প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত মিশন-ভিশন অর্জন

প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের বিকল্প নেই

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
 | প্রকাশিত : ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:১৬

আবহমানকাল ধরে আমাদের গ্রামবাংলার লোকজ সংস্কৃতি বিশ্বের কাছে এক অনন্য পরিচয় বহন করে এসেছে। একান্ত স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল হিসেবে আমাদের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোনো ভূখণ্ডে নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে আমাদের সমাজ সাংস্কৃতিক চর্চায় ধীরে ধীরে অনাগ্রহ সত্তায় পরিণত হচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি ছিল প্রশংসা করার মতো। গ্রামেগঞ্জে কিংবা শহরে একসময় জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, কবিগান, যাত্রাপালা নানা রকমের সাংস্কৃতিক চর্চায় ভরপুর ছিল। গুনটানা মাঝিমাল্লা এমনকি সাধারণ মানুষ শারীরিক পরিশ্রমকে কোনোভাবেই মনে দাগ কাটতে দিত না। কখনো গলা ছেড়ে, কখনো গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে তারা পরিশ্রমসাধ্য সময়টুকু পার করে দিত খুব সহজে। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি কৃষককে দমাতে পারত না, তারাও জারি-সারি বিভিন্ন রকম গান করে সময়টা কাটাত। এমনকি সন্ধ্যার পর অনেকেই গল্প করে, গান গেয়ে, পুঁথি পাঠ করে আনন্দের মাঝে জীবনকে উপভোগ করত।

প্রশাসন নয় বরং প্রতিটি সমাজ তার নিজস্ব ভলেন্টিয়ার্স দিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ খুব নিরাপদে করে আসছিল পরম্পরায়। বড় পরিসরের কোনো আসরের জন্য প্রশাসনকে অবহিত করার প্রয়োজন হতো। মাসব্যাপী যাত্রা, সার্কাস কিংবা মেলা পরিচালিত হতো স্বাভাবিকভাবেই। এ ক্ষেত্রে গ্রামীণ আনসার সদস্যদের শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে দেখা যেত। কিন্তু আজকের দিনে এসে পারিবারিক বলয়ে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেও প্রশাসনের সহযোগিতা ও অনুমতির প্রয়োজন নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।

দেশের জন্মলগ্নে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম বিপুল কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। যেমন মুক্তিকামী মানুষকে প্রেরণা দিতে, তাঁদের মনোবল চাঙ্গা করতে এবং শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়াই করে যাবার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ধারার গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ভূমিকা নিয়ে আমরা কমবেশি সবাই জানি। সেই সাথে বাউল আব্দুল করিমদের মতো অনেকেই একতারা-দোতারা হাতে গান করে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনুপ্রাণিত করেছেন। পূজা-পার্বণ থেকে শুরু করে যেকোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কীর্তন, শ্যামাসংগীত এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের আয়োজন চলত নির্বিঘ্নে। দেশের সমস্ত কর্নার থেকে শুরু করে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকেও কিছু কিছু দল আসতো এসব আসরে গান করতে। শাহ আব্দুল করিম, হাছন রাজা, লালন সাঁইজির অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি মানুষের আগমন ঘটত। এসব আসর নিয়মিত প্রতিবছরই করা হতো। প্রশাসনের কিছু নজরদারি পরিলক্ষিত হলেও বস্তুত অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নিজস্ব ভলেন্টিয়ার্সরাই নিরাপত্তার কাজটি করত। সেসময় খুব বেশি বিশৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য কোনো নজির ইতিহাসে নেই।

গ্রামের সুন্নতে খাতনা কিংবা বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে গান-বাজনা হতো। স্কুল-কলেজগুলোর নবীনবরণ ছাড়াও নানা জাতীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রাধান্য ছিল লক্ষ করার মতো। যেকোনো দলের রাজনৈতিক অনুষ্ঠানগুলোর উদ্বোধনী কিংবা সমাপনীতে গান-বাজনার আয়োজন করা হতো। স্কুল-কলেজগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক সমবেত হয়ে গল্প বলা, নাটক মঞ্চস্থ করা, গানের অনুষ্ঠান করা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা করা ইত্যাদি সহশিক্ষা হিসেবে খুবই কার্যকর ছিল। বিশ-পঁচিশ বছর আগেও ছাত্রছাত্রীদের কাছে সিলেবাসভুক্ত শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষা হিসেবে খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল খুবই জনপ্রিয়। মানুষের মধ্যে দেশাত্মবোধ তথা দেশপ্রেম অনেক বেশি কার্যকরী থাকায় সে সময়গুলোতে এসব অনুষ্ঠান করার প্রয়োজনে খুব বেশি প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়নি। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছোটখাটো যেকোনো ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রশাসনের পূর্ববর্তী অনুমতি নেয়া একটি বাধ্যতামূলক চর্চায় পরিণত হয়েছে।

অন্তর্নিহিত কারণ যা-ই থাকুক না কেন, সম্ভবত নিরাপত্তাজনিত ভীতি একটি বড় কারণ বলে এসব ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অনুমতির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সমাজের অপশক্তি, সাম্প্রদায়িক শক্তির ভয়ে ভীত হয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চার সবকিছুতেই ধীরে ধীরে প্রশাসনিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা কিংবা অনিয়মের দায় নিরূপণে প্রায় সব ক্ষেত্রেই সামাজিক অভিব্যক্তিতেও প্রশাসনকেই দায়ী করার প্রবণতা বেড়ে গেছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সমাজও ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছে সাম্প্রদায়িক ভীতির খপ্পরে পড়ে। ফলে এক ধরনের ভয় কিংবা আশঙ্কার কারণে আগের মতো অহরহ যেখানে-সেখানে, যেমন-তেমন করেও মনের আনন্দে বিনোদন উৎসব করা সম্ভব হয় না। এমনকি জাতীয় পর্যায়ের অনেক উৎসবকে সন্ধ্যার মধ্যে সম্পন্ন করার তাগিদ আমরা দেখতে পাই।

কেন এবং কখন থেকে এমন ভীতিকর অবস্থা আমাদের পেয়ে বসেছে, প্রসঙ্গক্রমে সে আলোচনা করা যেতেই পারে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির অনুসারী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির যখন থেকে পরিকল্পনা শুরু করেছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের আধিপত্য বাড়াতে হবে, তখন থেকেই এই অবনমন শুরু হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে তাদের এজেন্ট প্রবেশ করানো এবং সোর্স তৈরির কাজটিতে তারা গুরুত্ব দেয়া শুরু করে। রাজনৈতিকভাবে তাদের সমর্থক, কর্মীরা তাদের সাথী ও সদস্যদের সব নির্দেশনা অনুসরণ করত স্ট্রেট লাইন অর্গানাইজেশনের মতো। আর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃতি ও ভবিষ্যৎ দখলীকরণ কাজে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের টার্গেট করে আশ্রয় এবং অ্যাটাক উভয় কাজে লাগানোর প্রয়াস নেয়।

এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সমাজের সর্বব্যাপী বিস্তার লাভ করে তারা সমাজের সব স্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তাদের সমর্থিত জোটবদ্ধ সরকারের সময়ে তাদের ব্যাপ্তি ও ভিত্তি পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছে। অতঃপর, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রচলিত কিছু সাংস্কৃতিক প্রথা রেগ-ডে, পয়লা বৈশাখ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা তৈরি করে জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে।

রমনার বটমূলে বোমা হামলা, কিংবা সিনেমা হলে বোমা হামলার ঘটনায় বাংলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধচারীরা এই ভয়াল প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। ফলে একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, যেকোনো ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে গানবাজনা করার বিরোধিতা করে অহরহ কিছু মানুষ কথা বলে যাচ্ছে। যেটা সমাজের সর্বত্র এতটা প্রকট আকারে আগে কখনো দেখা যায়নি।

প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক, বাহক ও সঞ্চালক হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালনে ব্রত। তাই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সামাজিকভাবে রুখে দেওয়াটা বর্তমান সময়ে খুব একটা কঠিন কাজ বলে মনে হয় না। কেননা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি প্রতিটি গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং সমমনা সাধারণ জনতা মিলে ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসনিক সহযোগিতা ব্যবহার করে সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো নির্বিঘ্নে করা কোনো কঠিন কাজ হবে না। ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের কর্মী-সমর্থক-নেতাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে নিরাপত্তা শঙ্কা থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক হুমকিকে মোকাবেলা করা সম্ভব।

আর মাথায় রাখা দরকার, এসব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে লটারি, জুয়া ও অশ্লীলতা জাতীয় নেতিবাচক বিষয়গুলো থেকে সবাইকে দূরে রাখতে হবে। তাহলে অন্তত এ সরকারের আমলে গায়ের জোরে কোনো গোষ্ঠী কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল এ জাতীয় আসর বসিয়ে নেতিবাচক কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপানোর সুযোগ পাবে না। সেই সাথে সাধারণ মানুষের মধ্যেও কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। এতটুকু স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে যেকোনো ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এলাকার সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পাওয়া যাবে বলেই বিশ্বাস করি।

বর্তমানে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং অন্যান্য জনপ্রতিনিধি যারা আছেন, তাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মী। আমি বিশ্বাস করতে চাই, প্রশাসনিক সহযোগিতার বাইরে এ-জাতীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা করা এবং তাকে বিকশিত করতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মীরা দেশপ্রেম এবং সমাজসেবায় নিবেদিত হলে তথাকথিত জুজুর ভয় সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

সুস্থ, স্বাভাবিক, সুন্দর সামাজিক জীবনযাপনের জন্য খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক বিনোদনের কোনো বিকল্প নেই। সমাজে সুস্থধারার সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে সুনাগরিক তৈরি করা যেমন সম্ভব, তেমনি কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িক অন্ধকার দূর করাও সম্ভব। মনে রাখতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যখন রাজনৈতিক চর্চা বন্ধ রাখা হয় কোনো কারণে, তখন শুধু প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার রাজনীতির চর্চাই বন্ধ থাকে মাত্র। বিপরীতে সাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতি যেহেতু ধর্মাশ্রয়ী চরিত্র নিয়ে মানুষের সামনে উপস্থাপিত হয়, কাজেই এসব ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চর্চা দুর্বার গতিতে বিনা বাধায় বিস্তার লাভ করে থাকে। তেমনি করে সুস্থধারার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চর্চা সমাজে যত কমতে থাকে প্রগতিশীল মানুষের জীবনযাত্রা তত বেশি বাধাগ্রস্ত হতে থাকে, বিপদের সম্মুখীন হতে থাকে, সমাজে অস্থিরতা বাড়তে থাকে, যুব সমাজের অবক্ষয় শুরু হতে থাকে, সর্বোপরি সমাজ তার বাসযোগ্যতা হারিয়ে অসারে পরিণত হয়। এই অসারতার অন্ধকার প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য অবারিত সম্ভাবনা তৈরি করে।

পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমানে আমরা যে সামাজিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হাঁটছি, আমাদের সামনের যাত্রা মসৃণ করতে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে টেকসই করতে এবং এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে সমাজকে এখনই প্রস্তুত করা জরুরি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত লক্ষ্য, মিশন এবং ভিশন অর্জনে দেশজুড়ে প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :