প্রতারণার নতুন ফাঁদ ‘হাজির কামলা’
নাসিমা আক্তার ময়না। বেড়াতে যাবেন মেয়ের বাড়িতে। তাই বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন জুরাইন বাসস্ট্যান্ডে। তাকে দেখে এগিয়ে আসেন একজন নারী। নানা গল্পে গড়ে তোলেন সখ্য। দুজনের গল্পের মধ্যে আরেকজন এসে জানায়, স্থানীয় কয়েকজন হাজি মিলে জাকাত ও নগদ টাকা (তাদের ভাষায় ‘হাজির কামলা’) বিতরণ করছেন। তিনিও পেয়েছেন। তার হাতে থাকা পাঁচ হাজার টাকা দেখান। তা দেখে হাজির কামলা আনতে রাজি হন নাসিমা আক্তার ময়না।
এবার নাসিমাকে জানানো হয়, তার কানে ও হাতে সোনার গহনা দেখলে হাজি সাহেবরা তাকে দান করতে রাজি হবেন না। স্বর্ণালংকার খুলে তাদের কাছে রাখতে বলেন। বিশ্বাস করে তার কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও ব্যাগ তাদের কাছে রেখে যান। এরপর একটি বাড়ি দেখিয়ে ছদ্মবেশী দুজন সেখান থেকে সটকে পড়েন। পরে নাসিমা ওই বাড়িতে গিয়ে বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ‘হাজির কামলা’ নামে অভিনব এই প্রতারণার বেশ কয়েকটি ঘটনার খবর পেয়েছে পুলিশ। তারা বলছে, এটা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অপরাধ। অভিনব এই প্রতারণার ঘটনায় একাধিক মামলাও হয়েছে। জুন মাসের পর থেকে এই প্রতারণার খবর জানতে পারে পুলিশ। রাজধানীর সদরঘাট, গুলিস্তান, জুরাইন এলাকায় এই প্রতারণার ঘটনা বেশি ঘটেছে। কয়েক মাসের বেশ কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ ও মামলা পর্যালোচনা করে এই চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ২৬ ভরি স্বর্ণালংকার, ৬৮ ভরি রুপা, নগদ প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা ছাড়াও ২৭টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের শ্যামপুর ও কদমতলী জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) শাহ আলম ঢাকা টাইমসকে জানান, এই প্রতারক চক্রকে ধরতে পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিল। শুক্রবার কদমতলীর মুরাদপুর নোয়াখালী পট্টির একটি বাড়ি থেকে এক নারীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- পিয়ারা বেগম, মো. হীরা, মোহাম্মদ রকি খন্দকার, মো. জাহিদুল ইসলাম ও মো. ফয়সাল দেওয়ান রানা। তাদের কাছ থেকে স্বর্ণালংকারের পাশাপাশি নগদ টাকা ও মাদক জব্দ করা হয়।
চক্রটি তাদের প্রতারণার সময় অনেকের কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে নিত। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ৩৫টি শাড়ি উদ্ধার করা হয়।
প্রতারকচক্রটির কৌশল সম্পর্কে সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) শাহ আলম বলেন, চক্রটি প্রথমে একজনকে টার্গেট করে। এরপর তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বিশ্বাস অর্জন করে। এরপরই প্রলোভন দেখিয়ে ভিকটিমের স্বর্ণালংকার বা ব্যাগ লুটে নেয়। তারা হজফেরতদের খবরাখবর নেয়। এরপর তার বাড়ির আশপাশে ‘টার্গেট করা’ ব্যক্তিকে নিয়ে যায়। ভুক্তভোগীদের বলা হয়, হাজিরা জাকাত দিচ্ছে। যাকে তাদের ভাষায় ‘হাজির কামলা’ বলা হয়। প্রলোভনে পড়ে অনেকে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়। করোনার মধ্যে থেকে এ ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে পুলিশ মাঠে নামে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজধানীতে আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ধরন দেখেছি। তবে এটা একদমই নতুন ধরনের অপরাধ। গুলশান, বনানী কিংবা ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় তাদের আনাগোনা চোখে পড়েনি। সদরঘাট, গুলিস্তান, জুরাইন দিয়ে বাস-লঞ্চে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ যাতায়াত করে। তাই এসব এলাকায় চক্রটির একটা অবস্থান রয়েছে। কারণ, নিম্ন আয়ের মানুষদের তারা সহজেই বোকা বানাতে পারে।
কদমতলী থানা সূত্রে জানা যায়, চক্রটিকে (হাজির কামলা) ধরতে পুলিশ বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছিল। শুক্রবার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের হোতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বলেন, তাদের এই অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে অনেকে প্রতারিত হয়েছে। অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত তাদের দুই দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছে।
ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) শাহ ইফতেখার আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘চক্রটি মূলত বাস, লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় প্রতারণা করে। বিশেষ করে যারা একা বা বাচ্চাসহ থাকে তাদেরকে টার্গেট করা হয়। যাদের গলায় দামি স্বর্ণালংকার আছে তাদেরকেও টার্গেট করা হয়। প্রতারণা করার পর তারা অবস্থান পাল্টে ফেলে। এই চক্রকে ধরতে আমরা বেশ কিছুদিন ধরে গোয়েন্দা নজরদারি করছিলাম। কিন্তু তারা হঠাৎ বাসা পরিবর্তন করে ফেলে। তবে শুক্রবার তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এই চক্রে আরও সদস্য থাকতে পারে।’
কারো প্রলোভনে না পড়তে অনুরোধ জানিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অপরিচিত কারো প্রলোভনে অনেকে ফাঁদে পা দেয়। পরে তারা প্রতারণার শিকার হন। এজন্য কারও প্রলোভনে পা দেবেন না।’
(ঢাকাটাইমস/২৩জানুয়ারি/এসএস/জেবি/মোআ)