নিবন্ধ

ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে (পর্ব-১)

ড. নেয়ামত উল্যা ভুঁইয়া
 | প্রকাশিত : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:৪১

| শিক্ষার্থীদের জন্য |

পর্ব— এক

পাখির মতো কবিতারও ডানা দুটি। একটি ভাব। অন্যটি ছন্দ। এ দু’ডানায় ভর করেই মনবিহারী কবিতা-বিহঙ্গ পাড়ি জমায় দেশ-দেশান্তরে,কাল-কালান্তরে। মনের সুখে মুখর হয় আনন্দ-বেদনার গানে। আসর জমায় অন্তরের গহন গুহায়, হৃৎ-হৃদান্তে, মন-মনান্তে।যে কোনো একটি ডানা ভেঙ্গে গেলে সেই ডানাকাটা বিহঙ্গ বিকলাঙ্গ।তবে হ্যাঁ। বিকলাঙ্গও উড়তে পারে, চলতে পারে; যদি উড়বার অভ্যাসটা সে রপ্ত করে ফেলতে পারে বিলক্ষণ।হ্যাঁ, আমি এখানে কবিতার ছন্দ-ডানার কথাই বলছি।সেই ডানা ছান্দসিকের এতটাই নিজের কব্জায় থাকে যে,তখন সেই মজ্জাগত বোধ তাকে অবলীলায়ই উড্ডীন করে।

শিল্পের চিরায়ত উপাদান তিনটিঃ মানুষ, সময় ও নিসর্গ। মানুষের যাপিত জীবন, সময়ের প্রবহমানতা, প্রকৃতির পালা বদল--এ সবের মাঝে যেখানে রয়েছে এক অলৌকিক ছন্দোময়তা, সেখানে কবিতার তো ছন্দাতীত হবার সুযোগই রহিত। ছন্দ কবিতার বাহ্যিক বিষয় নয়। বরং কবিতার অন্তর থেকে ওঠে আসা অচ্ছেদ্য ও অকৃত্রিম অন্যতম প্রধান বিষয়। ছন্দ কবিতার মজ্জাগত সৌন্দর্য । ‘ছন্দ কবির বাহন নয়; কবির ব্যক্তিত্ত্ব’।

আবার ছন্দ কবিতার ব্যাকরণ নয়, অনুশাসনও নয়। ভাষারীতি বা ব্যাকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে ছন্দের সার্বিক বিচার করা হলে তাতে ভুল হবার আশংকা সৃষ্টি হয়। ভাব, ভাবনা, আবেগ, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, উচ্ছ্বাসের সুষম সঞ্চালনের সুদক্ষ কৌশল,পন্থা,পদ্ধতি বা প্রণালী হলো ছন্দ। ‘কথাকে তার জড় ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার জন্যই ছন্দ'। তাই ছন্দ কবিতার বন্ধন নয়-- ছন্দই কবিতার যথার্থ মুক্তি। ছন্দ কবিতার চিরন্তন পথটাকে নান্দনিক নির্দিষ্টতায় বন্ধনহীন গ্রন্থির মাধ্যমে রচনা করে কবিতাকে যথাযোগ্য ও মানানুগ চালনা করে।

ছন্দ কবিতার অপরিহার্য ভূষণ। সে ভূষণ বহিরঙ্গের নয়,একান্তই অন্তরঙ্গের। ছন্দ ভাষার ভাবগত বিষয় নয়, বরং তা অবশ্যই রূপগত। ছন্দ অর্থের অনুগামী নয়, অর্থ নিরপেক্ষ। তবে এ কথা সর্বাংশে সত্য যে, অর্থধ্বনি ও শ্রুতিধ্বনির সুসামঞ্জস্যে কবিতা হয়ে ওঠে চিরন্তন আবেদনের কালোত্তীর্ণ ক্লাসিক।

কথা কখন কবিতা হয়? যখন ভাব ছন্দে প্রকাশ পায়। নীরব কবিত্ব কবিত্ব নয়। প্রকাশই কবিত্ব। কবিতায় কবির আবেগের ছন্দোময় পকাশ ঘটে । ছন্দের আরেক নাম দোলা। কবিতায় অনিন্দ্য আনন্দ যোগানদাতার নাম ছন্দ। সাগর-তরঙ্গের উৎস জল। আর কবিতার তরঙ্গের উৎস শব্দ। শব্দেরা তরঙ্গ-দোলনার দোলে কথা বলে যায় কবিতার ভাষায়। আর পাঠক-শ্রোতাও যেন সেই দোলেই সংগত করে বলে--

ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো

বাসন্তিকার কন্ঠে আমি মালিকা দোদুল গো।’

নজরুলের বহুপ্রচলিত এ গানটিতে কবি আনন্দে উদ্বেল এক বাসন্তি বনফুলের জবানিতে ওর বাঁধভাঙ্গা আনন্দের ফল্গুধারার এমন রসঘন এক বর্ণালি ছবি এঁকেছেন, যেন কবি নিজেই সেই বনফুল। কবির আনন্দ প্রকাশের মাধ্যম কবিতা। আর প্রকৃতির কবিতার নাম হলো ফুল।

সূচনাতেই কবি এমন এক বনফুল হয়ে অপার আনন্দে দুলছেন, যে ছান্দিক দোলার দোল-দোলান্তে কেবলই ছন্দোময়তা। পার্থিব বাস্তব জগতে একজন মানুষের পক্ষে ফুল বা বনফুল হওয়া সম্ভব না। যা বাস্তব বোধের অতীত তার নাম ভাবাবেগ। ইচ্ছেঘুড়ি যথেচ্ছ উড়ানো সম্ভব কেবল সেই জগতে, যে জগত অলৌকিক, যে জগত স্বপ্নের, একান্তই কল্পনার। সেটা ভবের রাজ্য নয়; ভাবের সাম্রাজ্য। এ সাম্রাজ্যে রাজ করেন ভাব-নৃপতি। যে মুকুটহীন সম্রাটের নাম কবি। বোধাতীত সেই রহস্যরাজ্যে কবিরা কল্পনারঙে আলপনা আঁকেন। কবি বাহ্যিক জগতে যা দেখেন সেই চিত্র ও অভিজ্ঞতাকে তার অন্তর্গত ভুবনে অভিষিক্ত করেন। সেই কাঁচামালকে অন্তরের মাধুরী মিশিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে একে অন্তরলোক থেকে নবরূপে বহিঃস্থলোকে চালান করেন। এই প্রকাশের উদ্দেশ্য কী? মুল উদ্দেশ্য আনন্দ সঞ্চার--‘আনন্দ সর্বলোকে/ মৃত্যু বিরহ শোকে।’' আনন্দের এই বন্ধনহীন অবাধ সঞ্চরণের মাধ্যমেই কবির বন্ধনমুক্তি। এভাবেই তার ভাবনার খেয়া ঘাট থেকে ঘাটে ভাসে। সঞ্চারিত শান্ত ছন্দে অবলীলায় যুক্ত হয় সবার সঙ্গে-- ঘরের সঙ্গে, পরের সঙ্গে, বিশ্বলোকের সঙ্গে।

উপর্যুক্ত উদ্ধৃত গানের কলির প্রতি আবার লক্ষ্য করি। বাস্তব জগতের একটি অখ্যাত উপেক্ষিত বনফুল অনিন্দ্য নন্দকানের ফুল হয়ে কেমন তাবৎ দুনিয়ার তুচ্ছাতিতুচ্ছ সকল ফুলের প্রতিনিধিত্ব করলো। এতে কল্পনা আছে। আবেগের উৎসারণ আছে। কল্পলোকের অরূপ বনফুল কবির রূপ প্রিয়তায় স্বরূপ লাভ করেছে। সৌন্দর্য সৃষ্টি করা হয়েছে নান্দনিক সৃজনশীলতায়। আছে উৎকৃষ্ট শব্দগুচ্ছের প্রকৃষ্ট বিন্যাস। নিজের আনন্দের বারতা আছে। আবার সেই আনন্দ পাঠক-স্রোতাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে যুক্ত হবার মতো আবেদন আছে। দোল দোলানো ছন্দের দোলায় সৃষ্টি করা হয়েছে গতি-সৌন্দর্য। তো আর কী চাই একটা পদ্যের কবিতা হয়ে উঠতে। এখানে যা বললাম, সেগুলোই মূলতঃ সাহিত্য বা কবিতা সৃষ্টির মূল উৎস।

পরিমিত অক্ষরে বিন্যস্ত শ্রবণ-মনের প্রীতিপদ পদাবলির নাম ছন্দ। কবি কবিতাকে শ্রুতিমধুর বা রসঘন করার জন্য শব্দগুলিকে সুশৃঙ্খল ধ্বনি বিন্যাসে সজ্জিত করেন। এই ধ্বনি বিন্যাস নির্দিষ্ট কতগুলো পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট বর্ণ সংখ্যায় আবদ্ধ করে ধ্বনি সুষমা সৃষ্টি করে ।

ছন্দের আরেক নাম গতি-সৌন্দর্য। ছন্দ ছাড়া আর যা-ই হোক, কবিতা হয় না। গদ্য কবিতা (Vers Libre)’র ক্ষেত্রেও সেই শর্তের কোন ব্যতিক্রম নেই। সেখানে ছন্দ হয়তো নাচে না, তবে চলে বিলক্ষণ। ছন্দ এদেরকে হয়তো কিছুটা ছাড় দেয়, তবে একেবারে ছেড়ে দেয় না। ছন্দের অনুগামী না হয়ে এর গত্যন্তর নেই। নির্ধারিত মাপের চেয়ে নিচে নেট বেঁধে টেনিস খেলা যেমন সুবিধাজনক, অমিত্রাক্ষর ছন্দ (Blank Verse)-এ কবিতা লেখাও নাকি তেমনি জুতসই। তবে দর্শক প্রিয়তা পেতে হলে সে খেলায়ও মুন্সিয়ানা দেখানো জরুরি। অমিত্রাক্ষর ছন্দে অক্ষরে অক্ষরে মিত্রতা থাকে না বটে, তবে ছন্দের সঙ্গে এর দ্বন্দ্বতো নেই-ই বরং অনিবার্য সখ্যতা অত্যন্ত নিবিড়।

Encyclopaedia Britannica ছন্দ শব্দের ইংরেজি Rhythm কে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে- ‘Rhythm, in poetry, the patterned recurrence, within a certain range of regularity, of specific language features, usually features of sound.' অনলাইন লিটারারি ডিভাইসেস 'র মতে, The word rhythm is derived from rhythmos (Greek) which means, “measured motion.” Rhythm is a literary device that demonstrates the long and short patterns through stressed (long sounding) and unstressed (short sounding) syllables, particularly in verse form. বিবিসি'র ভাষ্যমতে " Rhythm can be described as the beat (স্বরকম্প) and pace ( গতিভঙ্গি) of a poem. Rhythm is created by the pattern (ছাঁচ) of stressed and unstressed syllables in a line or verse. Rhythm can help to strengthen the meaning of words and ideas in a poem." মার্কিন কবি Edward Hirsch- এর মতে, "Rhythm is sound in motion. It is related to the pulse, the heartbeat, the way we breathe. It rises and falls. It takes us into ourselves; it takes us out of ourselves." মার্কিন গায়ক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং অভিনেতা Elvis Aaron Presley বলেন, " Rhythm is something you either have or don't have, but when you have it, you have it all over." ছন্দের গতিময়তা সম্পর্কে মেক্সিকান লেখক Don Miguel Ruiz-এর মন্তব্য এ রকম, "Life is like dancing. If we have a big floor, many people will dance. Some will get angry when the rhythm changes. But life is changing all the time.” ছন্দ প্রকরণকে ইংরেজিতে Prosody বলা হয় ।

কারো কারো মতে, ছন্দ অর্থ ছাঁচ, গড়ন বা ভঙ্গি। শব্দ বিন্যাসের নানা কৌশল অবলম্বনে কবিতার এই গড়ন তৈরি করা হয়। ছন্দকে বলা হয় বাণী বিন্যাসের কৌশল। “কাব্যের রসঘন ও শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তা-ই ছন্দ।”

ছন্দ প্রকৃত প্রস্তাবে কাব্যের গতিসৌন্দর্য বিধায়ক একটি স্বতঃস্ফূর্ত নির্মাণকৌশল। হাজার বছর ধরে বিচিত্র আবেগ, অনুভূতি ও বিষয়ভাবনা দ্বারা পরিপুষ্ট বাংলা কাব্যের গতিময় সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কবিরা বহুবিধ ছন্দের নির্মাণ ও বিকাশ সাধন করেছেন। অর্থাৎ, কবি তার কবিতার ধ্বনিগুলোকে যে সুশৃঙ্খল বিন্যাসে বিন্যস্ত করে তাতে এক বিশেষ ধ্বনিসুষমা দান করেন, যার ফলে কবিতাটি পড়ার সময় পাঠক এক ধরনের ধ্বনিমাধুর্য উপভোগ করেন, ধ্বনির সেই সুশৃঙ্খল বিন্যাসকেই ছন্দ বলা যায়। আর ছন্দ সম্পর্কে পড়বার আগে আরেকটা জিনিস মাথায় রাখা বিশেষ দরকার ;ছন্দ সর্বদা উচ্চারণের সাথে সম্পর্কিত, মোটেই বানানের সঙ্গে নয়।

অক্ষর, মাত্রা, যতি বা ছেদ, পর্ব বা পর্বাঙ্গ, পংক্তি বা চরণ, স্তবক--এগুলো ছন্দের উপাদান । / চলবে...

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :