সংস্কৃতি এবং একটি জাতির আত্মপরিচয়

কাজী রাফি
| আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:১০ | প্রকাশিত : ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:৪০

জাতি বলতে কী বুঝায়? সংস্কৃতি কেন প্রয়োজন? এই জানাটুকু সামান্য হলেও আজ বাংলার ভূখণ্ডে বসবাসকারীদের জন্য তা যেন বিরাট এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতি হলো একটি বিশেষ ভূখণ্ডে বসবাসকারী এক ভাষাভাষী এবং একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চারিত্র্য বা আশা-আকাঙ্ক্ষাবিশিষ্ট বৃহৎ এক জনগোষ্ঠী। যে মানুষ যে দেশের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত তা হলো তার জাতি। জাতি এক ধরনের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্প্রদায়। যেমন আমরা বাঙালি জাতি। জাতিবোধ একটি নৈতিক এবং দার্শনিক চেতনা যা জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়। আর কোনো মানুষ যে দেশের নাগরিক তা হলো তার জাতীয়তা। সংস্কৃতি বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি, বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য এবং সেই বৈশিষ্ট্য চর্চায়-লালনে তাদের অর্জিত জ্ঞান। যার মধ্যে ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার, সংগীত এবং শিল্পকলা এই বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ অন ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে- ‘সামাজিক আচরণ এবং মিথস্ক্রিয়ার ধরন, জ্ঞানীয় গঠন এবং সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে যে উপলব্ধি/জ্ঞান/অভিজ্ঞান অর্জিত হয় সেটাই সংস্কৃতি। সুতরাং সংস্কৃতিকে বলা যেতে পারে, অনন্য সামাজিক গড়নকে লালনের মধ্য দিয়ে বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর যে সামষ্টিক আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে তা।’

লন্ডনের বার্নেট অ্যান্ড সাউথগেট কলেজের নৃবিজ্ঞানী ক্রিস্টিনা ডে রসি লাইভ সায়েন্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সংস্কৃতির আওতায় রয়েছে ধর্ম, খাদ্য, পোশাক, পোশাক পরার ধরন, ভাষা, বিয়ে, সংগীত, আমরা যা কিছুকে ন্যায় বা অন্যায় বলে ভাবি, আমরা যেভাবে টেবিলে বসি, যেভাবে অতিথিকে অভিবাদন জানাই, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করি এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার আরো অন্তত কয়েক লাখ বিষয়।’

বাঙালির রয়েছে চার হাজার বছরের অধিক সময় ধরে অর্জিত, লালিত এবং চর্চিত ভাষা-সংস্কৃতি। জারি-সারি-ভাটিয়ালির মতো শত ব্যঞ্জনার গান-সুরে জীবন চর্চার অনন্য সব সাংস্কৃতিক উপাদান। সংস্কৃতি একটা জাতির মননেরই পরিচায়ক নয়, বরং তাদের নিজস্ব সত্তা নির্ণয়ের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। একটা জাতির গৌরব, তাদের অর্জিত ইতিহাসের জন্ম হয় তাদের সংস্কৃতির হাত ধরে ।

সৈয়দ মুজতবা আলী বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমার শেষ প্রশ্ন। আপনাদের বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তি কি কেবল ভূগোল আর ভাষা?’ বঙ্গবন্ধু মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘না, কেবল ভূগোল আর ভাষা হলে তো আপনাদের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বিহার ওড়িশ্যার অংশবিশেষ দাবি করতাম। সে দাবি আমি করছি না। আমাদের বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তি বাংলার সকল ধর্মের, সকল বর্ণের মানুষের হাজার বছরের মিলিত সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তাতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও উপজাতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির যেমন ছাপ আছে, তেমনি আছে মুসলমান সভ্যতা সংস্কৃতির মিশ্রণ। বর্তমানের ভারত একটি পলিটিক্যাল ইউনিয়ন। আর আমরা একটি কালচার নেশন (সাংস্কৃতিক জাতি)। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের পরিচয় বাঙালি। বহুকাল আমাদের নেশন স্টেট ছিল না। সেটি এখন পেয়েছি। সেটি যদি তার সেক্যুলার সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে টিকিয়ে রাখতে পারি, তাহলে বাঙালি জাতি বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি বিশ্বে একটি আধুনিক জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাবেই।’’

