‘আশরাফ-উল-আলম টুটু’ আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য

প্রকাশ | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:৫০

এম এম মাহবুব হাসান

আজ তুমি নাই,

দূর হতে গেছো বহুদূরে

সব মানি, সবচেয়ে বেশি মানি

তুমি ছিলে একদিন।

 

জীবন মাত্রই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা। ‘একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ, পড়িবে নয়ন পরে অন্তিম  নিমেশ’। কবির বাণীকে তো অস্বীকার করার উপায় বা সাধ্য নেই। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও মন প্রবোধ মানে না। বোধকরি এ কারণেই কাছের কিংবা দূরের যাইহোক না কেন পরিচিতজনের অন্তিমযাত্রাকে সহজে মেনে নিতে মন সায় দেয় না কিছুতেই। আবার এমন কিছু মৃত্যু আছে যা হৃদয়কে মোথিত করে, বেদনার নীল দংশনে ক্ষত-বিক্ষত করে।

সবার প্রিয় টুটু ভাই। আমাদের শ্রদ্ধেয় আশরাফ-উল-আলম টুটু। তাঁর এই অবেলায় চলে যাওয়াকে কিছুতেই কি মেনে নেয়া যায়? জন্ম ১৯৫৪ সালে। জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে ২০০৮ এর এই ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮.৩০ মিনিটে অকস্মাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মাঝ পথেই থেমে গেলেন। তাঁর এই থেমে যাওয়া আমাদের সবার জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হলো। ব্যক্তির গণ্ডি পেরিয়ে টুটু ভাই হয়ে উঠেছিলেন সমষ্টির। জীবনের পরতে পরতে তিনি গভীরভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন, এই দেশ-এই মাটির মানুষকে বাঁচাতে হলে নিরন্তর কাজ করে যেতে হবে।

১৯৭১ সালে ১৭ বছরের নবীন যুবক টুটু ভাই দেশমাতৃকার মুক্তির নেশায় নিজেকে আবিষ্কার করেন অন্যরকম এক সংগ্রামী মানুষ হিসেবে। নিজের বুদ্ধি, চিন্তার প্রখরতা আর বিচক্ষণতায় ভারতের দেরাদুনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক বনে যান। তরুণ বয়সে বাংলাদেশের মানুষের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন যোদ্ধা হিসেবে যে ভূমিকা রেখেছেন আমৃত্যু সে ভূমিকায় তিনি ছিলেন অবিচল, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের, ভূমিহীনদের, আদিবাসীসহ অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।

তার সারাজীবনের কর্মকাণ্ডকে মূলত তিনটি ভাগে গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করা দরকার। প্রথমতঃ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, দ্বিতীয়তঃ শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের জন্য তার রাজনৈতিক জীবন, তৃতীয়তঃ পরিবেশবাদী হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের আসন্ন বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য কাজ করে যাওয়া। আজ আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের যে কথা খুব জোরেশোরে উচ্চারিত হতে দেখছি তা অনেক আগেই তিনি অনুভব করেছিলেন। আশির দশকেই টুটু ভাই বুঝেছিলেন জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বগ্রাসী থাবা ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। যখন তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করেন তখন অনেকের কাছেই বিষয়টির প্রভাব সম্পর্কে খুব একটা জানা ছিল না। নিঃসন্দেহে তাই বলা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার অন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃত।

১৯৯৭ সালে কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (সিডিপি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি জলবায়ু পরিবর্তনসহ, উপকূলীয় পরিবেশ সুরক্ষা, দাতাগোষ্ঠীর অযাচিত হস্তক্ষেপ, মানবাধিকার ও সুশাসন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অনন্য সচেতন ভূমিকা পালন করে গেছেন। তার লিখিত ৪০টিরও বেশি গবেষণাভিত্তিক প্রকাশনা দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। টুটু ভাই ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রায় ২৫টি দেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ফোরামে অংশগ্রহণ করে এদেশের মাটি ও মানুষের পক্ষ থেকে জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন। টুটু ভাইয়ের সকল ক্রিয়াকর্মে রোমান্টিকতার ছাপ ছিল। ছিল এক স্বাপ্নিক সত্তা। তবে সে স্বপ্ন শুধু নিজেকে নিয়ে নয়। বরং তার কেন্দ্রে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, জনসাধারণ। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, দক্ষতা ও অন্যান্য উপকরণ ইতোমধ্যে তিনি অর্জন করেছিলেন। এই অকাল মৃত্যুতে তা বিফলে গেল। বাংলাদেশের জনগণও এর সুফল পেল না।

টুটু ভাই শিখিয়ে গেছেন তৃণমূল মানুষের সাথে কাজ করার বিরল কৌশলসমূহ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন সংকটের পারাবাত পেরিয়ে এই জনপদের মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াবে বলিষ্ঠভাবে। প্রকৃতির সন্তান টুটু ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার স্বপ্ন বেঁচে আছে। তার আদর্শ আজও আমাদের পথ দেখায়। চলমান সময়ে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল তার নেতৃত্বের কিন্তু চাইলেইতো আর সব আশা পূরণ হয় না। তেমনি আমরাও আর ফিরে পাবো না তাকে। তবে এ মহান মানুষটির কর্মময় জীবন, তার শিক্ষা, আদর্শ আমাদের আজও পথ দেখিয়ে চলেছে। সমুদ্রের বাতিঘরের মতো দূর থেকেই তিনি আমাদের পথের ঠিকানা বলে দেন আজও। আজ তাই শোক নয়, আজ হোক একজন টুটু থেকে অসংখ্য টুটু গড়ে ওঠার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবার দিন। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে আজ থেকে আমরা যেন এগিয়ে যাই তার অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করতে। আর তা হলেই এ কর্মবীরের আত্মা শান্তি পাবে।

লেখক: ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক