বগুড়ার চরাঞ্চলবাসীদের সংকট যেন কাটছেই না

প্রকাশ | ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:০৯

এনাম আহমেদ, বগুড়া

ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে কোনো না কোনো নতুন সমস্যা হানা দেয় বগুড়ার চরাঞ্চলবাসীদের। ক’মাস আগেই কয়েক দফা বন্যায় দুর্ভোগের সীমা ছিলোনা তাদের। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ি মেরামত করে আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারা। তবে যমুনার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে তাদের জীবনে। প্রতিদিনের প্রয়োজনে নদী পার হতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হাঁটতে হয় তাদের। সেইসঙ্গে নৌকার জন্যও অপেক্ষা করতে হয় অনেক সময়।

বগুড়ার ২১ কিলোমিটার দূরে সারিয়াকান্দি উপজেলা। উপজেলার কালিতলা গ্রোয়েন বাধ থেকে পূর্ব দিকে খুব কাছে যে চর দেখা যায়, সেটি হলো চরবাটিয়া। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মাত্র চার মিনিটেই সেখানে পৌঁছানো যায়। চরবাটিয়ার পরে ময়ুরের চর, কুড়িপাড়া চর, শালুখা চর, দারুনা চর, চর গজারিয়া।

সরেজমিনে এই চরগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে যাতায়াত তাদের জীবনে ব্যাপক সংকটের সৃষ্টি করেছে। সেখানে ঘোড়ার গাড়ি এবং গরুর গাড়ি ছাড়া আর কোন যানবাহন চলাচল করতে পারে না। চরাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য, মালপত্র বহন এবং খুব প্রয়োজন ছাড়া চরাঞ্চলের মানুষ কেউ ঘোড়ার গাড়িতে উঠেন না। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটে ঘাটে যান নদী পাড় হতে। চরের মানুষগুলো দিনমজুরী, কৃষিকাজ আর মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। নদীতে পানি থাকলে মাছ শিকার আর জমিতে চাষাবাদ করার পর সংসারের অভাব লাঘব করতে তাদের অনেকেই নদীর এপার আসেন দিনমজুরী করতে। কিন্তু ঘণ্টা ঘণ্টা পায়ে হেঁটে নদীর তীরে এসে নৌকার জন্য আরো দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ফলে দিনমজুরের অনেকটা সময় নষ্ট হয় এসব শ্রমিকদের। এছাড়া চরে হাসপাতাল না থাকায় চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয় চরাঞ্চলের মানুষদের। বেশি বিপদের সম্মুখীন হন প্রসূতি মায়েরা। যোগাযোগ ব্যবস্থা শোচনীয় হওয়ায় সময় মতো তারা হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না। অনেক সময় পথেই প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটে। 

কুড়িপাড়া চরের বাসিন্দা লেমন জানান, তিনি দুই বার ধানের জমি তৈরি করে চারা রোপণ করেছিলেন। কিন্তু দুইবারই বন্যার কারণে জমি নষ্ট হয়ে যায়। পানি নেমে যাওয়ার পর ধান চাষের সময় থাকায় তিনি পুনরায় জমি তৈরি করে চারা রোপণ করেন। কিন্তু ফলন ভাল হয়নি। ৭ বিঘা জমি থেকে তার সাত মণ ধানও উঠবে না বলে তিনি দাবি করেন।

নদী শুকিয়ে গেলে তাদের অসুবিধার কথা জানিয়ে লেমন আরো জানান, তার বাড়ি থেকে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় হাঁটার পর তিনি তীরে পৌঁছাতে পারেন। এরপর যদি ভাগ্য ভাল হয় তাহলে নৌকা সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যায়। আর না হলে দেড়/দুই ঘণ্টা তাকে নদী পাড় হতে সেখানেই অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া চরবাসীদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ঘোড়ার গাড়ি অথবা সাঁই করে  (চৌকির চতুর্পাশে রশি বেঁধে বাঁশ দিয়ে দু’জন ব্যক্তি সামনে একজন আর পেছনে একজন কাঁধে বাঁশ রেখে ঝোলাতে ঝোলাতে নিয়ে যায়) ঘাঁটে নিয়ে যেতে হয়। তবে নদীতে পানি থাকলে যাতায়াত ব্যবস্থার কোন সমস্যা নেই আমাদের। কারণ সে সময় নৌকার কোন অভাব হয় না।

কাজলার চরের নার্গিস বেগম জানান, চরে তাদের অনেক কষ্টে জীবন যাপন করতে হয়। বর্ষায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলে বন্যায় তাদের বাড়িঘর ডুবে যায়। উপায় না পেয়ে তাদের বাঁধে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। শুষ্ক মৌসুমেও তাদের সমস্যা। বিশেষ করে বাজার হাট করতে তাদের সারিয়াকান্দি যেতেই হয়। নদীতে পানি থাকলে নৌকা সব সময় পাওয়া যায়।

অন্যদিকে নিজ তিতপরল গ্রামের ঘোড়ার গাড়ি চালক মিন্টু জানান, তিনি কৃষি কাজ এবং ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে মালপত্র বহন দুটোই করেন। শুষ্ক মৌসুমে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে তার প্রতিদিন আয় হয় প্রায় ১২০০ টাকার মতো। ঘোড়াটি তিনি বাচ্চা অবস্থায় কিনেছিলেন ২৫ টাকায়। ঘোড়া খাবারের পেছনে তার প্রতিদিন খরচ হয় প্রায় ৪০০ টাকার মতো। বর্ষাকালে যখন নদীতে পানি থাকে তখন ঘোড়াটি অকেজো অবস্থায় থাকে। 

সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা জানান, চরের অনেক রোগীই আছেন, যাদের চিকিৎসা দ্রুত করলে অল্পতেই সেরে ওঠা সম্ভব। কিন্তু চরে বাড়ি হওয়ায় কষ্ট করে অনেকেই এদিকে আসতে চায়না। যে কারণে কাটা ছেঁড়া জায়গায় প্রদাহ হয়, তাদের রোগটা বেড়ে যায়। এছাড়া দেরি করে আসার কারণে তাদের রোগ সারতেও সময় লাগে।

তবে বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের সাংসদ সাহাদারা মান্নান জানান, চর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ আমাদের চলছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি চরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এছাড়া যেখানে বিদ্যুৎ দেয়া যায়নি সেখানে সোলার বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আসলে চরে পাকা রাস্তা করা যায় না। তারপরও চরবাসীদের চলাচলের জন্য আরসিসি ঢালাই করা হয়েছিল। যা কয়েক বছর ভাল থাকার পর এবারের বন্যায় সেটি ভেঙে অর্ধেকের বেশি নদীর ভেতর চলে গেছে। চরবাসীর দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে প্রয়াত এমপি আব্দুল মান্নান যেভাবে তাদের সহযোগিতা করেছেন। এখনও তাদের সেভাবেই সহযোগিতা করা হচ্ছে এবং এর পরিকল্পনা রাখা হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/১৪জানুয়ারি/পিএল)