বিচ্ছিন্ন সহিংসতায় শেষ হলো ৬০ পৌরসভার ভোট

প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:২০ | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

বিচ্ছিন্ন সহিংসতা, বর্জন এবং অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ধাপে দেশের ৬০ পৌরসভায় ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে ভোট গণনা। শীত ও করোনার ঝুঁকি উপেক্ষা করে ভোটার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ভোটগ্রহণের শুরুতে কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ভোটারের লাইন।

শনিবার সকাল আটটা থেকে শুরু হয়ে বেলা চারটা পর্যন্ত চলা ভোটগ্রহণে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি সহিংসতা ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। ৬০ পৌরসভার মধ্যে তিনটিতে অনিয়ম, কাপচুপির ও এজেন্ট বের করে দেয়ার অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছেন বিএনপির প্রার্থীরা।

তবে, রিটার্নিং কর্মকর্তারা বলছেন, ভোট সুষ্ঠুভাবেই হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ তারা পাননি। বিএনপির ভোট বর্জনের বিষয়ে আ.লীগের প্রার্থীরা বলছেন, পরাজয় দেখে হয়ত ভোট বর্জন করেছেন তারা।

অন্যদিকে বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, কোথাও কোনো ধানের শীষের এজেন্ট দেখা যায়নি। নির্বাচন অংশ্রগ্রহণমূলক হয়নি বলে মন্তব্য তার। ভোটার সংখ্যা নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, দ্বিতীয় ধাপে ৬১টি পৌরসভায় ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভার একজন প্রার্থী মৃত্যুবরণ করায় ভোট স্থগিত করা হয়। আর ৬০টি পৌরসভার ৫৬টিতে মেয়র পদে ভোট হয়। নারায়ণগঞ্জের তারাবো, সিরাজগঞ্জের কাজিপুর, পাবনার ভাঙুরা ও পিরোজপুরে মোট চারটি পৌরসভায় ভোটের আগেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। তাই বাকি ৫২টিতে মেয়র পদে ভোট হয়।

গত ২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ভোটের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশিন। ২৯টি পৌরসভায় ইভিএমে এবং বাকি ৩১টি পৌরসভায় কাগজের ব্যালটে ভোট হয়।

এই ধাপের নির্বাচনে মেয়র পদে ২১১ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে দুই হাজার ২৩২ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৭২৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

বিএনপির তিন মেয়র প্রার্থীর ভোট বর্জন

কারচুপি ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগে এনে বাগেরহাটের মোংলা পোর্ট পৌরসভা নির্বাচনে বর্তমান মেয়র ও বিএনপি প্রার্থী জুলফিকার আলীসহ ১৩ জন কাউন্সিলর প্রার্থী ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। নিজের ভোট দিতে না পারায় রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ পৌরসভায় ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী আবদুর রাজ্জাক প্রামাণিক। এছাড়া কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর পৌরসভায় বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী নূরুল মিল্লাত ভোট গ্রহণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।

আমাদের মোংলা প্রতিনিধি জানান, মোংলায় ভোট বর্জনকারী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে জামায়াত সমর্থিত দুজনসহ মোট ৯ জন রয়েছেন। এছাড়া ৪ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীও ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।

শনিবার সকাল ১০টা ৪৫মিনিটে বিএনপির মেয়র প্রার্থী জুলফিকার আলীর মোংলা পৌরসভার মাদ্রাসা রোডের নিজ বাসভবনে প্রার্থীরা এ ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।

অন্যদিকে, রাজশাহী আড়ানী পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে গত দুদিন ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও আজ সেখানে শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট গ্রহণ হচ্ছে। তবে ভোটের আগের রাতে সেখান থেকে ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আজ ভোটগ্রহণ শুরুর পর ভবানীগঞ্জ পৌরসভায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আবদুর রাজ্জাক প্রামাণিক শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পৌর এলাকায় নিজের বাড়িতে সাংবাদিকদের সামনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।

তিনি বলেন, শহীদ সেকেন্দার মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে আমি আমার নিজের ভোটটা দিতে গিয়েছিলাম। নৌকার সমর্থকরা আমাকে আমার ভোটটাই দিতে দেয়নি। কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোথাও এমন হয়েছে যে প্রার্থী তার নিজের ভোট দিতে পারেননি? এমন ভোটে থেকে লাভ কী?

তিনি অভিযোগ করেন, কোনো কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট নেই। সবাইকে বের করে দেয়া হয়েছে। আর তিনি যখন ভোট দিতে যান তখন কেন্দ্রে তাকে লাঞ্ছিতও করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে তিনি ভোট বর্জন করছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র আবদুল মালেক বলেন, এখন বেলা ১১টা। ভোট যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন ভোট বর্জন করে লাভ আছে?

তিনি বলেন, ভোট বর্জনের কথা এখনও শুনিনি। সব জায়গায় বিএনপির এজেন্ট আছে। শুনলাম ১৫-২০ জন নিয়ে গিয়ে বিএনপি প্রার্থী ভোট দিয়েছেন। এখন নিশ্চিত পরাজয় দেখে হয়ত ভোট বর্জন করছেন।

ভবানীগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে ব্যালটে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে। মেয়র পদে মোট চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই প্রার্থী ছাড়া অন্য দুইজন হলেন- স্বতন্ত্র এসএম মামুনুর রশীদ (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) এবং কামাল হোসেন। কামালের প্রতীক নারিকেল গাছ। আর মামুনুর রশীদের প্রতীক জগ। দ্বিতীয় ধাপে রাজশাহীর তিনটি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অন্য দুটি পৌরসভা হলো- গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাট এবং বাঘা উপজেলার আড়ানী।

এছাড়া, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর পৌরসভায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী নূরুল মিল্লাত ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।

বেলা সাড়ে ১১টায় কুলিয়ারচরের বেতিয়ারকান্দি এলাকায় জেলা বিএনপির সভাপতি শরীফুল আলমের বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভোট গ্রহণের কয়েকদিন আগে থেকেই প্রশাসন ও সরকারি দলের লোকজন বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়ি ঘরে গিয়ে হুমকি দিয়েছে। অনেকের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আজ ভোটগ্রহণ শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টদেরকে জোরপূর্বক বের করে দেয়া হয়। অনেককে মারধরও করা হয়। এ অবস্থায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।

এ সময় জেলা বিএনপির সভাপতি শরীফুল আলম, প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আব্দুল মজিদসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আব্দুল মজিদও একই অভিযোগ করেন। জেলা বিএনপির সভাপতি শরীফুল আলম বলেন, এ সরকার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে।

তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা আশ্রাফুল আলম অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি নিজে বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করে কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাননি। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

সংঘর্ষ ও কেন্দ্র দখলের চেষ্টা:

মোংলা, রাজশাহীর ভবানিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর পৌরসভা ছাড়া কুমিল্লার চান্দিনা ও কুষ্টিয়া পৌরসভা নির্বাচনে অনিয়মের খবর পাওয়া গেছে।

চান্দিনা পৌরসভায় ভোটকেন্দ্রে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটনা ঘটেছে। এসময় একজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। এছাড়াও আহত হয়েছেন আরও তিনজন।

শনিবার সকাল ৯টার দিকে পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের হারং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের পাশে এ সংঘর্ষ হয়। এতে গুরুতর জখম ব্যক্তি হলেন ওই এলাকার বাসিন্দা মহসিন। তিনি কাউন্সিলর প্রার্থী বিল্লাল হোসেনের সমর্থক।

এছাড়া, কুষ্টিয়া পৌরসভা নির্বাচনে ১০ নং ওয়ার্ডের এক কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকরা কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শনিবার সকালে ভোটগ্রহণের শুরুতেই ওয়ার্ডের মিলপাড়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র দখলের চেষ্টা চালানো হয় বলে জানা যায়।

কাউন্সিলর প্রার্থী কিশোর কুমার জগোর সমর্থকরা এ চেষ্টা চালায়। এসময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী গোলাম মোস্তফা লাভলুর সমর্থকরা বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ও ধাক্কাধাক্কি হয়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুই পক্ষকেই কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়।

কোথাও ধানের শীষের এজেন্ট দেখিনি: মাহবুব তালুকদার

শনিবার দুপুরে সাভার পৌরসভা নির্বাচনে কয়েকটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন শেষে সাভার কলেজের কেন্দ্রে এসে গণমাধ্যমে কথা বলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

বলেন, এবার নির্বাচনে আমি যে কয়টি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করলাম, তাতে আমার মধ্যে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

‘প্রথমত, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, ধানের শীষে একটি মাত্র এজেন্ট রয়েছে। বাকি যে কেন্দ্রগুলোতে গিয়েছি কোথাও কোনো ধানের শীষের এজেন্ট দেখিনি। দ্বিতীয়ত, আমি অনেক জায়গায় পোস্টার দেখেছি কিন্তু কোনো জায়গায় বিএনপির পোস্টার দেখিনি। আমি আশা করেছিলাম, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। অংশগ্রহণমূলক হলে আমি আশা করি, নির্বাচন কমিশনের স্বস্তির বিষয় হবে।’

তিনি বলেন, ‘যেহতু ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) নির্বাচন হচ্ছে, সেহেতু ভোটার সংখ্যা একটু কম হতে পারে। আমি তাতে কিছু ভাবি না। ভোটার সংখ্যা কম হোক আর বেশি হোক—সেটা নিয়ে আমি ভাবি না। কিন্তু নির্বাচনটা যথাযথ হচ্ছে কি-না, সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। যেসব জায়গায় ব্যালটে ভোট হবে সেসব জায়গায় হয়তো ভোটার বেশি হতে পারে। তবে এইটাও ঠিক, আমি চাইবো ভোটার সংখ্যা যেন বেশি থাকে। এখন পর্যন্ত ভোটার সংখ্যা সন্তোষজনক নয়।’

(ঢাকাটাইমস/১৬জানুয়ারি/ইএস)