সাধারণ মানুষের ব্যাংক হতে পুঁজিবাজারে আসছে এনআরবিসি ব্যাংক

প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ২০:১২ | আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ২০:৩৫

রহমান আজিজ

পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি সত্যিকার অর্থে সাধারণ মানুষের ব্যাংক হওয়া, সুশাসন নিশ্চিত করাসহ নানা ইতিবাচক সুবিধার জন্য এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক পুঁজিবাজারে আসছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল। তিনি  বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে অনেক মানুষ এই ব্যাংকের অংশীদার হবে, অনেক লোক এর সঙ্গে সংযুক্ত হবে। 

তিনি বলেন, ব্যাংক আসলে জনগণের। এখানে ৯০ শতাংশ টাকাই জনগণের। তাই সত্যিকার অর্থে ব্যাংকের মালিকানা হবে জনগণেরই। একদিকে আমানত, অন্যদিকে মালিকানা। দুইয়ের মেলবন্ধনে ভালো কিছু র্অজনের পথ সুগম করে দেয়। কমপ্লায়েন্স বাড়ে, কর্পোরেট গভর্নেন্স বাড়ে। এর বাইরে পুঁজিবাজারের সদস্য হওয়ার ফলে একটা রেগুলেটর আসছে- সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি নতুন রেগুলেটর হবে। এতে তাদের কর্পোরেট গভর্নেন্স বাড়বে বলে মনে করেন এস এম পারভেজ তমাল। এ ছাড়া ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রধান যে উদ্দেশ্য প্রবাসীদের নিয়ে, সেটি তো রয়েছেই। 

সম্প্রতি ঢাকা টাইমসসের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানান এস এম পারভেজ তমাল। তিনি বলেন, ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে স্বাভাবিক নিয়মে পুঁজিবাজারে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পাশাপাশি আমরা একটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া আমরা প্রবাসীদেরও ব্যাংক। সবকিছু মিলে পুঁজিবাজারে যাওয়া আমাদের উচিত ছিল আরও আগে। তবে, আশার কথা হলো আমরা পুঁজাবাজারে আসছি।