একজন সন্তানের যেমন রয়েছে মায়ের গর্ভ তেমনি একটা জাতির রয়েছে একটা ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো। রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টি। প্রকৃতি-ভূমি-জলবায়ু-মাটি সেই নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নামের জাতির গর্ভ তথা মাতৃভূমিতে বসবাসকারীদের মননে যে আবহ, স্মৃতি, চেতনার জন্ম দেয় তাই-ই তাদের চারিত্র্য। নন্দনতত্ত্ব-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির পেছনে গোপনে কাজ করে তাদের আহবহমানকালের এই চারিত্র্য।

একটা জাতির মানুষের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুসারি থাকতে পারে। ধর্মবিশ্বাস তাদের ব্যক্তিগত পবিত্র অনুভূতি। আবার ধর্মীয় অনেক রীতি-উৎসব কালক্রমে একটা জাতির সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যময়তা যোগ করতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট এবং একক কোনো ধর্ম কখনো একটা জাতির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করতে পারে না। যেমন, আমরা কখনো জানতে চাই না, ব্যবিলনীয়, রোমান, পার্সিয়ান অথবা গ্রীক সভ্যতায় কয়জন বৌদ্ধ অথবা খ্রিস্টান ছিল। সেই জাতিকে আমরা ধর্মের কারণে স্মরণ করি না, করি তাদের জাতিত্বের মহানুভবতার কারণে। মিশরে কয়জন মুসলমান, কয়জন অন্যান্য ধর্মাবলম্বী তা দিয়ে মিশরীয় জাতিত্ব নির্ধারিত হয় না। মিশর বললেই তাদের চিরায়ত প্রাচীনত্বের ঐতিহ্য, তাদের সংস্কৃতি –এসবই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এবং তাদের সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই পৃথিবীতে তাদের অবস্থান এবং মর্যাদা নির্ধারণ করে।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একটা জাতির সন্তানদের চরিত্রের নির্ধারক। কিন্তু আমাদের হতাশ হতে হয় এটা ভাবলে যে, আমাদের ধর্মীয় পরিচয়কে আমরা আমাদের জাতিত্ব/সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাথে মিশিয়ে অথবা গুলিয়ে ফেলছি। ধর্মকে জাতির সাথে করে তুলেছি সাংঘর্ষিক। ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম একটা জাতির সৃষ্টিশীলতার চিহ্নই শুধু নয় বরং তা হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শনও বটে। বাংলা ভাষার লিপিতেও রয়েছে ভাস্কর্যের প্রভাব। একটা জাতির মহান সব সন্তানদের অথবা তাদের ত্যাগের কোনো ইতিহাসকে আগামী প্রজন্মের সামনে উদাহরণ অথবা অনুপ্রেরণার অনুষঙ্গ হিসেবে তুলে ধরতে, তাদেরকে জাতির অতীত ইতিহাস এবং অর্জন সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে ভাস্কর্য পালন করে অগ্রণী ভূমিকা। ভাস্কর্য অতীত সমৃদ্ধিকে নতুন সৃষ্টির সাথে সংযোগকারী এক অনন্য শিল্পমাধ্যম এবং তা একটা জাতির অগ্রযাত্রার অনুপ্রেরণাদাত্রী/স্মারকলিপি।

দ্বাদশ শতাব্দীর মহান কবি মাওলানা রুমি অথবা আমাদের ইসলামিক চেতনার পণ্ডিত ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে আমরা কখনোই স্মরণ করি না। আমরা ভুলে যাই দেশ ভাগের পরপরই আঠারোটি ভাষার পণ্ডিত ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পাকিস্তান রাষ্ট্রের কুমতলব বুঝতে পেরেছিলেন বলেই সবার আগে তিনি ভাষা আন্দোলনের চেতনার বীজ বোপণ করে দিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা সৈনিক গাজীউল হকসহ ছাত্রদের মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে বগুড়া জেলা স্কুল মাঠে তিনি এক বক্তৃতায় বলেছিলেন,

‘‘আমার ছাত্ররা পড়াশোনার পাশাপাশি যে ভাষা-সংস্কৃতি বাঁচাতে মাঠে নামে তার জন্য আমি গর্ববোধ করি।... বাংলা পৃথিবীর সপ্তম ভাষা আর উর্দু জারজ ভাষা। মোগল শিবিরে এর জন্ম (উর্দু ভাষার নিজস্ব লিপিও নেই!)’’

আজ যদি বাংলার এই মহান সন্তান বেঁচে থাকতেন, তাহলে বাংলা মায়ের (সংস্কৃতির) গর্ভে জন্মেও যারা এর সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের জন্য তিনি একই ভাষা ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করতেন না নিশ্চয়ই।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, হাজার হাজার বছরে অর্জিত আমাদের যে আদর্শিক, চেতনাগত অবস্থান–তাতে ধর্মান্ধরা ফেলেছে, ফেলছে কালো মেঘের ছায়া। তারা ধর্মটাকেই জাতিত্বের অবস্থানে ঢুকিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের জাতিগত আদর্শিক, নান্দনিক, সাংস্কৃতিক অবস্থান। সৃষ্টির বেদনায় টলমল এক মহান জাতির ভিতরের চেতনা আজ অবলুপ্ত। কবি আব্দুল হাকিম সপ্তদশ শতাব্দীতে লিখেছিলেন-

‘‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,

সে সব কাহার জন্ম নির্য় ন জানি।

দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়,

নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যায়?

মাতা-পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি,

দেশি ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।"

কিন্তু যে মাতৃ অথবা ভূমিগর্ভ আমাদের পুষ্ট করল তারপর যুগ যুগ ধরে সেই মায়ের প্রতি আমাদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? মাওলানা রুমি এবং ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর আত্মপরিচয় জানতেন। আমরা কি তা জানি? বঙ্গের জল-অন্ন, ফল-শস্যে শরীর পুষ্ট করার পর জাতির ক্রান্তিকালে আমাদের কার কী ভূমিকা ছিল তা কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেছি? ১৯৭১ সালে? ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়? ২০০৮ -এ সিডরের সময়? মাদ্রাসার অধ্যক্ষের ইন্ধনে ফেনীর রাফিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার পর? একাত্তরে যে তরুণরা বুকের রক্ত দিয়ে একটা স্বাধীন দেশের পতাকা আনল সেই পতাকার উত্তরসূরিদের আমরা কী মোটিভেশন দিলাম যে, তারা লাশের ওপর দিয়ে মসজিদে অথবা হিন্দি নাচ-গানের মঞ্চে যাওয়াই শুধু শিখল?

এখন বাঙালির জাতিত্বের সাথে যে যুদ্ধ চলছে –তা সাক্ষাৎ সমরের চেয়ে ভয়াবহ। আমরা স্বভূমির মানুষকে দেখে আর একাত্ম বোধ করি না। অদৃশ্য এই যুদ্ধ এসে আমাদের দেখিয়ে দিলো, বাঙালির অসংখ্য মানুষের চেতনায় এখন ধন-সম্পদ এবং অশেষ সওয়াব হাসিলের চকচকে লোভ ছাড়া ‘মানুষ’, ‘সমাজ’, ‘স্বদেশ’ বলে আর কোনো শব্দ নেই।

আফগানিস্তান বললেই এখন তাদের মহান সংস্কৃতি, তাদের কবিতাপ্রীতি, তাঁদের বীরত্ব, মহানুভবতা এবং উদারতা আমাদের চোখের সামনে ভাসে না। জাতির চেয়ে ধর্মকে বড় করার কারণে দিন দিন বিশ্বের মানুষের কাছে তাদের জাতিত্ব/চারিত্র্য ক্রমশ ফিকে হয়ে তাদের তালেবান পরিচয়কে বড় করে তুলছে। পাকিস্তানও সেই ধর্মীয় উগ্রতার কারণে একই পথের পথিক। জাতির চর্চার চেয়ে ধর্মীয় চর্চাকে যারা বড় করে তুলেছে, তুলতে চায় তারা আত্মপরিচয়হীন হয়ে যায়। ফলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর কে না জানে– বর্তমান বিশ্বে আত্মপরিয়হীনদের ভূমিকে কত সহজভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা যায়। সেজন্যই আফ্রিকাকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ইউরোপীয়রা স্থাপন করেছিল গির্জা এবং তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল বাইবেল। আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসকরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য তাদের সংস্কৃতি এবং ভাষাকে সবার আগে বিলীন করে দেওয়ার অভিযাত্রায় নেমেছিল।

বিয়ের কারণে শাশুড়ি নির্ধারিত হয়, আবার বদলায়ও। কিন্তু মায়ের গর্ভ সন্তানের জন্য চিরন্তন। যুগে যুগে, কালে কালে অনেক মানুষই ধর্মান্তরিত হয়েছে। মাত্র আটশ বছর আগে এ দেশে ইসলাম ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু ধর্ম বদলে গেলেও মানুষের জাতিত্ব কি বদলে যায়? আমাদের আত্মপরিচয় নির্ধারণ করে দিয়েছে বাঙালি মাতৃত্বের গর্ভ। যারা নিজের মাতৃ অথবা জাতিগর্ভ ভুলে যায় মহান স্রষ্টার কাছেও তারা মোনাফেক ব্যতীত আর কিছু নয়। তারা জাতিকে ধর্মীয় শ্রেণির সাথে, সংস্কৃতিকে উপাসনা/ইবাদতের সাথে, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যকে ধর্মীয় ব্যবহারের সাথে, স্বভূমির মানুষকে ফলের মতো শ্রেণিবিন্যাস করেছে।

আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে যোগ হয়েছে বৈচিত্র্যময় দ্বিধা-বিভক্তি। ধসের সবচেয়ে বড় বীজটা প্রোথিত হয়েছে আমাদের মায়েদের মননে। একটা জাতি কতটা মেধাবী, বীর সন্তান পাবে তা নির্ভর করে অনেকটাই মায়েদের ওপর। ভারতবর্ষের ইতিহাসে জন্মেছে অনেক বীর সন্তান। খ্রিস্ট পূর্বাব্দ তিনশ বছর আগে থেকেই তাদের ছিল দেশ-মাটি এবং সংস্কৃতির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। ফলে বারবার বিদেশি শাসকদের করাল থাবার কোলে থেকেও তারা তাদের সংস্কৃতিকে, নিজস্বতাকে হারায়নি। কিন্তু কী হলো এখন যে, সেই ধারাটা আর অক্ষুণ্ন থাকছে না?

ধর্ম আর রাজনীতি তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে আঘাত হেনেছে আমাদের সংস্কৃতিতে। নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলে দুর্নীতি, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, ভোগ-দখল, মিথ্যাচারে যারা লিপ্ত তাদের দ্বারাই ধর্ম-কর্মকে বেশি লালনে তাদের অর্থ-প্রবাহের ব্যাপক উৎস তাতে ঘৃতাগ্নি হয়ে উঠেছে। এরা সারা জীবনের অবৈধ উপার্জন এবং শেষ বয়সের বোধোদয়কে ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করে পরকালকে বিপদমুক্ত রাখতে চায়। কী অদ্ভুত ভণ্ড মানসিকতা! এই শ্রেণির প্রবল অর্থ-প্রবাহের কারণে তৈরি হয়েছে ধর্মীয় উগ্র শ্রেণি। আমাদের পবিত্র গ্রন্থ যতই বলুক, এক মসজিদ থেকে আরেক মসজিদের যেন মিনার দেখা না যায়– তারা তা মানতে নারাজ। অথচ গ্রামের পর গ্রামে নেই ভালো কোনো গ্রন্থাগার। নেই অনুসন্ধিৎসার কোনো উপকরণ। মঞ্চ-নাটক যাত্রাপালা প্রায় বিলীন। নবান্ন অথবা পৌষ-পার্বণের উৎসবও আর তেমন চোখে পড়ে না। আমাদের মহান সন্তান যারা ছিলেন, এ দেশের পথে-ঘাটে, বিলবোর্ডে, ভাস্কর্যে কোথাও তাদের কেউ প্রদর্শনের প্রয়োজন বোধ করে না। এই প্রজন্ম নজরুল-রবীন্দ্রনাথ হয়ে সত্যেন বোস, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কোনো মনীষীকে জানার তাড়না প্রেরণা পাবে কোথা থেকে?

নারীদের, মেয়েদের আমাদের মায়ের পোশাকে দেখলে তাই আমাদের ভিতর কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে। আমার মা, আমার মাতৃভূমির বেশে যাকে দেখি তাকেই আমার আপন মনে হয়। মনে মনে তাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু কখন এবং কবে থেকে মানুষ হিসেবে দিন আমরা এত অবিকশিত আর আত্মবিশ্বাসহীন এবং হিংস্র-লোভী হয়ে গেলাম যে বিজাতীয় বেশ ধারণ করে এখন নিরাপদ বেষ্টনীর মাঝে আমাদের নারীরা নিজেদের গুটিয়ে স্বাধীনতাহীনতার বেশ নিয়ে নিজেদের সম্মানিত বোধ করেন? আত্মপরিচয় এবং আত্মমর্যাদার পথগুলো শনাক্তে অক্ষম হলে – এভাবেই আমরা দিন দিন একে অন্যের প্রতি সংযোগ হারিয়ে নিজেদের কাছে নিজেরা অচেনা হয়ে যাব। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘‘তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেবো।’’

কিন্তু আমাদের মাতা-পিতার কাছে স্বশিক্ষার ধরন বদলে গেছে। সে শিক্ষায় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বড় গৌণ। যেকোনো পন্থায়, ভালো ফলাফলধারী, অর্থ-বিত্তের অধিকারী সন্তানকেই তারা কল্পনা এবং প্রত্যাশা করেন। তারা সন্তানদেরকে উদাহরণ হিসেবে অধিক সম্পদ আহরণকারীদের ইহকাল এবং পরকালকে কব্জা করার শক্তি-সামর্থ্য দেখান। আমাদের শিক্ষায় এখন জাতি হিসেবে নিজেদের আত্মপরিচয়, স্বদেশ, স্বদেশের মানুষ, ত্যাগ-সাধনার বিষয়গুলো নেই। আমরা একদিকে হিন্দি সিরিয়াল-সিনেমা, বিদেশি গায়ক-নায়িকাদের দেশে মঞ্চ কাঁপানো নাচ-গান উপভোগে অন্যদিকে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে, অর্থ উপার্জনের পথ হিসেবে বেছে নেওয়া ওয়াজকারীদের কথার তরবারির কাছে মাথা নত করে দিন দিন অবিকশিতই থেকে যাই। নিজের ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতা, সৃষ্টিশীল চেতনা অন্য সংস্কৃতিকে লালনে, অপরপক্ষে মগজ-ধোলাই করা বয়ান আর বাণীর জিম্মায় রেখে, মা-মাটি, স্বদেশ, স্বদেশের মানুষ সব ভুলে; পরিশেষে এক জাতি নয়, বিভিন্ন ধর্মীয় শ্রেণিতে/গোত্রে বিভক্ত যাই।

মাকে হতে হয় আধুনিক চেতনায় অগ্রসরমান, অসাম্প্রদায়িক এবং বিজ্ঞানমনস্ক। আমাদের ঐতিহ্য, সভ্যতা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি শুধু যে ’৫২ আর ’৭১ –এ সীমাবদ্ধ নয় –তা একজন মা যত বুঝবেন ততই মঙ্গল। কিন্তু সমাজ মায়েদের সেই চেতনা ধারণের স্বাধীনতা কি তৈরি করতে পেরেছে? একজন সৎ-নীতিবান আদর্শ সন্তান অথবা জামাইয়ের চেয়ে সহজ পন্থায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া দামি-গাড়ির মালিক, চকচকে জীবনের অধিকারী সন্তান/জামাই কাম্য হয় –তখন সব শেষ হয়ে যায়। আলোর যাত্রী কে কাকে করবে!

সুভাষচন্দ্র বসু মা’কে চিঠিতে কী লিখেছিলেন তা আমরা অনেকেই জানি। জাতীয়তাবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ তার মায়ের উত্তরটাও জানি। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে সন্তানকে মায়েরা সৎ সাহস নিয়ে বড় হয়ে ওঠার শিক্ষা দিতে ভয় পায়। একটা জাতির জাতীয়-মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতিচর্চা যত দুর্বলতর হয় সেই জাতির মানুষদের আত্মিক উন্মেষের ভিত তত দুর্বল হয়। দুর্বল আত্মায় তো বীরত্ব জাগে না! ফলে আমাদের বীর সন্তানদের; যাদের হৃদয়ে ছিল মা-মাটি এবং স্বজাতির মানুষের জন্য প্রগাঢ় ভালোবাসা তাদেরকেও মূল্যায়নে, সম্মান-শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের দ্বিধা। শুধু দ্বিধা-বিভক্তিই দিয়ে শেষ নয়। সেখানেও মিশে আছে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় ভীতি। অথচ শান্তির রক্ষাকবচ হয়ার কথা ছিল ধর্ম এবং রাজনীতিকে। রাজনীতি থেকে ক্ষমা-দয়া-উদারতা-ত্যাগ পালিয়েছে। সেখানে আশ্রয় নিয়েছে বাগাড়ম্বর। ধর্মে আর ইবাদত/উপাসনা নেই –আছে বক্তৃতা, সমাবেশ এবং মানুষের মগজ ধোলাই করে অর্থ উপার্জনের পন্থা।

এমন ভয়াবহ দেশপ্রেমহীনতার ফাঁদে আটকা পড়া এক জাতিতে পরিণত হওয়ার আগে আমাদের জেগে উঠতে হবে। সংস্কৃতির উন্মুক্ত দরজা যত বন্ধ হবে আমরা দিন দিন ততই বন্দি হয়ে পড়ব আলোহীন আঁধারে। এখান থেকে উত্তরণ না ঘটলে এক সময় আত্মমর্যাদা-ধর্ম-কর্ম তো বটেই, আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি হবে। বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় শক্তি তার ভাষা। আমাদের এই শক্তিই বারবার রক্ষাকবচ হয়ে আমাদের অস্তিত্বকে রক্ষা করেছে। মায়ের বাণীতে উচ্চারিত এই শক্তিই আবার সকলকে একত্রিত করবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশটা হয়ে উঠবে সব মানুষের–এই প্রত্যাশা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :