​স্বপ্নগুলো ঘরে তুলি

তৌহিদ এলাহী
| আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:১৪ | প্রকাশিত : ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:১০

এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। একদিনে প্রায় ৬৬০০০ পরিবারকে ঘর করে দেয়া? তাও সাদামাটা টিনের বেড়া দেয়া কাঁচা ঘর নয়, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত রান্নাঘর, এটাচড বাথরুমসহ দুটি ব্যবহারযোগ্য রুম। সামনে প্রশস্ত বারান্দা, উপরে রঙিন ঢেউটিন, রয়েছে পর্যাপ্ত জানালা-দরজা। আর সবমিলিয়ে ২ শতাংশ সরকারি খাসজমি ঘরের সাথে কবুলিয়ত দলিল করে দেয়া।

আপনি কি খুব কঠিন হৃদয়ের কেউ? অন্যের সুখ আর ভালোলাগা আপনার চোখে আনন্দাশ্রু এনেছিল কখনো? আসুন আমার কাছে, আমি কয়েকজন উপকারভোগীর কাছে নিয়ে যাব। আপনার কিছু করতে হবে না, শুধু ঘর নিয়ে দু-একটা কথা তাদের জিজ্ঞেস করবেন, বাকিটা ম্যাজিক। তাদের স্ফুর্তি আর আবেগ দেখে কখন আপনার দু চোখ ছলছল করবে আপনি বুঝতেও পারবেন না। এদের সাথে একান্তে কথা বলতে গেলে আমি সানগ্লাস ব্যবহার করি। অন্যের সামনে চোখ মুছতে আমার লজ্জা লাগে।

দেশের প্রত্যন্ত দূরের ছোট্ট একটি উপজেলায় কাজ করি, জনসংখ্যা এক লাখের কিছু বেশি। তিন ধাপে (২২০+১০০+৫০=) ৩৭০-এর বেশি ঘরের বরাদ্দ আলফাডাঙ্গার জন্য এনে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক স্যার। এর মধ্যে প্রথম ধাপের ঘরগুলোর কাজ বেশিরভাগ শেষ। প্রতি ঘরের জন্য বরাদ্দ এক লাখ পঁচাত্তর হাজার টাকা।

টাকার অঙ্ক আর ঘরের বর্ণনা শুনে আপনার কি অনুভূতি হয়েছে জানি না, ইউনিভার্সিটির ক্লাসে বা ট্রেনিংয়ের পড়ায় যতটুকু প্রজেক্ট, অপারেশন ও সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট যা শিখেছি, তার চেয়ে দশ গুণ শিক্ষা দিয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের কাজ। সঠিক উপকারভোগী যাচাই ও প্রকল্পের জন্য ঘর করার উপযোগী উঁচু খাসজমি বের করা সবচেয়ে কঠিনতম অংশ। দেশের খাসজমি যারা বেদখল করে খায়, তারা আর যাই হোক নিরীহ কেউ না। এক ইঞ্চি জমি বের করতে মাথার ১০০ চুল পড়ে যাবে। মামলা-হামলা, হুমকি-ধামকি, পত্রিকায় রিপোর্ট করানো, দখলদারদের যার যে ক্ষমতা আছে সবগুলো ব্রহ্মাস্ত্রই তারা প্রয়োগ করেছে ইউএনও ও এসিল্যান্ডদের বিরুদ্ধে। আবার যেহেতু ঘর করা হবে সরকারি খাসজমিতে, তাই সে জায়গায় বসবাস করতে ইচ্ছুক অসহায়, দরিদ্র, ভিক্ষুক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা নিম্নআয়ের মানুষ খুঁজে বের করতে নিজেকেই যেতে হয়েছে বাড়ি বাড়ি। একটু ঢিল দিলেই কখন নাম লিস্টে ঢুকানোর কথা বলে টাকা-পয়সার চালাচালি করে দেবে বুঝতেই পারবেন না। আর খরচ সাশ্রয়ের জন্য যত ধরনের বিজনেস ও কমিউনিকেশন সেন্স কাজে লাগানো যায়, সবগুলো প্রয়োগ না করলে ভালো উপকরণ দিয়ে মানসম্পন্ন ঘর করা অসম্ভব।

নিজের অভিজ্ঞতায় বলি, টাকা পাওয়ার সাথে সাথে ইটভাটার মালিক, সিমেন্ট-বালি আর টিনের ডিলারদের ডেকে নিয়ে অগ্রিম পুরো টাকা হাতে তুলে দিয়ে বলেছি, যান নিয়ে যান- জিনিসগুলো সময়মতো পৌঁছিয়ে দেবেন। তারা সেভাবে লাভ হয়তো করতে পারেনি, আশ্রয়ণ প্রকল্পের নাম শুনে নিজে থেকেই কিছু দাম কম নিয়েছে এবং অগ্রিম টাকা নেয়ার কারণে তাদের অনেকটা পুষিয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞ অর্থনীতির দৃষ্টিতে দেখলেও, করোনা-পরবর্তী স্তিমিত অর্থনীতির জন্য বিরাট এক আশীর্বাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের এ ঘরগুলো। কেইনেসিয়ান ইকোনমিক্সের তত্ত্বানুসারে, বাজারে টাকা বা মুদ্রার ফলপ্রসূ কন্ট্রিবিউশন মাপার জন্য দেখা হয় মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্টকে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাপানো এক টাকা সরকারি খরচের মাধ্যমে কতজনের হাতবদল হয়ে ঘুরতে থাকবে, যত বেশি হাতবদল হবে অর্থনীতি তত বেশি গতিশীল হবে। মানুষের হাতে টাকা যাবে, খরচ হবে, আরেকজন পাবে-এভাবেই অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।

উপজেলা পর্যায়ের এ ঘরগুলো তৈরির জন্য সরাসরি টাকা উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।তাই স্থানীয়ভাবেই ব্যয়ের জন্য মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট কাজ করেছে অনেকগুণ বেশি। প্রতিটি ঘরের জন্য ইট, বালু, টিন, কাঠ, দরজা-জানালা, বাথরুম প্ল্যান, স্লাব, রড, মাটি, নাটবল্টু ইত্যাদির সাপ্লাই চেইন ও ঘর নির্মাণের জন্য লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। প্রদত্ত টাকার কমবেশি দু-তৃতীয়াংশ চলে গেছে বিভিন্ন নিম্ন আয়ের ফ্যাক্টরি শ্রমিক, দিনমজুর বা মিস্ত্রি পেশার লোকজনের হাতে। এরা যা পায় তা দিয়ে চালু রেখেছে গ্রামের চাল, ডাল, কাপড় ও নাম অজানা কত শত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও কৃষকের জীবন। এভাবেই টাকা ফ্লাই করছে, মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট কাজ করছে, ঘরগুলো হয়ে উঠেছে করোনা-পরবর্তী গ্রামীণ অর্থনীতির সঞ্জীবনী শক্তি।

অতি দ্রুত, প্রায় দু মাস সময়ের মধ্যে ছিষট্টি হাজার মানসম্পন্ন ঘর তৈরি মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসনের সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। এ অভিজ্ঞতা আমাদের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬ ও প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ দ্বারা সরকারি কর্মকাণ্ড ক্রয় ও ব্যয় পলিসিতে প্যারাডাইম শিফট এনে দিতে পারে। এ ঘরগুলোর জন্য অনুসরণকৃত ডিরেক্ট পারচেইজড মেথড (ডিপিএম) স্বল্প ব্যয়ের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে টেন্ডারের জন্য অতিরিক্ত ধাপ, সময় ও খরচ (টেন্ডার প্রফিট ১০%) বেচে যাবে। সরকার নিজে কাজ করায় মান বেড়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে বেশি। সরকার অল্প টাকায় দ্রুত বেশি কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের নেতৃত্বে এ প্রকল্পে নানাভাবে সাহায্য করেছেন এসিল্যান্ডগণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকৌশলী, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণ। নির্মাণ সামগ্রী চুরি ঠেকানোর জন্য গ্রাম পুলিশ রাখছে শক্তিশালী ভূমিকা, থানা পুলিশ নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা করেছে। এলাকার মাননীয় সাংসদগণ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ, মিডিয়া নানা ধাপে সাহায্য করছেন, ঘরের কাজে মনিটরিং করেছেন, উপকারভোগী নির্বাচনে সহায়তা করেছেন। জেলা প্রশাসকগণ সারা জেলায় কাজের অগ্রগতি ও মান নিশ্চিতকরণে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন।

এখনো গ্রামে বিত্তশালীদের নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যা আমাদের প্রচলিত অর্থনীতির তত্ত্বীয় সংজ্ঞায় পাওয়া যায় না। যেমন, জনাব কেরামত আলি বিত্তশালী ধনী মানুষ বড়লোক, কারণ তার ঘর পাকা, ইটের দেয়াল। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রাথমিকভাবে নির্মিত ছিষট্টি হাজার ঘর অনাদিকালের এই সংজ্ঞায়ন ও ধনী-গরিবের শ্রেণি ব্যবস্থায় বড় একটি ঝাঁকুনি দিয়েছে। হঠাৎ করেই এই ছিষট্টি হাজার অসহায়, ছিন্নমূল, ভূমিহীন, ঘরহীন মানুষ আজ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় কেরামত আলির মতো পাকা ঘরের বিত্তশালী মালিক।

ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আলাদিনের প্রদীপে ছুঁয়ে দেয়ার জন্য, স্বপ্নকে বাস্তবে নামিয়ে আনার জন্য। স্বপ্নগুলো আজ পাকা ঘরে তোলার দিন।

লেখক: তৌহিদ এলাহী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :