নিবন্ধ

ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে (পর্ব--৪)

ড. নেয়ামত উল্যা ভুঁইয়া
| আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:১৯ | প্রকাশিত : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:১৬

‘মিল’ নিয়ে ৩য় পর্বে খানিকটা আলোকপাত করেছি। শ’ খানেক বছরের কিছু আগ পর্যন্তও কবিতা ছিল সমিল। কবিতায় ‘অমিল’ এনেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘ছন্দ’ এবং ‘মিল’ অপরিশোধিত বা অমার্জিত কবিতায় মাধুর্য ও সুষমা এনেছে (all the sweetness and harmony)। সাধারণত: ‘মিল’ পদের শেষে থাকলেও শুরুতে বা মাঝেও মিল থাকতে পারে। পদের শেষের মিলকে বলে অন্ত্যমিল। যেমন-
চোখের পলকে∣ হাসির ঝলকে∣ কেড়ে নিলো মন,

প্রথম দেখাতে ∣প্রেমের পাখাতে∣ জাগলো শিহরণ।

আঁখির তারায় তার | জ্যোতির অলংকার∣ ভাবের আলিঙ্গন,

নজর নামের খেয়া ∣করছে দেয়া নেয়া ∣মনের আলাপন।

লক্ষণীয় যে, সকল চরণের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের শেষের পদদুটিতে অন্তঃস্থ মিল আছে। আবার দুই চরণের শেষের পদেও অন্ত্যমিল আছে। প্রসঙ্গত: সুকান্ত ভট্টাচার্যের ' আঠারো বছর বয়স’ কবিতার প্রথম দুটি স্তবকের পর্যালোচনা করা যাকঃ

আঠারো বছর ∣ বয়স কী দুঃসহ

স্পর্ধায় নেয় ∣ মাথা তলবার ঝুঁকি,

আঠারো বছর ∣ বয়সেই অহ রহ

বিরাট দুঃসা ∣ হসেরা দেয় যে উঁকি।

আঠারো বছর ∣ বয়সের নেই ভয়

পদাঘাতে চায় ∣ ভাঙতে পাথর বাধা,

এ আঠারো বছর ∣ বয়স জানে না কাঁদা।

বয়সে কেউ ∣ মাথা নোয়াবার নয়।

উপরে কবিতাটির প্রতিটি চরণে রয়েছে ৩টি পর্ব; প্রথম দুটি পর্ব ৬ মাত্রার, শেষ পর্ব ২ মাত্রার অর্থাৎ শেষ পর্বটিতে মাত্রার সংখ্যা কম আছে। এরূপ কম মাত্রার পর্বই অপূর্ণ পর্ব । আবার চরণের অন্ত্যমিল লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রতি স্তবকের প্রথম ও তৃতীয় চরণের শেষে এবং দ্বিতীয় ও চতুর্থ চরণের শেষে রয়েছে অন্ত্যমিল।

১১. ছন্দ পতন:

উচ্চারণ ঠিক থাকলেও যখন পর্বের মাত্রাসংখ্যা কম বেশি হয়, ছন্দ বিশ্লেষণে তখন ছন্দ পতন ঘটে। তবে তা পাঠকের পড়বার মুন্সিয়ানায় উতরে যেতে পারে। কারণ ছন্দের জন্য কবিতা নয়, কবিতার জন্যই ছন্দ। ভাবের স্বাচ্ছন্দ্য প্রকাশ যখন মুখ্য; ছন্দের কঠোর রীতি তখন গৌণ। কারণ, ছন্দপতন কোনক্রমেই ভাবের খামতি না। ছন্দ হয় ভাবের অনুগামী; ভাব ছন্দের অনুবর্তী নয়।

১২. ছন্দসন্ধি:

ছন্দ পতনের আশংকা থেকে রেহাই পাবার প্রয়োজনে পাশাপাশি দুটো শব্দকে একত্রিত করে পড়বার নীতিকে ছন্দসন্ধি বলে। যেমন,

হত্যা নয় আজ ∣ 'সত্যাগ্রহ' ∣ শক্তির উদ্বো ∣ ধন ! এখানে ছন্দ রক্ষার প্রয়োজনে নয় + আজ = নয়াজ এবং শক্তির + উদ্বোধন = শক্তিরুদ্বোধন পড়তে হবে। নইলে ছন্দ পতন ঘটবে।

১৩. শ্বাসাঘাত :

বাংলা কবিতা পাঠ করার সময় প্রায়ই পর্বের প্রথম অক্ষরের উপর একটা আলাদা জোর দিয়ে পড়তে হয়। এই অতিরিক্ত জোর দিয়ে পাঠ করা বা আবৃত্তি করাকেই বলা হয় শ্বাসাঘাত বা প্রস্বর। যেমন,

‘ কোভিড শেষে | আবার যাবো |পদ্ম দিঘির |ঘাটের পাড়,

দেখবো বসে | হাঁসের খেলা | জলোকেলি | ডুব সাঁতার।

দেখবো খেলা | লুকোচুরি | পদ্ম পাতার | পাশ ঘেঁষে,

জলতরঙ্গে | রোদের ঝিলিক | ঝিকিমিকি | যায় হেসে।

সদ্য ফোটা | পদ্মফুলে | জল ফড়িঙের | প্রাণ ছোঁয়া,

পাপড়ি দলের | দোলার দেশে | যাবে আমার | মন খোয়া।

আলতো তালে | আছড়ে পড়া | কাজলা জলের | তরঙ্গণ,

দোলায় দোলায় | টলোমলো | দোলদোলাবে | আমার মন।’

এখানে প্রতিটি পর্বের প্রথম অক্ষরই একটু ঝোঁক দিয়ে, জোর দিয়ে পড়তে হয়। এই অতিরিক্ত ঝোঁক বা জোরকেই শ্বাসাঘাত বলে। ধ্বনিতত্ত্বের পরিভাষায় শ্বাসাঘাত বা প্রস্বর (ইংরেজি: Accent বা Stress) বলতে কোনও শব্দে বা শব্দের অংশবিশেষ তথা সিলেবলে স্বাভাবিকভাবে খানিকটা জোর দিয়ে উচ্চারণ করাকে বোঝায়। যেমন ইংরেজি ভাষায় de-mo-cra-cy শব্দটিতে দ্বিতীয় সিলেবলটিতে শ্বাসাঘাত পড়ে, কিন্তু de- mo- cra- tic শব্দটিতে তৃতীয় সিলেবলে শ্বাসাঘাত পড়ে। যেসব সিলেবলে এই জোর পরিলক্ষিত হয় না, সেগুলো প্রস্বরহীন বা শ্বাসাঘাতহীন ( unaccented বা unstressed)। সব ভাষাতেই শ্বাসাঘাতের বিভিন্ন নির্দিষ্ট বিন্যাস থাকে; এই বিন্যাসকে বলা হয় প্রস্বরীকরণ বা শ্বাসাঘাতিকরণ (ইংরেজি ভাষায় Accentuation)। শ্বাসাঘাত পড়া সিলেবলটি উঁচু সুরে এবং সাধারণের চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চারিত হতে পারে। শ্বাসাঘাতের বিভিন্ন মাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব। সাধারণত: প্রাথমিক, গৌণ এবং দুর্বল--এ তিন ধরনের শ্বাসাঘাতকে চিহ্নিত করা হয়।

১৪. লয়:

ধ্বনির গতিকে বলা হয় লয় (tempo)।কবিতা পাঠের বা সঙ্গীতের গতিকে বলে লয়। অন্য কথায় , তালের নির্দ্দিষ্ট সময়কালকে অবিচ্ছেদ্দ্য সমান গতিতে অতিক্রান্ত করার নাম লয়। গতির তারতম্যের জন্য লয়কে তিন ভাগে ভাগ করা যায় - ১) ধীরগতির জন্য বিলম্বিত লয়, ২) মধ্যগতির জন্য মধ্য লয়। ৩) দ্রুতগতির জন্য দ্রুত লয়। কবিতার প্রথম স্তবক পড়লেই বোঝা যাবে যে, ধ্বনিগুলোকে কোন বেগে সাজানো হয়েছে। আর সি বেগ থেকেই বোঝা যাবে, কবিতাটির আবৃত্তি ধীর,মধ্যম নাকি দ্রুত লয়ে হবে।

মূলত: কানই কবিতার ছন্দ বা গতি-সৌন্দর্যের প্রাণ। কারণ ছন্দ শুনবার জিনিস। উল্লেখ্য,প্রধান ধ্বনির সহযোগী ধ্বনিকে বলা হয় আশ্রিত ধ্বনি ।

১৫. ছন্দের প্রকারভেদ:

বালা কবিতার ছন্দ মূলত: ধরনের: (১) স্বরবৃত্ত বা দলবৃত্ত, (২) মাত্রাবৃত্ত বা কলাবৃত্ত এবং (৩) অক্ষরবৃত্ত বা মিশ্রকলাবৃত্ত।তবে গদ্য ছন্দ ও মিশ্র ছন্দও উল্লেখযোগ্য। স্বরবৃত্ত ছন্দ সাধারণত দ্রুত লয়ের ছন্দ। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ মধ্য লয়ের ছন্দ। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বিলম্বিত বা ধীর লয়ের ছন্দ। সূচনাতেই আরো মনে রাখা আবশ্যক যে, পয়ার ছন্দে অন্ত্যমিল থাকে। অমিত্রাক্ষরে অন্ত্যমিল নেই। স্বরবৃত্ত ছন্দকে লৌকিক/স্বরপ্রধান, মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে ধ্বনি প্রধান এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে তান/সুর প্রধান ছন্দ বলা যায়।

(১). স্বরবৃত্ত ছন্দ: বাংলা ভাষর আদিমতম ছন্দের নাম স্বরবৃত্ত ছন্দ। এটি লোক সাহিত্যের ছন্দ বিধায় রবীন্দ্রনাথ এ ছন্দের নাম দিয়েছেন প্রাকৃত বা লোকছন্দ। স্বরবৃত্তের একটি অসাধারণ চাল আছে।এই চালটি হল স্বরমাত্রিকের। একটি কবিতা স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত দুই রীতিতেই পাঠযোগ্য। যেমন,

"বউ কথা কও' "বউ কথা কও' যতই গায় সে পাখি,

নিজের কথাই কুঞ্জবনের সব কথা দেয় ঢাকি।

যে ছন্দে যুগ্মধ্বনি / বদ্ধাক্ষর সব সময় একমাত্রা ধরা হয় এবং পর্বের আদিতে স্বাসাঘাত পড়ে;তাকে স্বরবৃত্ত ছন্দ বলে৷

ছড়া স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত হয় বিধায় এ ছন্দকে ছড়ার ছন্দ বা লৌকিক ছন্দও বলা হয়। স্বরবৃত্ত চোখের হিসাবে চলবে না, চলবে কানের বিচারে।

স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্যঃ

১. এ ছন্দে মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর সব সময় এক মাত্রা ধরা হয় ৷অর্থাৎ সব অক্ষর ১ মাত্রা গুনতে হয়।

২. মূল পর্বে ৪ মাত্রা থাকে। প্রতিটি চরণ সাধারণতঃ চারটি পর্বে বিভক্ত।তবে তা অত্যাবশ্যকীয় না। যেমন,

ঝলমল মখমল সুকোমল সজ্জায়,

নির্ঘুম রাত কাঁতে বিবেকের লজ্জায়।

৩. কোথাও কোথাও তিন বা দু মাত্রা বিশিষ্ট পর্বও পূর্ণ পর্বের মর্যাদা লাভ করে ৷ অর্থাৎ শেষের পর্বটি প্রায়ই অপূর্ণ পর্ব থেকে যায়।

৪. পর্বগুলো সংক্ষিপ্ত হয় এবং প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষরে শ্বাসাঘাত পড়ে।

৫. এছন্দ তুলনা মূলক দ্রুতলয়। যেমন,

তোমরা যখন শিখছ পড়া

মানুষ হওয়ার জন্য,

আমি না হয় পাখিই হব,

পাখির মতো বন্য।

৬. টেনে পড়তে হলে কখনো কখনো বদ্ধাক্ষর দুই মাত্রা হিসেবে ধরা হয়।

৭. এ ছন্দের মূল ছড়ার ছন্দে নিহিত ৷

৮. এ ছন্দে সাধুরীতির ক্রিয়াপদ কম ব্যবহৃত হয়।

পরবর্তী পর্বে এ ছন্দের উদাহরণ দেয়া হবে। /চলবে...

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :