শিশুতোষ গল্প

"কবি ভূতের খপ্পরে"

প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০২১, ২০:১১

তৌহিদ এলাহী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর

এ কেমন কথা! কবিরা আচমকা এমন শুরু করলেন কেন? এক-দুজন না। সবার এক কথা! ভূত নাকি নেই! অনেকে আবার ফেসবুকে ভূতবিরোধী স্ট্যাটাসও দিচ্ছে।

কবি হুলুস্থুল চৌধুরী বহুল প্রচলিত দৈনিক তাড়াতাড়ি পত্রিকায় ছড়া লিখেছেন—

তাই কি হয় তাই কি নয়/কেমন কথা এটা?/আবার ভূত! কী আপদ/মর মিছে ভূত ব্যাটা!

দেশের অন্যতম কবি-ছড়াকার চুপচাপ চৌধুরী (ছদ্মনাম) লিখেছেন—

ভূতের পুত নাই, ভূতের বাপ নাই/ছেলে ভোলানো রূপকথায়/হাড্ডি চিবাই মাংস চিবাই/ হাউমাউ খাইদাই/আজগুবি সব গল্প ছড়ায়।

এত দিন কবিদের শ্রদ্ধা করে এলেও এবার নড়েচড়ে বসল রাজধানীর গোরস্তানের ভূতেরা। মুরব্বি ভূতেরা অপমান বোধ করলেন খুব। ‘ভূঁত হঁয়ে আঁর কঁত কীঁ দেঁখব! এঁত দিন বিঁজ্ঞানীরা বঁলেছেন, এঁবার ছঁড়াকাররাও শুঁরু কঁরেছে। মাঁনসম্মান গেঁল বঁলে। আর থাকে না। এঁকটা বিঁহিত কঁরতেই হয়। ’

মিরপুর ও আজিমপুর গোরস্তানের ভূতেরা মিটিং ডাকল।  নিজেদের এভাবে আর ছোট করতে দেওয়া যায় না।

নানাজনে নানা মত দেয়।

মিটিংয়ে মুরব্বি ভূতদের সিদ্ধান্ত, আরো কয়েকটা দিন দেখা যাক। আপাতত অ্যাকশনে যাওয়া হবে না। পুরান ঢাকার ভূতসহ ঢাকা শহরের সব ভূত নেতাকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিলে নাকি ভালো ফল পাওয়া যাবে। পরের মিটিং হবে বাইশ দিন পর।

আজিমপুরের ছোট্ট ভূত বিল্টুও খবরটা শুনেছে। কবিদের ছড়া পড়ার পর তারও খুব রাগ হয়েছে। সে এমনিতে ছড়া-কবিতা পছন্দ করে। নিজেও দু-চারটা লিখেছে। কিন্তু পছন্দের মানুষ কবিরা এগুলো কেন লিখল। সে তো নিজে কখনো তার ছড়ায় মানুষ বলে কিছু নেই বলে চেঁচায়নি।

সিনিয়র ভূতদের কথা চুপ করে শোনে বিল্টু। কিন্তু বাইশ তারিখ! ঢিলেমি দেখে খুব বিরক্ত হয়। এই কয়েক দিন আরো না-জানি কী সব লিখে ফেলবে কবিরা। তত দিন গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ভূত নয় বিল্টু।

পরদিন সন্ধ্যা পেরোতেই বেরিয়ে পড়ে বিল্টু। চলে আসে শাহবাগের দিকে। শুনেছে এদিকেই কবিরা মিলে একসঙ্গে গল্প করতে আসে। বিলু এগিয়ে যায়। ঝোলা পাশে রেখে কয়েকজন চা খাচ্ছে আর কথা বলছে। শূন্যে মিলিয়ে থেকে বিল্টু বুঝতে পারে, এরাই কবি। একজন কিছু একটা বলছে, অন্যরা হেসে কুটি কুটি। ভূত হওয়ার কিছু সমস্যাও আছে। ভয় দেখানো গেলেও সেটা সবার সামনে না। কারণ সবাই একসঙ্গে থাকলে কেউই ভয় পাবে না। ভয় দেখাতে হয় নিরিবিলি। আর ভূতরা মোটেও হাড্ডি-মাংস চিবায় না। কবিরা সেটাও ভুল লিখেছে। ভূতের কাজ শুধু ভয় দেখানো। মোটা গোঁফওয়ালা এক কবি একটু আড়ালে ছিল। বিল্টু তার দিকে এগিয়ে যায়। ফিস ফিস করে বলে, ‘যে বলে নাই কোনো ভূতের ভয়/স্কন্ধকাটায় তার ঘাড় মটকাতে কয়। ’

চমকে ওঠেন কবি সুড়ুৎ মিয়া। কিন্তু চুপ করে থাকেন। কিছু বলেন না। বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। এদিক-ওদিক তাকান। বিল্টু কবির গোঁফে খোঁচা দেয়। আবার কানে কানে বলে, দাদা আজকেই আবার লিখে ফেলুন তরতাজা একটা ছড়া—

‘আজে লিখেছি বাজে লিখেছি/যা লিখেছি ভুল লিখেছি/ভূতেরা ছিল, ভূতেরা থাকবে/এই আমি আজ কান ধরেছি। ’

কবি সুড়ুৎ মিয়া বিব্রত হন। আড্ডা ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন। সবাইকে বলেন, ওঠেন সবাই! এ জায়গায় ভূতের আছর আছে। যান যান! সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ভূতবিরোধী ছড়াকার কিনা বলে এখানে ভূতের আছর! পাগল হলো নাকি!

পরদিন সকাল হতেই সবাই অবাক। শাহবাগ মোড়ে জাদুঘরের দেয়ালে বড় একটা ব্যানার টাঙানো। তাতে লেখা—আমরা আছি বেঁচে আছি/কষ্টে আছি তাই/মিথ্যে আর বাজে বোকো না/ভূত মানুষের ভাই।

কে টাঙাল? নিশ্চয়ই কোনো ভূতের কাজ! গুজব ছড়াতে লাগল দ্রুত। তবে কবিরা দ্রুত ভুলে যান এসব। তাঁরা আবার বিকেলে গল্প করতে, চা খেতে বসেন। গল্প শেষে সবাই বাসার পথ ধরেন। বিল্টু নামে তার তিন নম্বর মিশনে। পাঞ্জাবি পরা কবি ফুরফুরে মজুমদারের দিকে এগিয়ে যায়। তিনি গুন গুন করে কী যেন আবৃত্তি করতে করতে আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন একা একা। বিলু খপ করে তার ঝোলা ধরে দেয় ঝাঁকি। কবি ফুরফুরে হোঁচট খান। আশপাশে তাকান। বিলুকে না দেখলেও তাঁর গলা শুনতে পান পরিষ্কার—আছে নিশি দেও-দানো/মামদো আছে, আছে গেছো/বেঘো ব্রহ্ম আর চোরাচুন্নি/জলে ডিগবাজি দেয় মেছো।

আড্ডায় সাজুগুজু করে প্রতিদিন একজন কবি আসেন। বইয়ের দোকান থেকে একটা বই কিনে রিকশায় উঠবেন সবে। এমন সময় বিল্টু তার পেছনে ফিসফিস করে বলে, সাবধান! ওহে সাজুগুজু কবি/ভূত নিয়ে আজেবাজে লিখলে পরে ঠিক বেঘোরে মরবি।

এসব ঘটনায় শাহবাগ এলাকা কবিদের জন্য আতঙ্কে পরিণত হলো। প্রতিদিনই বেছে বেছে ছড়াকারদের ভয় দেখানো হচ্ছে। কবিদের আতঙ্কটা বেশি। কারণ অন্য কাউকে আর ভয় দেখানো হচ্ছে না। শুধু কবিদেরই। এ কারণে ভয়ে অনেকে ছড়া লেখাই বন্ধ রেখেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় আছে তারা।

পত্রিকার শিশু পাতার সম্পাদকরা মহাবিপাকে। ছড়াটড়া পাচ্ছেন না। বইমেলার প্রকাশকরাও দুশ্চিন্তায়। কিন্তু ভূতের ভয় সহজে কাটতে চায় না। 

পরিস্থিতি ঘোলাটে। বিল্টুর খেয়াল হলো, এভাবে চলতে থাকলে তো ছড়া-কবিতা হারিয়ে যাবে। তার মায়া লাগে। কবি সমিতির সভাপতি উদাস মনে পথে হাঁটে। বিল্টু তার কাছে এসে বলে—বাদ দাও, ভালো হয়ে যাও এবার/স্বস্তি চাইলে ভূতের নামে লিখো না বাজে/তারাও মন খারাপ করে, কষ্ট পায়/এমনতর কাজ করা, কবিদের কি সাজে?

কিছুদিন পর আবার কবিদের আড্ডা বসে। কবিতা-ছড়া লেখা হয়। শাহবাগের ল্যাম্পপোস্টে নতুন ব্যানার টাঙানো হয়—

যা করেছি ভুল করেছি

ভূত আর কবি ভাই ভাই

এবার মোদের রক্ষা করো

ক্ষমা চাই শান্তি চাই।

লেখক: তৌহিদ এলাহী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা,  আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর

ঢাকাটাইমস/২৩জানুয়ারি/এসকেএস