ব্রিটিশ আমলের রেললাইন ও সেতুর মৃত্যুফাঁদ সিলেট রুট

প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১২:১৪

অশিক আহমেদ ও সৈয়দ ঋয়াদ
৫ ফেব্রুয়ারি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে লাইনচ্যুত হয় তেলবাহী একটি ট্রেনের আটটি বগি

দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক রেলপথ হয়ে উঠেছে দেশের পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটটি। একের পর একে দুর্ঘটনা ঘটছে এই পথে। গত ছয় মাসে এই রুটে আটটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাতে প্রাণহানিসহ লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা। রেলসূত্র বলছে, পুরনো রেললাইন আর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সেতুর কারণে এই পথ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।

সর্বশেষ গতকাল মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা এলাকায় তেলবাহী ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়ে সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেলযোগাযোগ বন্ধ থাকে চার ঘণ্টা।

প্রতিবারই সড়ক দুর্ঘটনার পর রেল মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। সমস্যা চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়, তবে কমিটির প্রতিবেদন গণমাধ্যমে আসা দূরে থাক, এই রেলপথ মেরাপথে বড় পরিসরে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।

দেশের রেল যোগাযোগে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও এই সিলেট পথটি যেন অবহেলায় পড়ে আছে। সেই ব্রিটিশ আমলের রেললাইন ও আর সেতু নিয়ে চলছে পূর্বাঞ্চল রেলের এই অংশটি। ফলে প্রায় প্রতি মাসে ঘটছে দুর্ঘটনা।  

চলতি মাসের গত দশ দিনে এই রুটে ঘটে দুটি  দুর্ঘটনা। ৪ ফেব্রুয়ারি ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও রেলস্টেশনের কাছাকাছি চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী তেলবাহী ট্রেনের আটটি ওয়াগন উল্টে যায়। বিপুল তেল ছড়িয়ে পড়ে এসব ওয়াগন থেকে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর ওই পথে স্বাভাবিক হয় ট্রেন চলাচল। একইভাবে গতকাল মৌলভীবাজারে তেলের ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এর ফলে সিলেটের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগামের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র থেকে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া রেলওয়ে জাংশন থেকে সিলেট পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ১৭৯ কিলোমিটার। এই পথে ৯০ শতাংশ সেতু মেয়াদোত্তীর্ণ। এর মধ্যে  অন্তত ১৪টি সেতু ‘ডেডস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত। এগুলো যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। দুর্ঘটনা এড়াতে ট্রেনের গতি নেমে এসেছে অর্ধেকে।

রেলওয়ের হিসাবে, এই পথে গড়ে প্রতিবছর ছোট-বড় ১৪টি দুর্ঘটনা ঘটে। ২০২০ সালের শুরু থেকে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা হয় দেশের রেলপথ। আগস্টে রেল যোড়াযোগ চালু হলে সিলেটের ওই সড়কে গত ছয় মাসে আটটি বড় দুর্ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশে রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের রেল সড়কের একটি বড় অংশই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সাধারণত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পর রেললাইন বাতিল হয়ে যায়, কিন্তু এখানে তা ব্যবহারর করা হচ্ছে বছরের পর বছর, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।’

এই পথে বহু সেতু জরাজীর্ণ। সেগুলো ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে যেসব রেললাইন তৈরি হয়েছে সেগুলো বিকল হয়ে গেছে। সিলেট পথটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেতুগুলোর অবস্থা অনেকটা বিকল। এই সেতুগুলোর আর সক্ষমতা নেই ট্রেনের ভার বহন করার। এই রুটে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। যদি পুরনো সেতুগুলো নতুন করে নির্মাণ না হয় তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে মন্দবাগের মতো বড় দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে আমাদের।’

বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রাফিক বিভাগের হিসাব মতে, গত বছরে আগস্টে রেল যোগোযোগ চালু হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই রুটে প্রতি মাসে একটি করে ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়েছে। এর মধ্যে নভেম্বর আর ফেব্রুয়ারি মাসে দুটি করে চারটি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

রেলওয়ের ট্রাফিক বিভাগের সূত্রমতে, এই পথে ২০১৯ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত মাসে শুধু ট্রেন-লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে ৯টি। দুর্ঘটনাগুলো মূলত সিলেটের মৌলভীবাজার, সাতগাঁও, ফেঞ্চুগঞ্চ, কুলাউড়া, বড়লেখা ও শ্রীমঙ্গল রুটে হয়ে থাকে।

সম্প্রতি ট্রেন দুর্ঘটনায় বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে দুর্নীতিকে বড় কারণ হিসেবে দেখছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংসস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে রেলে দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করছে সংস্থাটির একটি দল। দুদকের তদন্ত থেকে বেরিয়ে আসে রেলের দুর্নীতির চিহ্নিত ১০টি উৎস। আর এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে রেল মন্ত্রণালয় বরাবর ১৫ দফা সুপারিশ করে দুদক।

দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের সেই সুপারিশ থেকে জানা যায়, রেলের কেনাকাটা, বিক্রি, রেলের জমি ইজারা, জলাশয় ইজারা, সড়ক সংরক্ষণ, মেরামত, ভাঙা ব্রিজ সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পায় দুদক। রেলমন্ত্রী ও সচিবের কাছে দেওয়া সেই সুপারিশে বলা হয়, রেলওয়ের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে না পারলে সুফল মিলবে না রেলসেবায়।

(ঢাকাটাইমস/১৪ফেব্রুয়ারি/মোআ)