি খারাপ।

নিউজিল্যান্ড বেঁচে গেছে কারণ তাদের ৫০ লাখ লোক। সব টেস্ট বহু আগেই শেষ। চীনও ওপরে কারণ তাদের দেশ বড়। একজায়গা লক করলে আরেক জায়গা খোলা থাকে। এজায়গায় টেস্ট বাড়ালে আরেক জায়গায় কমে। আর জনসংখ্যা তো মাশাআল্লাহ। পার মিলিয়নে সব টেস্ট - সবসময় কমের দিকেই থাকে।

তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর খুশি হওয়ার কিছু নাই। বরং ব্লুমবার্গের তালিকা প্রমাণ করেছে এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোভিডকালীন পাবলিক হেলথ ম‍্যানেজমেন্ট বিষয়ে ব্যর্থ বলেই অর্থনীতির তালিকায় জায়গা পেয়েছে।

এখানে নকল মাস্ক বিষয় না বরং অবাধে ফুটপাতে মাস্ক বেচাকেনায় নম্বর বেশি।

এক গবেষণায় দেখা গেছে কমোড যতো আরামের ; পাইলস ততো বড়, হাগুতে রক্তপাত বেশি। এটা অনেকটা সে রকম। পয়সা বেশি কামিয়ে বড়, সুন্দর গদিআলা কমোড কিনে ধনী তালিকায় জায়গা পেলেন কিন্তু সেখানে বেশি বেশি সময় আরামে বসার বিনিময়ে পাইলস বড় করে রক্ত হাগু করলেন।

ব্লুমবার্গ একটি অর্থবাজার ভিত্তিক পত্রিকা ও প্ল‍্যাটফর্ম। এটা মাইকেল ব্লুমবার্গের নামের শেষাংশ দিয়ে নামান্কিত। ধরেন কৃষি পত্রিকার নাম সিরাজ। কারণ মালিক শাইখ সিরাজ। সেরকম আর কি। এই রিপোর্ট নিয়ে বাগাড়ম্বর অন্তসারহীনতার পরিচায়ক। এটা এদেশে জীবনের মূল্যহীণতারও প্রমাণ বটে।

লেখক: চিকিৎসক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

ঢাকাটাইমস/৭জানুয়ারি/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :