গরুর ঘরে বৃদ্ধা শান্তি রানীর বসবাস

প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:৪২ | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:৪৮

মমিনুল ইসলাম বাবু, কুড়িগ্রাম

গবাদি পশুর সঙ্গে একই ঘরে বসবাস করছেন আশি উর্ধ্ব বৃদ্ধা শান্তি রাণী। সন্তানের কাজ জুটলে মুখে খাবার ওঠে না হলে অনাহারে-অর্ধাহারে তার দিন কাটে। অভাবের তাড়নায় অন্য ছেলেরা আলাদা করে দিয়েছেন বৃদ্ধা মাকে।

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলা চাকিরপশার ইউনিয়নের মালিরপাড় গ্রামের এই বৃদ্ধার স্বামী সুধীর চন্দ্র সরকার অসুস্থতা জনিত কারণে প্রায় ৩০ বছর আগে মারা যান। একই ঘরের একদিকে তার বিছানা অন্যদিকে খড় বিছানো গরুর থাকার জায়গা। এভাবেই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা পার করছেন তিনি। তিন ছেলে আর চার মেয়ের মধ্যে ছোট ছেলে বাদে সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। জমিজমা বলতে বাড়ি ভিটে ৩ শতক আছে। এর অর্ধেক অংশে বড় ছেলে প্রবিত্র চন্দ্র সরকার তার পরিবার নিয়ে আর বাকি অংশে থাকেন শান্তি রাণী। অন্য একটি ছোট ঘরে থাকেন ছোট ছেলে অমৃত চন্দ্র সরকার। বয়স থাকতে শান্তি রাণী মানুষের বাসায় কিংবা কৃষি কাজ করলেও এখন বয়সের কারণে খাটতে পারেন না। তাই এখন সন্তান ও প্রতিবেশীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। তবে, মানুষের কাছ থেকে একটি আদী গরু(গরুর বিনিময়ে গরু পাওয়ার শর্তে) নিয়ে লালন-পালন করেন। সেই আদীকৃত গরু থেকেই তিনি একটি গরু পেয়েছেন। জরাজীর্ণ ঘরে জায়গা না থাকার কারণে গরুর গোয়াল তৈরি করতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে নিজ ঘরেই গরুসহ দিন পার করছেন শান্তি রাণী। এদিকে, কাঠমিস্ত্রি ছেলের ভাগ্যে কাজ জুটলে মা-ছেলের পেটে ভাত পড়ে নতুবা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন অতিবাহিত করতে হয়। দিন এনে দিন খাওয়া প্রতিবেশীরা তাদের সামর্থ্যরে মধ্যে সহযোগিতা করলেও সবসময় সেটাও সম্ভব হয়ে ওঠে না।

কান্না জড়িত কণ্ঠে শান্তি রাণী বলেন, ‘এই মতন করি গরু নিয়াই থাকি। খাওয়া-দাওয়া এই মতন। ছেলে দিনমজুরি খাটে যা আনে খাই না আনলে না খাই।থাকি ওই মতনে। আবার কাইও (কেউ) যদি একমুট দেয় তাইলে খাই আর না দিলে অমনে(না খেয়ে)  থাকি। একটা গরু আদি নিছনু, সেটা থাকি বাছুর হইছে। গাই কোনা ঘোরত দিছং। আর বাছুরটাকে এমন করি বড় করবাইছি(পালন করছেন)। বেটিগুলার বিয়ে দেবার সময় সম্পদ য্যাকনা ছিল সব শেষ হইছে। আর বাকি দুই বেটা বিয়া করি বউ ছোয়া নিয়া জুদা (আলাদা) খায়। এলা হামরা মা-ছোট বেটা মিলে খায়া না খায়া দিন কাটাই।’

সরকারি ভাতা বলতে দুই বছর আগে শুধু বয়স্ক কার্ড পেয়েছেন। এছাড়া আর কোন সরকারি সহযোগিতা পান না বলে জানান তিনি।

শান্তি রাণীর বড় ছেলে প্রবিত্র চন্দ্র সরকার জানান, ‘কাঠমিস্ত্রির কাজ করেই চলে তার। নিজের পরিবার নিয়ে চলা দায়। তাই এমনিতেই মায়ের খোঁজ রাখলেও ভরণ-পোষণ নিতে না পেরে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মা কে আলাদা করে দিয়েছেন।’

প্রতিবেশী স্বপ্না রাণী জানান, প্রায় বিশ বছর ধরে এমন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বিধবা শান্তি রাণী। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তেমনটি খোঁজ খবর রাখে না। তা দিয়েই মা-কাঠমিস্ত্রি ছেলে কষ্টে দিন পার করছে। ভাঙাচোড়া ঘর থাকলেও নেই কোন স্যানিটেশন ব্যবস্থা।

প্রতিবেশী গিতা রাণী জানান, বৃষ্টি এলে শান্তি রাণীর কষ্ট আরো দ্বিগুণ হয়ে যায়। বাইরে রান্নার চুলা ভিজে যায়। রান্না করতে পারে না। বেশির ভাগই সময় না খেয়ে দিন পার করেন তারা। বছর খানেক আগে আঙিনায় পিছলে পড়ে শান্তি রাণীর হাত ভেঙে গেলেও টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি।

প্রতিবেশী কমল চন্দ্র বলেন, দরিদ্র শ্রেণির মানুষের সুখ সুবিধার জন্য সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখার পরও বঞ্চিত হচ্ছে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর একটি অংশ। তাদের দেখার যেন কেউ নেই। সরকারিভাবে শান্তি রাণীর একটি থাকার ঘর দিলে এ বৃদ্ধা শেষকালে একটু শান্তি নিয়ে মরতে পেত।

শান্তি রাণীর দুরবস্থার কথা স্বীকার করে রাজারহাট চাকিরপশার ইউপি ৩ নং ওয়ার্ড মেম্বার সন্তোষ চন্দ্র মোহন্ত বলেন, সরকারি বিধি মোতাবেক একই পরিবারকে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেবার নিয়ম নেই। এরপরও বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।

এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে তাসনিম বলেন, ‘শান্তি রাণীর বিষয়টি জানতে পেরেছি। আমি খোঁজখবর নিয়ে সরকারের সুযোগ-সুবিধা দেবার উদ্যোগ নেব।’

(ঢাকাটাইমস/১৬জানুয়ারি/পিএল)