পুঁজিবাজারে যাওয়ার জন্য ২০১৮ সালের শেষের দিকে বিএসএসইতে আবেদন করে এনআরবিসি ব্যাংক। পরের বছর ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পাওয়া যায়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২০-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। আগামী ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকটি  বাজারে আসছে। আইপিও আবেদন শুরু হবে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি।
বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হচ্ছে, আর্থিক-সামাজিক কাঠামোর যে পরিবর্তন হচ্ছে, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে, তার সঙ্গে এনআরবিসি ব্যাংক সংশ্লিষ্ট থাকতে চায় বলে জানান এস এম পারভেজ তমাল। বলেন, ‘আমাদের নতুন সব চিন্তাভাবনা নিয়ে এগোচ্ছি। গ্রাম থেকে শহর। নিচের দিকে বেশি বেশি সরকারের কালেকশনের সঙ্গে জড়িত হওয়া, গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আমাদের অবদান থাকবে, এটা আমরা চাই। নিচের দিকের লোকজনকে ক্ষুদ্রঋণ ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করে আমরা চাই বেশি বেশি মানুষের কর্মসংস্থান যেন হয়। আমরা মানুষের উন্নয়নের সাথে খুব বেশি জড়িত হতে চাই। এটাই হলো আমাদের মূল উদ্দেশ্য।’
৪৪৬ কোটি কোটি টাকার মূলধন দিয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের পথচলা শুরু হয়। ব্যাংকের আজকের মূলধন ৫৭১ কোটি টাকা। এস এম পারভেজ তমাল বলেন, ‘এই মূলধন নিয়ে একটি নতুন কোম্পানি লিস্টেড হলে, যখন আমরা আবেদন করি তখন মার্কেটে যে অবস্থা ছিল, সেটার জন্য আসলে মার্কেটে চাপ পড়ে যেত। সেটা নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা ছিল। তবে এই মুহূর্তে মার্কেট কিন্তু খুব সচেতন। নতুন ইনভেস্টমেন্ট ঢুকছে। নতুন ইনভেস্টমেন্টের সম্ভাবনা জাগছে। অনেক কোম্পানি ভালো করছে। মার্কেট ঊর্ধ্বগতিতে আছে, তেজি ভাব আছে। সবকিছু মিলিয়ে এখন পুঁজিবাজারে যাওয়াটা উপযুক্ত সময়।’
এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের আইপিওর যে ১২০ কোটি টাকা- এই টাকাটা আসলে আমাদের ব্যাংকের জন্য খুব বড় অঙ্ক নয়। কারণ আমরা ১০ হাজার কোটি টাকার ডিপোজিট বা আমানত নিয়ে কাজ করি। সেখানে এই ১২০ কোটি টাকার কিছু আইপিও খরচের জন্য ব্যবহার করব। আর বাকি টাকাটা নিচের দিকের ব্যাংকিংয়ে দিতে চাচ্ছি। মাইক্রো ক্রেডিট এবং রিটেইল ব্যাংকিংয়ে ইনভেস্টমেন্ট হবে। সেই ইনভেস্টমেন্টগুলো হবে সুদূরপ্রসারী এবং কাঠামোগত। আমরা বলতে চাচ্ছি যে আমাদের ব্যাংক অনেক লোককে লোন দিবে। এ রকম না যে আমরা একজন কাস্টমারকে বা অল্প সংখ্যক কাস্টমারের জন্য কাজ করছি।’ 
‘আমরা এখন ৪০০ লোকেশনের মধ্যে আছি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ লোকেশন হলো গ্রাম। তো আমরা এই গ্রামের মানুষের নতুন নতুন উদ্যোক্তা, মাইক্রো ক্রেডিট এবং সিএমএসএমই সেক্টরে আমরা থাকার চেষ্টা করব। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে শর্ট টাইম আমানত নিয়ে লং টাইম ইনভেস্টমেন্ট করছি। এটি মিস ম্যাচ। এটা কিন্তু পুরো ব্যাংকের দায়িত্ব না। ব্যাংকের দায়িত্ব আমাদের যেরকম ইনভেস্টমেন্ট আছে শর্ট টাইম ইনভেস্টমেন্ট করা। সারা পৃথিবীতে সব ব্যাংক শর্ট টাইম ইনভেস্টমেন্ট হয়। লং টাইম ইনভেস্টমেন্টের জন্য ক্যাপিটাল মার্কেট ইজ দ্য মেইন। এখানেই কিন্তু সোর্সিং হওয়া উচিত।’ 
পারভেজ তমাল বলেন, ‘পদ্মা সেতু করে আমরা প্রথম সাহস সঞ্চয় করছি। আজকে তার সুবাদে আমরা কথা বলছি যে আমরা ঐদিকে যাব, সারা পৃথিবীর স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করব। আমি মনে করি বেসরকারি বিনিয়োগ দিয়ে ব্যাংকের কাজ হলো এমন জায়গায় ইনভেস্টমেন্ট করা, যেখানে রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্টের চিন্তা থাকবে। ব্যাংক কিন্তু পুরোপুরি বিজনেস প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি ব্যাংকের দায়বদ্ধতা আছে। সার্ভিস সেন্টার, সার্ভিস পয়েন্ট। এর পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা। আবার অনেক কর্মসংস্থান তৈরি করা। এই কাজটার সাথে ব্যাংক বিভিন্নভাবে যে ধরনের ফাইন্যান্স দরকার সেই ফাইন্যান্স সাথে থাকা। যেমন ধরুন, আমাদের আইটি সেক্টরে সেই ধরনের ফাইন্যান্স হচ্ছে না। সেখানে কিন্তু ব্যাংকও সেভাবে কাজ করছে না। এটা কিন্তু একটা সম্ভাবনাময় সেক্টর। এসব জায়গায় ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে।

 

সারা বিশ^ কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। এর মধ্যেই সরকারের প্রচেষ্টা ছিল অর্থনীতির চাকা সচল রাখা। এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের দেশের রপ্তানি খাতে কিন্তু বিশাল একটা ধস এসেছে। সেখানে একটা রিস্কও তৈরি হচ্ছে। সরকার এখানে  বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে এগিয়ে এসে। নিচের দিকের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। আমরা কিন্তু বেশি দিন লকডাউনে ছিলাম না। সরকারের এই সাহসিকতায় এবং চ্যালেঞ্জের কারণে আমরা বেসরকারি ব্যাংকগুলো সম্মুখযোদ্ধার মতো কাজ করেছি। নিচের লেভেলে আমাদের পুরোপুরি ইনভেস্টমেন্ট ছিল। প্রণোদনা প্যাকেজ যতখানি সম্ভব হয়েছে ততখানি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এর বাইরে এনজিওর ভূমিকা ছিল অসামান্য। অবশ্যই তাদের ভূমিকার প্রশংসা করার মতো। এই কারণে নিচের দিকের অর্থনীতি সচল থাকায় উপরের অর্থনীতি সচল হয়েছে। তার বাইরে সরকারের ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল বড় বড় প্রজেক্টের কাজগুলো স্থবির হয়নি। সব কটি মিলিয়েই এই প্রভাবটা এসেছে।’ 

 
কোভিডের মধ্যেও যে জিডিপির গ্রোথটা রয়েছে, এটা আরো সাহস দেবে এবং ভবিষ্যতে যে চ্যালেঞ্জ আছে আট-নয় শতাংশ অর্জন করা, এখান থেকেই আসবে বলে মনে করেন এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। বলেন, ‘কোভিডকালে এ রকম একটা ঊর্ধ্বগতি আছে, জিডিপি বাড়ছে। এটার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমার মনে হয় ২০২১-২০২২ সালে  আমরা আরও ভালো করতে পারব।’
পারভেজ তমাল বলেন, ‘আমাদের প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ বা তারও বেশি। তার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া- এসব দেশের প্রবাসীদের সংখ্যাটাই প্রধান। তো এখানে দেখবেন যে আজকে সেখানে বিভিন্ন ব্যাংকের সাথে অনেকগুলো রেমিট্যান্স হাউজ কাজ করছে। আমরা তাদের সাথে কাজ করছি। আমরা সেমিনার করে বুঝাচ্ছি যে তাদের সরাসরি ব্যাংকিং চ্যালেঞ্জের মধ্যে আসা উচিত। এটার প্রভাব কিন্তু কোভিডের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে। কোভিডের মধ্যে যে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি, এটা কিন্তু সঠিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসার জন্যই হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের দুই শতাংশ প্রণোদনার অবদান আছে। সেটি মুখ্য ভূমিকাও রাখছে। এখন আমাদের দরকার হলো তাদের মধ্যে বিষয়গুলো সহজ করে দেওয়া। যেন তাদের রেমিট্যান্স আসার পথ সহজ হয়। অল্প খরচে যেন রেমিট্যান্স আসে। এই দুইটা কাজ এখন করতে হবে।’ 

‘আমরা ব্যাংকগুলো যে কাজটা করছি, প্রথমত বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ইকেওয়াইএসে প্রবাসীদের অ্যাকাউন্ট করা। এই অ্যাকাউন্ট সচল রাখার ব্যাপারে কথা চলছে। ইকেওয়াইসে ইতিমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক ইমপ্লিমেন্ট করছে। তার মধ্যে আমরা একটা। এটার মধ্য দিয়ে প্রবাসীদের সব অ্যাকাউন্ট করা যাবে বাইরে থেকে। দ্বিতীয়ত আমরা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি তার সঙ্গে তারা সাধারণ টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে অ্যাকাউন্ট করতে পারবে, কীভাবে চালাবে, এটার সঙ্গে কীভাবে ব্যাংকগুলো যুক্ত হবে- এসব ক্যাম্পেইন করা। এর পাশাপাশি আমরা সরকারের সঙ্গে নতুন করে কথা বলছি। সরকারও বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রবাসীদের ইনভেস্টমেন্ট ক্যাপিটাল মার্কেটে একটা সঠিক চ্যানেলে না এলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর দেশের ইনভেস্টমেন্টের যে পরিবেশ আছে, সেটাও আমরা প্রবাসীদের বোঝাচ্ছি। আমাদের এখানে  ইনভেস্টমেন্ট ক্যাপাসিটি আছে।’ 
পারভেজ তমাল বলেন, ‘ব্যাংক কিন্তু একটা সার্ভিস সেন্টার। এটা মানুষের বিভিন্ন সমস্যা থেকে বের হয়ে আসারও কিন্তু একটা জায়গা। তো এই জিনিসগুলো আমাদের মাথায় আছে। আমাদের ব্যাংকের লাভের ১০ শতাংশ কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিতে খরচ করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন আমাদের ব্যাংক অনুমোদন দেয়, তখনই এটা বাধ্যতামূলক করা হয়। এই ১০ শতাংশ দিয়ে আমরা চেষ্টা করি মানুষের পাশে দাঁড়াতে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুই ক্ষেত্রেই। এ ছাড়া  বাংলাদেশে বিভিন্ন রকম দুর্যোগ আসে। সেখানেও দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। কোভিডের মধ্যেও আমাদের কার্যক্রম ছিল। ডাক্তার বা সম্মুখযোদ্ধা, পুলিশ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি আমরা।’  

অনুলিখন: শেখ সাইফ।  

(ঢাকাটাইমস/২৪জানুয়ারি/মোআ)