গল্প

বোধ

জে আলী
| আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:৪৪ | প্রকাশিত : ১১ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:১৭

জীবনের অর্থ বোঝার আগেই অর্থহীন হয়ে যায় অনেকের জীবন। আর এই অর্থহীন জীবনের বোঝা বয়ে বেড়ানো যতটা না কষ্টসাধ্য তার চেয়েও বেশি বিড়ম্বনার। অথচ এই বিড়ম্বনার দায় তার নিজের কর্মের, মানসিক দৈনের অথবা কর্মহীনতার। এ বিড়ম্বনার দায় চাইলেই কেউ এড়াতে পারে না। কারণ এ দায় মুক্তির বোধ যখন কারো মনে জাগে সে তখন হয় আশাহত পক্ষীর ন্যায় বাস্তুহারা, সবকিছু থেকেও যেন আশ্রয়টাই শুধু নেই। এ আশ্রয় বৈষয়িক নয়, এ আশ্রয় নিজের হতাশাগ্রস্ত মনের বিপন্নবোধ। আর এ বিপন্নবোধ যাকে পেয়ে বসে সে হয় দার্শনিকের মতো ভাববাদী নয়তো প্রচণ্ড বাস্তবতার পরাকাষ্ঠে পোড়া কাঠকয়লা। যেমনটি হয়েছে কাজল। যার দিনের ব্যস্ততা নেই, রাতের রহস্যময় তারার স্নিগ্ধতার বোধ নেই, নেই অবসরের ক্লান্তিময় আচ্ছন্নতার ভালোলাগা। এতো অল্প বয়সে এতোটা জীবন বোধ জাগ্রত হওয়া যুবক দেশে দ্বিতীয়জন আর হয়তো নেই। এ জীবন বোধ তাকে করেছে জীবনের প্রতি ঋষির মতো দায়হীন দায়িত্ববান। আর এ দায়িত্ববোধ থেকেই কাজল আজ মনের কথাগুলো উপদেশের ভঙ্গিতে বলছে অনুজ কৌশিককে। আত্মবিশ্লেষণমূলক এ উপদেশগুলো যতটা না কৌশিকের জীবনের পথ নির্দেশিকা তার চেয়েও বেশি তার নিজেরই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন অতীতের ভ্রম শোধরানোর খেদোক্তি।

তুমি যার কথা ভাবছো সে তো তোমার কথা ভাবছে না। তুমি যার জন্য অপেক্ষা করছো সে তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছে না। তুমি যার জন্য হাত গুটিয়ে নিষ্কর্মা হয়ে বসে আছো সে তো তোমার জন্য বসে নেই। তুমি যার জন্য চোখের জল ফেলছো সে তোমার জন্য চোখের জল ফেলা তো দূরের কথা হয়তো সে তোমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে বা তোমাকে নিয়ে বান্ধবীদের আড্ডায় বসে হাসাহাসি করছে। তুমি যার জন্য পড়াশোনা ছেড়েছো সে হয়তো ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার জন্য গায়ে ঘাম ছেড়ে দৌড়াচ্ছে। তুমি যার জন্য কাছের বন্ধুদের দূরে সরিয়ে দিয়েছো সে দেখো ক্লাসের পর বা বিকেলে তার বন্ধুদের নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তুমি যার জন্যে বাবা-মায়ের হাড় পানি-করা কষ্টের টাকা দেদার খরচ করছো। কিন্তু তুমি হয়তো জানোও না তোমাকে টাকা পাঠাতে গিয়ে তোমার বাবা-মা অন্যের দারস্থ হচ্ছে, আত্মসম্মান বিসর্জন দিচ্ছে অথবা ফসলের শেষ জমিটুকো বন্ধক রাখছে আর সেই টাকায় তুমি ফুটানি মেরে ডোমিনোস পিজ্জায় পিজ্জার স্লাইসগুলো তার মুখে তুলে দিয়ে সেলফি তুলছো। অথচ সে হয়তো তোমার অজান্তে দুটো টিউশনি করে মা-বাবার জন্য গ্রামে টাকা পাঠাচ্ছে। তুমি যার জন্য ক্যারিয়ারে পিছিয়ে যাচ্ছো সে হয়তো সামনের দিকে উন্নতি করছে তরতর করে। যার জন্য তুমি জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় নষ্ট করছো সে হয়তো তার মূল্যবান সময়ের প্রতিটি মিনিট কাজে লাগাচ্ছে। তুমি যার জন্য সবকিছু ছেড়েছো অথচ সে শুধু তোমাকে ছাড়া সবাইকে আপন করে নিয়েছে। তুমি যার জন্য পাহাড় সমান কষ্ট বুকে নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছো সে হয়তো বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। তুমি যার জন্য দরদ দেখাচ্ছো সে তোমাকে গাবতলির হাটে গরুর দরে বিক্রি করার পাঁয়তারা করছে।

ভাই এবার থামুন আর নিতে পারছি না। হাত উঁচু করে থামিয়ে দেয় কৌশিক।

থামতে বলছো কেন? অসহিষ্ণুভাবে বলে কাজল। এ আমার জীবন থেকে নেয়া। তুমি এখন যে বয়স পার করছো সেটা আমি পেরিয়ে এসেছি মাত্র দুই বছর আগে। তখন এসব কেউ এভাবে আমাকে বোঝায়নি, দু-একজন শুভাকাক্সক্ষী বোঝানোর চেষ্টা করলেও পাত্তা পায়নি। কারণ আমি ছিলাম তোমার চেয়ে মহাপণ্ডিত স্বভাবের।

তারপর আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় কৌশিক।

তারপর আর কি? সারাদিন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিতাম, মৌকে নিয়ে হ্যাঙ আউট, শপিং করতাম। বাপের অঢেল সম্পদ ছিলো। টাকা চাইলে কখনো নিষেধ করতো না। বাবার এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইচ্ছেমতো টাকা আনতাম আর ওর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য দু হাত খুলে খরচ করতাম। ওর অর্থনৈতিক সংকট ছিলো তাই আমি ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিতাম না। ও মুখ ফুটে কিছু চাওয়ার আগেই আমি বুঝে নিতাম কি ওর প্রয়োজন। কথাগুলো বলতে গিয়ে কাজলের গলা ধরে আসে।

দিনের বিভিন্ন সময় যেমন পৃথিবী তার রূপ বদলায়, সকাল বেলা স্নিগ্ধ আলো, দুপুরে ঠা ঠা রোদ, সন্ধ্যায় রহস্যময় লালিমা আবার হঠাৎ এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে দিনের সূর্য ঢেকে যায় মেঘের আড়ালে, মানুষের জীবনও এমন রূপ বদলায়। সারাক্ষণ হাসিখুশি মানুষও ডুবে যায় দুঃখের অতল গহ্বরে। সন্ধ্যা এখনো নামেনি, সূর্যের লাল আভাটুকু নিঃশেষ হয়ে যায়নি পশ্চিম আকাশে, কিন্তু অতীত জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে কষ্টের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে কাজলের রোদে ঝলসে যাওয়া হলদেটে অবয়ব। পরপর কয়েক বার হাপাঁনী রোগীর টান উঠার মতো করে নিঃশ্বাস টেনে নেয় কাজল।

তারপর আবারও হাতে আলতো স্পর্শ করে জানতে চায় কৌশিক।

তারপর আর কী! ও পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকে গেলো। ওর অর্থনৈতিক সংকটও গেলো কেটে। আর আমি ভার্সিটির সীমানাই পেরুতে পারলাম না।

বলেন কি ভাইয়া? অবাক হয়ে জানতে চায় কৌশিক। তারপর?

মৌ ব্র্যাক ব্যাংকে জয়েন করলো, সুন্দর গোছানো পরিপাটি জীবন। ওর এক সহৃদয়বান সহকর্মী ওকে মাঝে মাঝে লিফট দেয়। আমি রাস্তার মোড়ে মৌয়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি। গাড়ি থেকে নেমে বিনয়ে ভাইয়া বলে মাথা নুইয়ে বিদায় জানায়। আমি দূর থেকে দেখি ফর্সা চকচকে কেতাদুরস্ত মানুষটি ড্রাইভিং সিটে বসেই হাস্যোজ্জ্বল মুখে গ্রহণ করে ওর কৃতজ্ঞতা। চোখ দুটি চকচক করে, যে চোখে নেই মায়াময় ভালোবাসা, আছে মুগ্ধতা, যে মুগ্ধতা আমাকে বিদ্ধ করে মহান যিশুর বিদ্ধ হয়ে যাওয়া ক্রুসের মতোই।

তারপর কি হলো কাজল ভাই?

তারপর আর কি? বুকের ভিতর জমাটবাঁধা কষ্টগুলো দীর্ঘশ্বাসের সাথে নেমে যায় কাজলের। হাত দুটো লম্বা করে মাথার পিছনে তুলে বুক ভরে শ্বাস নেয় ক্ষয় রোগে ক্ষয়ে যাওয়া রোগীর মতো। এভাবেই চলতে লাগলো কিছুদিন। মৌর বিয়ের সম্বন্ধ আসে ভালো ভালো জায়গা থেকে। সবাই প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চবংশীয়, আর আমার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। বন্ধুরা সবাই পাস করে চাকরি খুঁজছে। দু-একজন ভালো জায়গায় ঢুকছে, আবার কেউ বা সন্ধ্যার আড্ডায় ইন্টারভিউর অভিজ্ঞতা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলছে। আর আমি তখনো স্যারদের পিছনে পিছনে ঘুরছি টিউটোরিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট, মিড টার্ম দেয়ার জন্যে।

মৌ আপুর কি হলো সেটা বলুন, আগ্রহ যেন চোখে মুখে উপচে পড়ছে কৌশিকের।

মৌ আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি করিনি।

আহ্-হা-রে ভাই কেন করলেন না? মিছরির দানার মতো আবেগ ঝরে যায় কৌশিকের গলা থেকে।

করলাম না কারণ ততোদিনে আমাদের মধ্যে যোগ্যতার অনেক ব্যবধান হয়ে গিয়েছিল। ও রাজি হলেও ওর পরিবার বেঁকে বসতো। তাছাড়া আবেগের আতিশয্যে মৌ আমাকে বিয়ে করলেও কিছুদিন পর সংসার জীবনের বাস্তবতায় সে আবেগ কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতো, শুরু হতো তিক্ততা। ছাত্রজীবনে যাই করি না কেন, পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ার পর, মৌয়ের চাকরি হওয়ার পর আমি অনেক কিছুই নতুন চোখে নতুনভাবে দেখতে শুরু করেছিলাম। কারণ ততোদিনে আশপাশের সবাই আমাকে অগ্রাহ্য করতে শুরু করেছে। কাছের বন্ধুরা এড়িয়ে চলছে, আত্মীয়স্বজনরাও আগের মতো গুরুত্ব দিচ্ছে না। অসহায় বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই নিজের পায়ের চটি খুলে চটাচট নিজের গালে মারতে ইচ্ছে করতো বারবার। মৌয়ের সাথে আমার যোগ্যতার ব্যবধান হয়ে যাওয়াতেই নিজের আত্মসম্মান নিয়ে ফিরে এলাম ওর কাছ থেকে।

সত্যিকার অর্থে কোনো মানুষ বিপদে না পড়লে মানুষ চেনে না এবং মানুষের আত্মোপলব্ধি আসে না। আপনি যেভাবে ভেবেছেন উনি এভাবে নাও ভাবতে পারেন। জোর দিয়ে বলে কৌশিক।

হ্যাঁ হয়তো তোমার কথাই ঠিক কিন্তু জীবন আসলে অঙ্কের মতো সূত্র মেনে চলে, তুমি যদি জীবনকে এক পার্সেন্ট ফাঁকি দাও জীবনও তোমাকে এক পার্সেন্ট ফাঁকি দেবে। তুমি যদি জীবন নিয়ে বাজি ধরো সেও তোমার সাথে বাজি ধরবে। দুর্র্যোধন আর শকুনীমামা যেভাবে কূটচালে পাশা খেলায় হারিয়ে ছিলো পঞ্চপান্ডবদের, জীবন সেভাবে কূটচালে খেলবে না তোমার সাথে। জীবনের খেলা পদ্ম পুকুরে ঢিল ছোড়ার মতো। ঢিল যতো জোরে ছুড়বে ঢেউ ততো দূরে প্রসারিত হবে। তুমি যদি জীবন নিয়ে শুরু থেকে সিরিয়াস হও জীবনও তোমাকে তার ফল পাইয়ে দিবে সুনিশ্চিতভাবে।

যেমন? জানতে চায় কৌশিক।

আমার সাথে একই মেসে থাকতো টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের আসাদ। ও পড়তো ম্যানেজমেন্টে। আমরা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতাম, গল্প করতাম, গেমস খেলতাম, কারো জন্মদিন হলে বাইরে ঘুরতে যেতাম দল বেঁধে, কোনো রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে আর পড়তে বসতাম না। অবশ্য আমাদের অনেকের পড়ার জন্য চেয়ার-টেবিল-ই ছিল না। তুমি অবাক হবে, আসাদ এসবের ধারেকাছেও যেতো না। বিদ্যুৎ গেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে ও পড়াশোনা করতো। মাথার উপর ফ্যানটাও ঘুরতো না, ঘামে ওর গোসল হয়ে যেতো। তারপরও টেবিল ছেড়ে বাইরে আসতো না, আমাদের দিকে ও ফিরেও তাকাতো না। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ও পড়াশোনা নিয়ে থাকতো। আমরা ওকে আঁতেল বলতাম, টিটকারি করতাম, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতাম, মাঝে মাঝে ওর পড়াশোনা দেখে জেদচেপে গেলে জোরে ভলিয়্যুম দিয়ে গান শোনতাম, ইচ্ছে করে জোরে জোরে হাসতাম, কাসতাম, ওকে বিরক্ত করতাম কিন্তু ও থাকতো মহামতি গৌতম বুদ্ধের মতো নির্বিকার।

এখন উনি কি করছেন? শুনতে চায় কৌশিক।

ও জাপানের ওকিনাওয়ার রায়কুয়াস ইউনিভার্টিতে পিএইচডি শেষ করে ওখানেই শিক্ষকতা করছে। থাক সেসব কথা, যা বলছিলাম-জীবনকে তুমি যেভাবে পরিচালনা করবে সেও ঠিক সেইভাবে তোমাকে ফিডব্যাক দিবে। এতে কোনো ভুল নেই।

মৌ আপু কি বিয়ে করছেন? জানতে চায় কৌশিক।

হ্যাঁ ওতো যথেষ্ট সুন্দরী, আমি ওকে ছেড়ে চলে আসার মাস তিনেক পরে ও বিয়ে করে। এই তিন মাসে তিন হাজার বার ফোন করেছে, তিনশ বার দেখা করার চেষ্টা করেছে। আমাকে অনেকভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছে ওর বাবা মাকেও রাজি করিয়েছিলো। আমি ফিরে যাইনি, ও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো তাই আমি চাইনি এই প্রচণ্ড ভালোবাসা প্রচণ্ড ঘৃণায় রূপ নিক। তুমি জেনে অবাক হবে কৌশিক- সিনেমা নাটকে নয় বাস্তব জীবনে এই শহরে মৌয়ের মতো দ্বিতীয় কোনো সুন্দরী আমার চোখে পড়েনি। হয়তো বলবে বাড়িয়ে বলছি, কিন্তু বাড়িয়ে বলার মানুষ আমি না। একটা কথা মনে রেখো, জ¦লন্ত কাঠ কয়লার উপর দাঁড়িয়ে কেউ মিথ্যে বলে না। ও যতোদিন আমার কাছে ছিলো, পাশে ছিলো ততোদিন আমার নিজেকে মনে হতো সম্রাট হুমায়ুনের মতো পরিতৃপ্ত এক বাদশা। যদিও এখন আমার জীবন কাটছে নবাব সিরাজউদদৌলার শেষ জীবনের দিনগুলোর মতোই।

মৌ আপার হাসবেন্ড কী করেন? জানতে চায় কৌশিক।

ও শেষে এক ডাক্তারকে বিয়ে করেছে। ও এখন খুব ভালো আছে। বুক খালি করা দীর্ঘশ্বাস নেমে যায় কাজলের। হালকা লাগে নিজেকে, প্রচণ্ড ধোঁয়ায় নাক-মুখ ডুবে যাওয়ার পর শুদ্ধ বাতাস পেলে যেমন স্বস্তি হয় ভেতর থেকে।

ভাই একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ভালোবাসা খাঁটি না ভেজাল বুঝবো কীভাবে? প্রশ্ন করে কৌশিক।

খাঁটি ভালোবাসাটা বোঝা বেশ কঠিন কিন্তু ভেজালটা বোঝা যায় সহজেই। ভেজাল ভালোবাসাটা শুধুই প্রয়োজনের, আবেগ থাকে না। ভেজাল ভালোবাসা প্রয়োজন হলে কাপর খুলতেও দ্বিধা করবে না। আবার বিনা প্রয়োজনে তোমার ফোনটাও রিসিভ করবে না, মেসেজ গিয়ে নীল হয়েই পড়ে থাকবে মেসেঞ্জারে। সিন করারও সময় পাবে না। আবার তোমাকে দরকার হলে রাত তিনটায়ও ফোন করে বাসা হতে বের হয়ে আসবে। তোমার প্রয়োজনে বাসার পাশে গিয়ে ফোন দিলে বলবে বাসায় মা আছেন প্রতিবেশীরা কি ভাববে এখন বের হতে পারবো না এসব আর কি? একজন মানুষ আরেকজনকে কতোটা ভালোবাসে তা বোঝা যায় যখন সে তার ছোট ছোট বিষয়গুলোকেও মারাত্মকভাবে গুরুত্ব দেয়। খাঁটি ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্য বিশ্ব সংসার তন্নতন্ন করে খুঁজে আনার দরকার নেই সুনীলের একশ আটটি নীলপদ্ম। দরকার নেই দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বাঁধা লাল কাপড়। দরকার নেই জান দেয়ার, দরকার শুধু তাকে ভিতর থেকে ফিল করা। তাকে বোঝা, প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানো, তার সাধারণ, অতিসাধারণ আবেগের জায়গাগুলোতে সাড়া দেয়া, তার পছন্দ-অপছন্দগুলোকে গুরুত্ব দেয়া, জরিয়ে ধরে চুমো খাওয়া নয়। আঙুলে আঙুল স্পর্শ করা, সুযোগ পেলেই শরীরের স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে ছুঁয়ে দেওয়া নয়। তার কথা মন দিয়ে শোনা। কারণ তার কথা মন দিয়ে শোনার মতো কেউ নেই বলেই সে তোমার কাছে এসেছে। মুখে খৈ ফোটানোর দিন শেষ। আবেগহীন ভালোবাসা সহজেই ধরা যায়, যদি দেখার মতো চোখ থাকে, বোঝার মতো যৌক্তিক মন থাকে। ভালোবাসার ফাঁকিটা সহজেই ধরা পড়ে, যেমন চোখের ভিতর কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বালুকণা পড়লেও চোখ তা ঠিকই টের পায়। অনেকে ফাঁকিটা বুঝতে পারলেও প্রকাশ করে না, সংকোচে হজম করে। ভালোবাসি না, ভালোবাসতে পারবো না বলতে সাহস লাগে, কিন্তু মনে এতোটুকু ভালোবাসা নেই অথচ মুখে জাদুময় আবেগ দেখানো চরম অন্যায়, অসততা। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল কাজল।

এই অন্যায়ের বেসাতিই তো মেয়েরা এখন করেছে বড়ভাই উদাসভাবে বলে কৌশিক।

শুধু মেয়েরা কেন সুযোগ পেলে ছেলেরাও করে, আর মেয়েদের তোমরা সুযোগ দাও বলে করে, আবেগহীনভাবে বলে কাজল।

কিন্তু কাকে বিশ্বাস করবো, যুগই তো বদলে গেছে, বদলে গেছে সময়- যোগ করে কৌশিক।

সময় ঠিকই আছে বদলে গেছে মানুষগুলো। জীবন সম্পর্কে গভীরভাবে কেউ ভাবে না বলেই এমন হচ্ছে। জীবনের গতিপথ ঠিক করা নেই বলেই গতিহীন হয় জীবন। তুমি ঠিক হও আশপাশের সব কিছুই বরাবর ঠিক হয়ে যাবে। শুধু পরিবারের না, সমাজের অন্য সবার দৃষ্টিও বদলে যাবে তোমার প্রতি। জোর দিয়ে বলে কাজল।

সত্যি বলতে কি, এমন কথা এভাবে কেউ কোনো দিন বলেনি, পাশে বসিয়ে বোঝায়নি। না বাবা-মা, না শিক্ষক, না কোনো আপন কেউ। আন্তরিকতার সাথে কথাগুলো বলে কৌশিক।

ওর কথা বলার ধরনটাই কেমন যেন দরদ মাখানো খাঁটি নির্ভেজাল। দূর থেকে বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ বাতাস এসে হঠাৎ যেমন গা ঠান্ডা করে দেয় ঠিক এমন একটি অনুভূতি হয় কাজলের।

তোমার কথা সত্যি, পাশাপাশি এও সত্যি যে, তোমরা মহাপণ্ডিতেরা কি কারো কথার গুরুত্ব দেয়? পরিবারের অবস্থা যাই থাক প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েই ফুটানি মারা শুরু করে। চালচলনে মনে হয় করটিয়ার জমিদার পন্নি পরিবারের কেউ একজন। শুধুমাত্র বন্ধুদের বাহবা পেতে অথবা মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নিজস্ব স্বকীয়তা ভুলে পড়াশোনা শিকেয় তুলে হয়ে যাও ফোর টোয়েন্টি। অথচ জীবনের প্রায়োরিটি ঠিক করতে হয় ভার্সিটি লাইফের শুরুতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা সেই প্রায়োরিটিটাই ঠিক করতে পারি না ছাত্রজীবনে। নিজের পেছনে ফেলে আসা অতীতের দিকে অপলক তাকিয়ে নিজের মনো মন্দিরে রোমন্থন করে কাজল।

প্রায়োরিটি বিষয়টাই তো ক্লিয়ার না ভাই, সরলভাবে বলে কৌশিক।

জীবনের উদ্দেশ্য কি? আর সেই উদ্দেশ্যকে অর্জনের জন্য সবচেয়ে জরুরি কোন কাজটি সেই জরুরি কাজটি চিহ্নিত করাই হলো প্রায়োরিটি। কৌশিকের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে কিছুটা ভারমুক্ত হয় কাজল। ফাইজার সাথে প্রেম করা প্রায়োরিটি না। দিনের পর দিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া প্রায়োরিটি না। প্রায়োরিটি হচ্ছে জীবনের সেরা হওয়ার যুদ্ধে নামা, নিজের সাথে নিজেরই এ যুদ্ধ এবং যুদ্ধ প্রতিদিনই করে যাওয়া। ধীর লয়ে কথাগুলো বলে কাজল।

সেটা কীভাবে সম্ভব? বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, গালফ্রেন্ড এসব ছাড়া কি জীবন চলে? কাজলের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে কৌশিক।

হা-হা-হা শব্দ করে হেসে উঠে কাজল।

হাসলেন যে, অবাক হয়ে জানতে চায় কৌশিক।

শোন, ভারতের বিখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায় তার উপন্যাস ‘দ্যা গড অফ স্মল থিংস’-এ বলেছেন, একজন মানুষ কখনোই একসাথে দুটি কাজ করতে পারে না, পারলেও কোনোটাতে এক্সিলেন্স আসবে না। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ ইমাম গাজ্জালী বলেছেন, শিক্ষার্থীদের মন ক্ষুদ্র নালার পানির মতোই, যে পানি কিছুটা মাটি শুষে নেয়, কিছু অংশ বাতাসে উড়ে যায়, আর অল্প কিছু অংশ থাকে তার শস্য ক্ষেতে পৌঁছানোর মতো। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’। এই বেদে শিক্ষার্থীদের আমোদ আহ্লাদ নৃত্য- গীতাদি এমনকি লোকের ভিড়ে পর্যন্ত যাওয়া নিষেধ করা হয়েছে। মহামতি গৌতম বুদ্ধের ত্রিপিটকে শিক্ষার্থীদের সাজগোজ, মালা-চন্দন ব্যবহার নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি শিক্ষার্থীদের কারো কাছ থেকে দান, অনুদান বা উপহার সামগ্রী গ্রহণেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, কারণ শিক্ষার্থীদের মন এতে বিক্ষিপ্ত হতে পারে।

আর হাসলাম এই জন্য যে, বন্ধু-বান্ধব বলতে জগতে কিছু নেই। যদিও জ্ঞানী লোকেরা বলেন- একজন ভালো বন্ধু একটি লাইব্রেরির চেয়েও উত্তম। এখন প্রশ্ন হলো এই ভালো বন্ধু পাবে কোথায়?

কৌশিকের চোখের দিকে তাকিয়ে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছে কাজল।

ইহ জনমেও একজন ভালো বন্ধু পাবে কি না সন্দেহ। কারণ বন্ধুত্ব শব্দটা চলে গিয়েছে অর্থবিত্ত আর সফলতার দিকে। আজ যে বন্ধুর জন্যে জীবন দিচ্ছো, না খেয়ে বসে আছো, পকেটের টাকা খরচ করে জন্মদিন পালন করছো, সে পাঁচ বছরে একবারও ফোন দেয়ার সময় পাবে না। কিন্তু যদি পকেটে পয়সা থাকে খরচ করার মতো অথবা ক্ষমতা থাকে সরকারি দলের বা প্রশাসনের তাহলে বন্ধুরও অভাব হবে না। আজ ক্লাসের যে ছেলেকে তুমি হয়তো চেনো না, পাত্তা দাও না, কিন্তু কর্মগুণে বা কপালগুণে সে যদি হয় কোটিপতি বা শিল্পপতি, সরকারি বড় কর্মকর্তা বা পলিটিশিয়ান তাহলে সেই ভবিষ্যতে হবে তোমাদের সবার মধ্যমণি, তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে সে হবে প্রধান অতিথি বা সামাজিক অনুষ্ঠানে বড় ডোনার। থামলে কাজল।

ভাই মাথাটা তো আউলা করে দিলেন, মাথার চুল দু আঙুলে উপরের দিকে টেনে তুলে বলে কৌশিক।

আরে ভাই আউলানোর কিছু নাই। মুচকি হেসে বলে কাজল। একটা এসএমএসের রিপ্লাই পাওয়ার জন্য এফবি মেসেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছো। সে কি আসলে তোমার জন্য বসে আছে? সে তো সিন-ই করেনি, আর সিন করলেও তুমি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নও বলেই রিপ্লাই দিচ্ছে না বা দেয়ার প্রয়োজনই মনে করছে না। অজান্তে পড়ে আছে নীল রং হয়ে। তোমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে সে ব্যস্ত অন্য কাজে, অথচ তুমি অপেক্ষা করেই যাচ্ছো চরম ধৈর্য নিয়ে। তুমি একটা ছাগল তাই এতো কিছুর পরেও তুমি তাকে নিয়েই পরে আছো, এটাই কি বাস্তবতা নয়। জানতে চায় কাজল।

হ্যাঁ থাকিই তো, চাইলেই তো মনকে মানানো যায় না। চেষ্টা তো করি, আক্ষেপের সুরে কৌশিক।

আবারো হাসালেন ভাই, মনের কাজটাই তো এমন, শালা খাবে দাবে আমার আর ভাববে অন্যকে নিয়ে, একটুতেই ইমোশনাল করে দেবে।

এক্কেবারে সত্য বলছেন ভাই, খুব মজা পেলাম।

দোষ তো মনের না জোর দিয়ে বলে কাজল।

মানে? জানতে চায় কৌশিক। হ্যাঁ দোষ মনের না।

দোষ তোমার, তুমি মনকে যা ভাবতে শিখিয়েছো, যা সত্যি নয় তা তুমি জোর করে ভেবেছো এবং কল্পনা করেছো, মন যেহেতু শুরুতে সত্য-মিথ্যা আলাদা করতে পারে না, সে তোমার কল্পনাগুলো, চিন্তাগুলো স্থায়ীভাবে নিয়ে নিয়েছে তোমার অজান্তেই। আর এখন তুমি চাইলেও মন তোমার সে চাওয়ায় সাড়া দেবে না। গেঁথে যাওয়া স্মৃতিগুলো মুছবে না। তুমি মনকে যা বিশ্বাস করাতে চেয়েছো সত্যি-মিথ্যা যাই হোক মন তা বিশ্বাস করে ফেলেছে। আমেরিকার কিংবদন্তি লেখক নেপোলিয়ান হিল-এর লেখা ‘থিংক এন্ড গ্রো রিচ’ বইটি পড়ে দেখো, এ বিষয়ে বিশদ জানতে পারবে। মনের শক্তির উপর এতো চমৎকার বই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। আর একটা বিষয়, যদিও মানুষ বলে মনের অসুখ ছাড়ে না, এটা কিন্তু ডাহা মিথ্যা কথা। ভালো-খারাপ কোনোটাই মন দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারে না, ভুলে যায়। আমরা আবেগী মানুষগুলো মনকে তা স্মরণ করিয়ে দেই। কারণ আমরা মনকে ভারাক্রান্ত করতে পছন্দ করি। আমরা সুখের চেয়ে দুঃখকে লালন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, এটাই বাস্তব। এটুকু বলেই থেমে যায় কাজল।

আমি তো বুঝি ফারিয়া আমাকে কষ্ট দিচ্ছে ইচ্ছে করেই, তারপরও আমি ওকে ভুলতে পারছি না। কেন ওর পেছনে আঠার মতো লেগে সময় নষ্ট করছি, তা এতোদিন না বুঝলেও আপনার কথা শোনার পর মনে বল পাচ্ছি। আবেগতাড়িত হয় কৌশিক।

তুমি শুধু একা না, এমনটা সবার ক্ষেত্রেই হয়। ব্যাপারটা একটু খুলে বলি-এমনই তো হবার কথা তাই না? এই ধরো বর্তমানে তোমার খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই, ক্লাস নেই, থাকলেও নিয়মিত করো না। বাসায় কোনো চেয়ার-টেবিল নেই, থাকলেও তাতে কোনো পাঠ্যবই বা অন্য কোনো বই নেই। জীবনের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, নিজেকে তৈরি করার আগ্রহ নেই, ভালো মনের ও মানের ক্যারিয়ারিস্ট বন্ধু-বান্ধব নেই। ভালো কোনো শিক্ষকের পরামর্শ বা কোনো মেন্টর নেই। বাড়ি থেকে দূরে থাকো বলে বাবা-মায়ের কোনো নজরদারি নেই, আছে শুধু ফারিয়া।

যদি জীবনের সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য থাকতো, ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নিয়ে ভাবতে এবং কাজ করতে তাহলে ফারিয়াকে নিয়ে ভাবার সময়ই পেতে না, কষ্ট পাওয়া তো দূরের কথা। আরএফএল-এর বালতিতে দুধও ধরে আবার চাইলে তুমি সমপরিমাণ আলকাতরা দিয়েও বালতি ভরতে পারো। বিষয় হলো যদি তোমার জীবনের বালতি আগেই আলকাতরা দিয়ে ভরে ফেলো দুধ রাখার জায়গা আর থাকবে না। তোমার মনও ঠিক এমনি। তুমি কি দিয়ে মনকে ভারাক্রান্ত করেছো তা একান্তই তোমার নিজস্ব বিষয়। তুমি সচেতন বা অসচেতনভাবে মনের মধ্যে যাই রাখো সেটাই পরবর্তীতে তোমাকে ভোগাবে অথবা স্বাচ্ছন্দ্য দেবে। এতে মনের কোনো দোষ নেই। বাজারের ব্যাগে যদি বাজার সদাই না রেখে গোখরা সাপ ভরে রাস্তায় হাঁটো তাহলে সাপ ফোঁস করবে আর সুযোগ পেলে ঢালবে মরণ বিষ। ঠিক কি না বলো? প্রশ্ন করে কাজল।

ফারিয়াকে ঐ গোখরা সাপের সাথে তুলনা করলে অযৌক্তিক হবে না ভাই, বরং তার চেয়েও বেশি, হতাশভাবে বলে কৌশিক।

কথা ক্লিয়ার কোনো ভেজাল নেই, যারা সচেতন তারা জানে সফলতার বিকল্প নেই, সফল হতে না পারলে গালফ্রেন্ড তো দূরের কথা পরিবারের আপনজনেরাও পাত্তা দেয় না। কারণ প্রতিটি পরিবারে তার গুরুত্বই বেশি যার ইনকাম বেশি। যে খরচ বেশি করতে পারে দু হাত খুলে। ফারিয়ার জন্য জান দিচ্ছো অথচ তুমি সফল হতে না পারলে সে ফিরেও তাকাবে না। আর যদি ভুলে তাকায়ও তাহলে চোখের সে চাহনিতে থাকবে করুণা ভালোবাসা নয়। যেন সে তোমাকে দ্রুত পাশ কাটাতে পারলেই বাঁচে। অথচ তুমি যদি সফল হও তাহলে ওর মা এসে ধরনা দেবে, খাঁটি মাঘী সরিষার তেল অথবা বাঘা বাড়ির খাঁটি গাওয়া ঘি মাখবে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্যে।

এমন হয় নাকি? সূক্ষ্ম হাসির একটি স্বচ্ছরেখা ঢেউ খেলে যায় কৌশিকের দুই গালে।

হয় না মানে! একশবার হয়। মেয়ে ও মেয়ের মায়েরা এখন খুবই চালাক। নবাব সিরাজউদদৌলার খালা ঘষেটি বেগম বা দিল্লির সম্রাট ইব্রাহীম লোদীর মায়ের মতোই স্বার্থপর বটে। তারা একটি ছেলের চাল-চলন, কথা-বার্তা শুনেই বুঝতে পারে চান্দু চান্দে যাবে না তলাবে! এবং তারা সাবধান হয়ে যায় কিন্তু কখনোই মহান প্রেমিককে এটা বুঝতে দেয় না। চালাকি করে আরো কিছু দিন তাকে নিয়ে খেলা করে এবং আস্তে আস্তে পিছুটান দেয়। আর তখনই প্রেমিকের মাঝে শুরু হয় হতাশা, আত্মগ্লানি এবং তার নিজের অক্ষমতার দৃশ্যমান দুঃখবোধ।

ভাই আর নিতে পারছি না। এক কথায় বলুন এখন কি করবো?

জানতে চায় কৌশিক।

বলে লাভ নেই, মানতে পারবে না। মুচকি হেসে বলে কাজল।

মানতে নাই বা পারলাম তবুও শুনি, যদি নিজের কোনো পরিবর্তন হয়, হওয়াটাও তো প্রয়োজন আর কতো ধরা খাবো বলুন- আবেগতাড়িত হয়ে বলে কৌশিক।

এই মুহূর্তে যেটা করতে পারো তা হলো, কিছু ভালো বই পড়ো, সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কমিয়ে দাও, আমি একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে চিনি উনি এখন আছেন চট্টগ্রামে, উনি ফেসবুকে কোনো স্ট্যাটাস দিলে লাইক পায় টু-কে, থ্রি- কে, কমেন্টও পায় শত শত অথচ উনি এদের অনেককে চেনেনও না। যদি সফল হও সবাই তোমাকে চিনবে, যদি ব্যর্থ হও কেউ পুছবেও না। আগেও বলেছি এ জগৎ বড় কঠিন জায়গা। প্রেম, ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি, সম্মান শ্রদ্ধাবোধ এমনকি রক্তের সম্পর্ক মূল্যহীন যদি না তোমার অর্থ থাকে। যদি তুমি ভালো একটা জায়গায় দাঁড়াতে না পারো। জগতের প্রতিটি মানুষের দুটি রূপ আছে, যা তুমি এখন দেখতে পাবে না, দেখলেও বুঝতে পারবে না। এরূপ সফল মানুষদের প্রতি এক রকম আর ব্যর্থদের প্রতি সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন তুমি তোমার পথ ঠিক করে নাও জগতের মানুষ কীভাবে তোমাকে দেখবে!

ভাই মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নিজের মাথা এপাশ ওপাশ ঝাঁকিয়ে বলে কৌশিক।

আরে না, কি যে বলো ছোট ভাই! একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে, এক ঘণ্টা পর আর কিছুই মনে থাকবে না, একদিন পর যে লাউ সেই কদু, এ পর্যন্ত বলে থামে কাজল।

জ্যোতিষীর মতো বইলেন না ভাই, খারাপ লাগে, সুপ্ত হাসির রেখা অস্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় কৌশিকের ঠোঁটের কোনেই। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, চারদিকটা হঠাৎই শব্দহীন, ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মনের আয়নায় ভেসে উঠে অসুস্থ মায়ের বেদনাক্লিষ্ট মুখ, সবজি মাথায় নিয়ে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বাবার হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য। হঠাৎ দম বন্ধ করা একটা খারাপ লাগার অনুভূতি গলা দিয়ে দলা পাকিয়ে আসতে চায়, ছোট বোনের ছেঁড়া চটি জুতা সারাবার আপসহীন চেষ্টায় অসহায়ত্ব ফোটে উঠা দুটি নিষ্পাপ কাজল কালো চোখ বুকে বিঁধে পাথরে শান দেয়া ছুড়ির মতো। নিজেকে নিজের কাছে অথর্ব, অসহায় লাগে, মনে হয় অজানা অচেনা একটা মানুষ এতোদিন বাস করতো তারই রক্ত-মাংসের শরীরে। পা দুটো টেনে তুলতে পারে না কৌশিক। শরীরের তাল রাখতে গিয়ে হোঁচট খায় দরজার সাথে। প্রাণপণে চেষ্টা করে উঠে দাঁড়াতে, স্রোতের তোড়ে সাঁতার না জানা অসহায় মানুষের মতো বাঁচার জন্য যুদ্ধ করতে করতে এক সময় নিজেই হাল ছেড়ে দেয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :