আমি তন্ময় হয়ে শুনি আর আনন্দাশ্রু লুকাই

নুসরাত সুলতানা লীমা
 | প্রকাশিত : ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:১৫

বছর তিনেক আগে মিনা (ছদ্মনাম) নামের ৪২ বছরের এক রোগী নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আসে আমার চেম্বারে। ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রী নেয়ার এক পর্যায়ে তাকে সন্তান আছে কি না জিজ্ঞাসা করলাম। সাথে সাথে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন মিনা। তার বিয়ে হয়েছে ২১ বছর আগে এক ফার্নিচার ব্যবসায়ীর সাথে। কিন্তু কখনও গর্ভবতী হননি। আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। আমার-ই বা কি করার আছে তার জন্য।

বললেন, কত ডাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু লাভ হয়নি। আমাদের কারও কোনো সমস্যা নেই তবুও বাচ্চা পেটে আসে না। আমি আর আমার স্বামী হাল ছেড়ে দিয়েছি।'

ওনাকে সাহস দেয়ার জন্য বললাম, কি এমন বয়স হয়েছে আপনার? কেন হাল ছাড়বেন?

ম্যাডাম প্রতি মাসে আশা ভঙ্গ হওয়ার কষ্ট কাউকে বোঝানো যায় না।

আমি তাকে পরবর্তী সময়ে আসার সময় সব কাগজপত্র নিয়ে আসতে বললাম। এদিকে ওনার ওজন আর রক্তচাপ দেখে আমার তো চক্ষু চড়ক গাছ। ওজন কমানোর পরামর্শ ও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ নিয়মিত খেতে বললাম তাকে।

পরের দিনই মিনা তার স্বামীসহ সব কাগজপত্র নিয়ে আমার কাছে আসলেন। স্বামী বললেন, ম্যাডাম আমরা বাচ্চা নিতে চাই। আর আপনার অধীনে থাকতে চায় আমার স্ত্রী। আপনার ওপর এমন বিশ্বাস জন্মেছে যে তার ধারণা আপনার চিকিৎসাতেই আমাদের সন্তান হবে।

অনেক বোঝালাম যে মিনার অনেক সমস্যা। আমি একজন জেনারেল প্র্যাক্টিশনার। আমার দ্বারা এর সমাধান হওয়া দুরূহ ব্যাপার। তারা দুজনেই নাছোড়বান্দা। অগত্যা চিকিৎসা শুরু করলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে দুই মাস পরেই মীনার গর্ভে সন্তান এল কিন্তু রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকছে। রেফার করলাম। কিন্তু এই নাছোড়বান্দা রোগী আমাকেই দেখাবে। এমন পরীক্ষায় আর কখনও পড়িনি।

দুদিন পরপর ফোনে খোঁজখবর নেই। রেগুলার চেকআপ তো আছেই। শুধু মনে হয় কখন না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। ওনার ফোন আসলেই বুকটা ঢিপঢিপ করত। মনে হতো এই বুঝি কোনো দুঃসংবাদ শুনবো।

এভাবে পুরো গর্ভাবস্থায় আমাকে অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তার মাঝে রেখে মিনা ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিল। মেয়ের বয়স এখন ২ বছর। মা ও মেয়ে দুইজনই আমার নিয়মিত রোগী। চেম্বারে আসলেই বাচ্চার গল্প করতে থাকে। বাচ্চা এই করে, সেই করে। বাপ ছাড়া কাউকে চিনে না। কান্না করলেই বাপের কাছে ফোন লাগাই। তার আওয়াজ পেলেই সব ঠান্ডা। ওনার এসব বকবক আমি তন্ময় হয়ে শুনি আর আনন্দাশ্রু লুকাই। মিনা যতবারই আমার চেম্বারে আসে, ততবারই আমার মেয়ের জন্য নানা ধরনের খাবার নিয়ে আসে।

কয়েক মাস ধরে কোভিডের জন্য চেম্বার করি না। মিনা নিজের বা সন্তানের জন্য ফোনে পরামর্শ নেয়। কথা শেষ হলে বলে, "ম্যাডাম ভিজিটটা বিকাশে দিয়ে দেই?" আমি এড়িয়ে গিয়ে বলি, "আপনার পরীটার হাতে ফোনটা দিন তো, একটু কথা বলি।”

এই ক্ষুদ্র জীবনে মানুষের আর কি চাওয়ার বা পাওয়ার আছে। অমূল্য রতন প্রাপ্তির উসিলা মনে করে একটা মানুষ যদি আমাকে অন্ধভাবে ভালোবাসে তাহলে আর কি চাই এই নশ্বর জীবনে? সব কিছু ধুয়ে মুছে যাক। শুধু ভালোবাসাটুকু বেঁচে থাক।

লেখক: চিকিৎসিক, সহকারী অধ্যাপক, ভাইরোলজী বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

ঢাকাটাইমস/২৪জানুয়ারি/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :