ভূমি অধিগ্রহণ আইন জানা প্রয়োজনীয় কেন?

মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম
| আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:২৮ | প্রকাশিত : ২৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:১০

দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত উন্নতি সাধনে সরকারপক্ষ তথা ভূমি অধিগ্রহণকারী অফিসার স্থানীয় জমির মালিকের কাছে প্রায়ই প্রথমে নোটিশ দিয়ে জানান দেয় যে তার জমি দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে অধিগ্রহণ করতে হবে, তখন জমির মালিকের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অবস্থা হয়। অধিকাংশ ভূমি মালিকের ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ক জ্ঞান থাকে না। ফলে তাদের নানা রকম দুশ্চিন্তা ও আইনি ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। নিজের জমি রক্ষার্থে বা অধিকার বুঝে নিতে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে সাধারণ আইনি জ্ঞান থাকাটা জরুরি। Acquisition and Requisition of Immovable Property Ordinance, 1982 (Ordinance No. II of 1982) রহিতক্রমে যুগোপযোগী করে বর্তমানে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। যার মূল কিছু ধারা ও অধিগ্রহণ বিষয়ক সাধারণ আইন ভূমি মালিকদের জানা প্রয়োজন বলে মনে করছি। আর ঠিক এই বিষয় নিয়ে “ভূমি অধিগ্রহণ আইনের টুকিটাকি” শিরোনামে লিখেছেন বিচারক মোঃ তাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস।

ভূমি অধিগ্রহণ কি? (What is Land Acquisition?) শুরুতে জেনে রাখা ভালো ভূমি অধিগ্রহণ কি এবং কেন করা হয়। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭ এর ২ ধারা (১) অনুযায়ী ‘অধিগ্রহণ’ (Land Acquisition) অর্থ ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন বা উভয়ের বিনিময়ে প্রত্যাশী ব্যক্তি বা সংস্থার জন্য কোনো স্থাবর সম্পত্তির স্বত্ব ও দখল গ্রহণ। কেন ভূমি অধিগ্রহণ? শুধু বাংলাদেশ নয় যেকোনো দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্র প্রচলিত অধিগ্রহণ আইন অনুসারে ব্যক্তি মালিকানাধীন বা দখলাধীন ভূমি অধিগ্রহণ করে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো সরকার চাইলেই কি যেকোনো সময় যে কারো ভূমি অধিগ্রহণ করতে পারে? উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ, পারে। জনস্বার্থে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেলপথ, সড়ক বা সেতুর প্রবেশ পথ বা এ জাতীয় অন্য কিছুর জন্য জমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন পড়লে সরকার দেশের যেকোনো জেলায় যে কারো জমি অধিগ্রহণ করতে পারে। তবে নতুন আইন স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭ এর ধারা (১৩) অনুসারে ধর্মীয় উপাসনালয় (Mosque, temple), কবরস্থান (graveyard) ও শ্মশান (Cremator) অধিগ্রহণ করা যাবে না। তবে শর্ত আছে যে এগুলো অধিগ্রহণ করা যাবে যদি তা জনপ্রয়োজনে বা জনস্বার্থে একান্ত অপরিহার্য হয়। সেক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ব্যক্তি বা সংস্থার অর্থে স্থানান্তর ও পুনঃনির্মাণ করে দিতে হবে।

যা করতে হবে ভূমি অধিগ্রহণ হলে? ভূমি অধিগ্রহণকালে ভূমির মালিকের কিছু করণীয় নেই সেটা একেবারেই সঠিক নয়। কি কি করণীয় আছে ভূমি অধিগ্রহণকালে তা নতুন আইনে বলে দেয়া হয়েছে। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭ এর ধারা (৫) অনুযায়ী ৪ ধারার নোটিশ জারির পর ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ পনের (১৫) কার্য দিবসের মধ্যে অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের (Deputy Commissioner) নিকট আপত্তি দাখিল করতে পারবেন। আপত্তি পাওয়ার পর Deputy Commissioner সম্পত্তির পরিমাণ ৫০ বিঘার (১৬.৫০) একরের ঊর্ধ্বে হলে তার মতামত সংবলিত প্রতিবেদনসহ নথি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের জন্য প্রেরণ করবেন। আর জমির পরিমাণ ৫০ বিঘার কম হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মতামত সংবলিত প্রতিবেদনসহ নথি কমিশনারের কাছে প্রেরণ করবেন।

সরকার বা কমিশনার কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত জনপ্রয়োজন বা জনস্বার্থে গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, এর বিরুদ্ধে কোথাও আপিল করা যাবে না। সবশেষে দেখা যাচ্ছে যে, ৩ এবং ৪ ধারার নোটিশ জারি করার পরই কেবল শেষবারের মতো ৭ ধারায় নোটিশ জারি করা হয়। ৭ ধারায় নোটিশ জারির পর আর কোনো অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না, তা আইনেই বলা হয়েছে।

ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণ আদায় করা বা হওয়া ভূমি অধিগ্রহণ সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য করতে পারে। তবে মূল সমস্যা ও জটিলতা দেখা দেয় ক্ষতিপূরণ আদায়ের সময়। কারণ অনেকেই জানেন না ক্ষতিপূরণের টাকা কীভাবে আদায় করতে হয় বা ভূমি অধিগ্রহণের পূর্বে যেমন একটি নোটিশ যায় তেমনি জমি অধিগ্রহণের পরে ক্ষতিপূরণের টাকার নোটিশ যায় ডিসি অফিসের রেকর্ড বই অনুযায়ী। যখন ৭ ধারায় নোটিশ জারি করা হয় তখন ভূমির মালিক জেলা প্রশাসক। ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য যেসব প্রমাণাদি প্রয়োজন হয় তার মধ্যে স্থানীয় চেয়ারম্যান কর্তৃক সত্যায়িত ছবি, নাগরিকত্ব সনদ, খতিয়ান মূল/সার্টিফাইড কপি, হাল সনের খাজনা দাখিল, ওয়ারিশ সনদপত্র, রোয়েদাদনামা, ক্ষমতাপত্র (না-দাবিপত্র), বণ্টননামা, হস্তান্তরিত সকল দলিল, ধারা ৭ এর নোটিশে উল্লেখিত ক্ষতিপূরণের প্রমাণাদি।

উপরে উল্লিখিত যাবতীয় ডকুমেন্টসসহ একটি ফাইল প্রস্তুত করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় বা LA শাখায় জমা দিতে হয়। ফাইলটি জমা হওয়ার পর সেখানকার রেজিস্টার বুকে ক্ষতিপূরণ গ্রহণকারীর নাম, খতিয়ান নম্বর, ৮ ধারা নোটিশের রোয়েদাদ এবং জমির পরিমাণ লিখে একটি নম্বর পড়ে এই সিরিয়াল নম্বর অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭ এর ধারা ৯ অনুযায়ী সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে ওই এলাকার জমির ১২ মাসের গড়মূল্যের সাথে আরও অতিরিক্ত ২০০ ভাগ ক্ষতিপূরণ পাবেন জমির মালিক। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জমির গড়মূল্যের ৩০০ ভাগ অর্থাৎ সরকার নিজের প্রয়োজনে ২০০ টাকা মূল্যের জমি অধিগ্রহণ করলে জমির মালিক পাবে ৬০০ টাকা (৩ গুণ), বেসরকারি ৮০০ টাকা (চার গুণ) নির্ধারিত হয়।

ভূমি অধিগ্রহণ রাষ্ট্র কর্তৃক হলে ওই সম্পত্তি নিয়ে দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা করা যাবে কি না? অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি নিয়ে প্রদত্ত কোনো আদেশ বা গৃহীত কোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মামলা বা আবেদন গ্রহণ করার এখতিয়ার রহিত করা হয়েছে। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭ এর (৪৭) ধারায় অধিগ্রহণ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা না করার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। এরপরও ৮ ধারায় নোটিশ জারির পরেও অসাধু চক্রের যোগসাজশে Tittle Suit দায়ের করছে। এতে করে ভূমির মালিকগণ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। সংবিধানের ৪২(২) অনুচ্ছেদেও ক্ষতিপূরণসহ বাধ্যতামূলকভাবে স্থাবর সম্পত্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন বা মামলা না করার বিষয়ে বলা হয়েছে। বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয় অধিগ্রহণ সম্পর্কিত ভূমি নিয়ে কোনো প্রকার মামলা মোকদ্দমা দায়ের করা নিয়ে পরিপত্র জারি করেছে। তবে সার্ভেয়ার ও কানুনগোর প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে জমির মালিকানাকেন্দ্রিক বা অন্য কোনো ধরনের জটিলতা থাকলে ADC রিভিনিউ বরাবর মিস কেসের মাধ্যমে তা সমাধান করা যায়। মিস কেসের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে যেকোনো আরবিট্রেশন সমাধান করার নিয়ম আছে। অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি হস্তান্তর করার জন্য দণ্ডবিধি ১৮৬০ (ধারা ১৭৫ ও ১৭৬) অনুযায়ী।

অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি পুনঃগ্রহণ করা যায় কি? স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও সম্পত্তি হুকুমদখল আইন, ২০১৭ এর ১৯ (১) ও (২) ধারা মোতাবেক প্রত্যাশী সংস্থার অনুকূলে অধিগৃহীত সম্পত্তি যে উদ্দেশ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলে বা বিক্রয়, লিজ, এওয়াজ বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা হলে অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি জেলা প্রশাসক কর্তৃক পুনঃগ্রহণ করে সরকারি দাগ খতিয়ানে আনয়নপূর্বক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন। এখানে ভূমির মালিক যদি কোনো ক্ষতিপূরণ না নেন তবে তার এক ধরনের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমান আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধারা এটি। প্রায়ই এমন দেখা যায় যে উদ্দেশ্যে কোনো জমি হুকুমদখল করা হয় তা অন্য উদ্দেশ্যে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সরকারি পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহৃত হচ্ছে আবার কখনো কখনো এটাও লক্ষ্য করা যায় যতটুকু ভূমি হুকুমদখল প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি জমি হুকুমদখল করান এবং তা দীর্ঘদীন ফেলে রাখেন, এতে ভূমির মতো বিরল সম্পদের ওপর চাপ পড়ে।

বর্তমানে কার্যকর ভূমি আইনটির ৫টি অধ্যায়, ৫১টি ধারা এবং ‘‘অধিগ্রহণ’’ “স্থাবর সম্পত্তি”, “হুকুম দখল” এবং দেওয়ানি কার্যবিধসহ মোট ১৩টি সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ভূমি অধিগ্রহণ আইনটি সম্পত্তির মালিকদের মনে একটু স্বস্তি ফিরিয়ে আনলেও ভূমি অধিগ্রহণ শাখার (LA শাখা) অনিয়ম-দুর্নীতি এবং আইনগত বেশ ফাঁকফোকরের ফলে জমির মালিকগণ সঠিক উপায়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারছেন না। জমি অধিগ্রহণ হলে এমনিতেই জমির মালিক হতাশায় ভোগেন তার ওপর যখন এসব হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়, তার তখন আর্তনাদ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এমনও অনেকে আছেন যার শেষ সম্বল ওইটুকু জমি অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি তাই ক্ষতিপূরণ যথাসম্ভব দ্রুত প্রদান করে তাদের পুনর্বাসন করা উচিত।

মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ এখন শেখ হাসিনা সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে। তাই উন্নয়নের ধারা এবং সকল গৃহীত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে হলে ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয় বা প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, দিচ্ছে বা ভবিষ্যতেও দিবে। তাই অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ পাওয়া সহজসাধ্য করতে হবে এবং যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ভূমি মালিকদের হয়রানি রোধ করতে হবে। পাশাপাশি ভূমি মালিক তথা ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সঠিক হচ্ছে কি না তা আইনের মাধ্যমে সুনিশ্চিত করতে হবে। পরিশেষে ভূমি মালিকদের বলতে চাই নিজের ভূমি/জমি সংক্রান্ত কাগজপত্র হালনাগাদ করে সর্বশেষ আর এস খতিয়ান অনুযায়ী নামজারি ও খাজনা প্রদান করুন। তাহলে জমিজমা সংক্রান্ত নানা সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। একই সঙ্গে ভূমি প্রশাসনের সাথে জড়িত অফিসার ও স্টাফদের সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের উদাত্ত আহবান জানাই। ভূমি প্রশাসনে গতিশীলতা আনতে ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবং ভূমি প্রশাসনে হয়রানি বন্ধে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে যা সত্যিই প্রশংসনীয়।

লেখক: আইন বিশ্লেষক, গবেষক এবং কলামিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :