প্রতিযোগিতা নাকি সহযোগিতা!

প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:০৩ | আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:০৭

জি এম কিবরিয়া
প্রতীকী ছবি

একবার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এক মটিভেশনাল ক্লাসে হুয়াইটবোর্ডে একটি সরলরেখা টেনে শিক্ষার্থীদের বলেছিলাম, এবার আমি এটিকে ছোট করতে চাই। কিন্তু একে কেটে বা মুছে ছোট করা যাবে না। এখন বলো, কীভাবে এই কাজটা করতে পারি?

শিক্ষার্থীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল! অতঃপর সবাই একমত হয়ে বলল, সরলরেখাটিকে একটু মুছে দিলেই ছোট হয়ে যাবে।

আমি তাদের পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, ধর, তুমি এই সরল রেখাটি, তখন? তখন কেউই রেখাটি মুছতে চাইল না! অতপর বললাম, তুমি রেখাটির পাশে যদি একটা বড় সরলরেখা টানো, তাহলে তো ওটা এমনিতেই ছোট হয়ে যায়! সেখানেও বিপত্তি আসলো, আমার পাশে সে বড় হবে কেন! 

এই বিপত্তির মূলে রয়েছে ঈর্ষা। আর ঈর্ষার উৎপত্তি প্রতিযোগিতা থেকে।

প্রতিযোগিতা আসলে কী?

উইকিপিডিয়া অনুযায়ী, প্রতিযোগিতা একটি ঘটনা বিশেষ যেখানে ব্যক্তিগণ কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেরা নির্ধারণকল্পে একে-অপরের সাথে মোকাবিলা করে থাকে। উদ্ভিদ, প্রাণী, ব্যক্তিগত কিংবা দলীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। সাম্রাজ্য দখল, উপযুক্ত স্থান, সম্পদের অবস্থান, মালামাল, ভাবমূর্তি রক্ষা, সম্মাননা, পুরস্কার, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, নেতৃত্ব গ্রহণ ইত্যাদি এর প্রধান কারণ।

আর প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয় তথাকথিত সফলতা থেকে! তথাকথিত সাফল্য হলো, ‘নিজের আধিপত্য বিস্তার করা’। অর্থাৎ তুমিই থাকবে সবার উপরে আর সবাই তোমার নিচে থাকবে। তোমাকে জি হুজুর জি হুজুর করবে’।

এই মরীচিকাময় সফলতার জন্য ব্যক্তি দৌড়াতেই থাকে। আজকাল মা-বাবারা কতই না পরিশ্রম করে! আসলে নিজের হতাশা ও বিফলতাকে ঢাকতে গিয়েই মা-বাবারা এই অপ্রয়োজনীয় পরিশ্রম করে! মূলত তিনি যে যে দিকে ব্যর্থ ছিলেন, সে সে দিকগুলোতে সন্তানকে সফল করতে তিনি ব্যতিব্যস্ত থাকছেন! কী ট্রেস? কী ব্যস্ততা!! একেবারে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়ে লেগে থাকছেন সন্তানের পিছু পিছু! সন্তানের বয়স সাত বছর হতেই তিন চার ক্লাস পড়িয়ে ফেলেন! আদাজল খেয়ে লেগে পড়েন ভালো স্কুলে ভর্তির প্রচেষ্টায়। একবার না পারিলে দ্বিতীয়বার, না হলে তৃতীয়বার! জন্মসনদ পরিবর্তন করে নয় বছর বয়সেও ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে ফেসবুকে গৌরবোজ্জল পোস্ট দিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন, আমার গেদা অমুক স্কুলে...!

আর তখন থেকেই সেই শিশুটি নিজেকে বিশেষ শ্রেণির ভাবতে শুরু করে। বিশেষ শ্রেণি মানে, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ!! Very Important Person (VIP)! তাই লাইন ধরে সেবা গ্রহণতো তার সাথে যায় না! তথা তিনজনের পেছনেও লাইন না ধরে তিনি বিকল্প খুঁজতে ঘুষ দেয়ার পন্থা খুঁজে নেন নতুবা কাউকে ফোন করে লবিং করেন। এভাবেই সমাজে অস্থিরতা দেখা দেয়। সমাজ হয়ে উঠে ধৈর্যহীন। এই ধৈর্যহীন জনতা জ্যামে বসেও হর্ন বাজাতে থাকে অনবরত!  

অতঃপর আমি শিক্ষার্থীদের বলেছিলাম, ধর, একটি প্রক্রিয়া অনুসারে কাজ করলে তোমার কোম্পানির ১০% লাভ হবে, তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিরও ১০% লাভ হবে। অন্য আরেকটি প্রক্রিয়া অনুসারে কাজ করলে তোমার ২০% লাভ হবে, আর তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীর লাভ হবে ৩০%। এখন তুমি কোন প্রক্রিয়া অনুসারে তোমার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে?

বিস্ময়করভাবে তারা উত্তর দিয়েছিল, আমার ২০% লাভের দরকার নেই, তাহলে তো প্রতিদ্বন্দ্বী ৩০% লাভ করবে। তার চেয়ে বরং আমি সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করব যাতে আমার ১০% লাভ হোক এবং অন্য কোম্পানিরও ১০% লাভই থাকবে!

হায়রে প্রতিযোগিতা! অথচ ২০% লাভ হলে তার কোম্পানির সুনাম, সম্পদ বেড়ে যেত। কর্মচারীরাও ভালো থাকতো। ফলে কৌশলগত পরিবর্তন করে একদিন প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকেও বেশি কিছু অর্জন করতে পারতো। কিন্তু বাধা দিচ্ছে কে, ঈর্ষা!

এবার আসুন প্রকৃত সফলতা কি তা জানি। ইউটিউভে ধর্মীয় এক বক্তা বলেছেন, ‘চিল্লাইয়া মার্কেট পাওন যাইবো না’! কথাটির সাথে মিল রেখেই বলছি, প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে কেউ সফল হতে চাইলেও তিনি সফল হতে পারবেন না। সফলতার জন্য পরিশ্রম দরকার। তবে শুধু পরিশ্রম করে কেউ সফলতার সৌধে উঠেছেন তার নজির নেই! এর জন্য প্রয়োজন সঠিক চিন্তা, সঠিক সিদ্ধান্ত ও সঠিক সময়ে সঠিক পরিশ্র্র্রম।

সফল হওয়ার অর্থ যদি সাম্রাজ্য দখল, সম্পদ অহরণ, নিজের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি, সম্মাননা, পুরস্কার, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, নেতৃত্ব গ্রহণ ইত্যাদি হয়ে থাকে তবে তা সফলতা নয়, তা হবে অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

প্রকৃত সফলতা হলো, বৃক্ষের মতো ফুলে ফলে জীবনের পূর্ণ বিকাশ ঘটানো। অর্থাৎ জীবনকে নিজের স্বরূপে দেখার নামই সফলতা। যেখানে জীবনের পরতে পরতে থাকবে আনন্দ আর ভালোবাসা। মানুষ যেদিন আপনাকে সফল হিসেবে দেখবে, সেদিনই আপনি সফল।

প্রতিযোগিতার বিপরীত একটি শব্দ আছে তা হলো ‘সহযোগিতা’। পাঁচটি অক্ষরের কাছাকাছি এই দুটো শব্দ, কিন্তু শব্দার্থে পার্থক্য লক্ষ যোজন। প্রথমটায় অস্থিরতা, স্ট্রেস, অশান্তি আর ব্যর্থতা; দ্বিতীয়টায় সুখ, শান্তি, আর সাফল্য।

কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘গণিত অলিম্পিয়াডকে আমরা কোনোভাবেই শুধু একটা প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখতে চাইনি। তাই অনেক ভেবে চিন্তে আমরা নাম দিয়েছিলাম গণিত উৎসব। যেখানে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় মাত্র অল্প কয়জন কিন্তু উৎসবে যোগ দেয় সবাই।’

এরকম সুস্থ প্রতিযোগিতায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেরও জুড়ি নেই, তাদের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে হাজির থাকে এবং সবাই পুরস্কার পায়। তাই সেখানে সবার মাঝে থাকে উচ্ছ্বাস, কিন্তু থাকে না পরাজিত হওয়ার গ্লানি!

ছাত্রজীবনে, পেশাজীবনে এমনকি সংসার জীবনেও প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আমরা নিজেদের সাফল্যকেই বাধাগ্রস্ত করি। সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করি। যেহেতু আমি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী, তাই আমি গুরুত্বপূর্ণ। কলিং বেল দিয়েই অধৈর্য হয়ে পড়ি, কেন তাড়াতাড়ি দরজা খোল্লনা! দরজা থেকেই সংসারে অশান্তি সূচনা হয়ে গেল! এভাবেই চলতে থাকে শারীরিক-মানসিক ক্ষিপ্রতা, অস্থিরতা কিংবা অবসাদ।

প্রতিযোগীতা একজন মানুষকে মানসিক স্ট্রেসের নির্মম জালে বন্দি করে রাখে-বন্ধু আমার চেয়ে এগিয়ে গেল, প্রতিবেশী আমার চেয়ে এগিয়ে গেল, সহপাঠী আমার চেয়ে এগিয়ে গেল, সহকর্মী আমার চেয়ে এগিয়ে গেল। আমি যে পিছিয়ে রইলাম!

এসব সার্বক্ষণিক স্ট্রেস প্রকারান্তরে নানা রকম সাইকো-সোমাটিক রোগ ও বিশেষত করোনারি হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। আমরা জানি, স্ট্রেস মানবদেহের সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে উদ্দীপ্ত করে। এড্রেনাল গ্ল্যান্ড থেকে কর্টিসোল হরমোনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয় যা স্ট্রেস হরমোন নামে পরিচিত। ফলে করোনারি ধমনী সংকুচিত হয়, স্বভাবতই রক্তপ্রবাহ কমে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের দুজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. মেয়ার ফ্রেডম্যান ও রে রোজেনম্যান তাদের যৌথ গবেষণায় দেখান হৃদরোগের সাথে অস্থিরতা, বিদ্বেষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভুল জীবনাচরণের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। এ-ছাড়াও প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে সৃষ্ট স্ট্রেস শরীরে বিষাণু বা টক্সিন সৃষ্টি করে, যা শরীরের রোগ-প্রতিরোগ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। তাছাড়া প্রতিনিয়ত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আচরণ নার্ভাস সিস্টেমকে দুর্বল করে এবং শরীর-মনকে করে তোলে অবসন্ন ও অবসাদগ্রস্ত। কাজে গতি কমে যায়। কোনো কাজে মনোযোগ থাকে না। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি। বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়ে।

এ প্রসঙ্গে মহানবী সা. বলেছেন, ‘নিজের জন্যে যা আকাঙ্ক্ষা করো অন্যের জন্যেও তা-ই আকাঙ্ক্ষা করো। তাহলেই তুমি প্রকৃত বিশ্বাসী হতে পারবে।’

তাই আমি সেদিন বলেছিলাম, কাউকে কোনোদিন কোনোভাবে মুছে ছোট করতে যেও না। কারো কীর্তিকে ছোট করতে যেও না। তাকে বরং সাহায্য করো এই বলে যে, তুমি আরো বড় হও। তবেই তুমি বড় হবে।

তরুণদের প্রচেষ্টা থাকবে যে, তোমরা নিজের গুণগুলোকে বিকশিত করে আরও বড় হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে বড় হবে। সংগীতে বড় হবে। সাহিত্যে বড় হবে। শিল্পে বড় হবে। বাণিজ্যে বড় হবে। খেলাধুলায় বড় হবে। কিন্তু কাউকে কখনো ছোট করবে না। এটাই সত্যিকারের প্রতিযোগিতা। তাহলেই তোমাদের জীবন সার্থক হয়ে উঠবে।

প্রতিযোগিতা কিন্তু সর্বক্ষেত্রে আগ্রাসী নয়, সে প্রতিযোগিতা হবে নিজের সাথে নিজের। এ প্রতিযোগিতা হোক আজকের ‘আমি’র সাথে আগামীকালের ‘আমি’র। আর অন্যের সাথে থাকবে ‘সহযোগিতা।’ আসলে নিজের ভেতর থেকে প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও ঈর্ষার বিষ সমূলে উৎপাটনের শেষ দৃশ্যেই রয়েছে সফলতা। মনে রাখতে হবে, সফল মানুষ প্রতিযোগিতা করে না, সহযোগিতা করে।

লেখক: জি এম কিবরিয়া,

ক্লিন গ্রিন বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী