ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে (পর্ব-৬)
আগের পর্বে স্বরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এবার হবে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের মাত্রাকথন। ভুললে মোটেই চলবেন যে, মাত্রাবৃত্ত ধ্বনি-প্রধান ছন্দ এবং বদ্ধাক্ষরকে সাধারণত: সবসময় দু’ মাত্রা ধরা হয়। অনেকেই একে শব্দপ্রধান বা অক্ষরধ্বনিপ্রধান ছন্দও বলে থাকেন।
(২). মাত্রাবৃত্ত ছন্দ:
মোদ্দা কথা, যে ছন্দে অক্ষরের ধ্বনি বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে এবং বদ্ধাক্ষরকে সাধারণত: সবসময় (শব্দের যেখানেই থাকুক না কেনো) দু’ মাত্রা ধরা হয়, মধ্যম লয়ের এই ছন্দ-ই মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ কোনো অবস্থাতেই বদ্ধস্বরকে একমাত্রা হিসেবে বহন করতে পারে না। তবে স্বরবৃত্তের মতোই মুক্তস্বরকে একমাত্রা হিসেবে বহন করে।
মাত্রাবৃত্ত মধ্য লয়ের ছন্দ। প্রাচীনতম এ বাংলা ছন্দকে রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছেন 'সংস্কৃতভাঙা'। মোহিতলাল মজুমদার ডেকেছেন 'সাধুভাষার পর্বভূমক' বলে। প্রবোধচন্দ্র সেন দিয়েছেন অনেক নাম - 'কলাবৃত্ত', 'সরলকলামাত্রিক' ও 'মাত্রাবৃত্ত'। পরবর্তীতে অবশ্য 'মাত্রাবৃত্ত' নামটাই প্রিয়তা পেয়ে যায়।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্যঃ
ক). মূল পর্ব ৪,৫,৬ বা ৭ মাত্রার হয়।
খ). ধ্বনি বিশেষ প্রাধান্য পায়। এর কেবল শব্দধ্বনিই থাকে, অতিরিক্ত কোনো তান থাকে না।
গ). হলন্ত বা হসন্ত অক্ষর শব্দের যেখানেই থাক না কেনো, তা দ্বিমাত্রিক হবে।
ঘ). এ ছন্দে যৌগিক স্বরান্ত অক্ষর (ঐ, ঔ) অক্ষরকেও দু’ মাত্রা ধরা হয়। তবে এ নিয়মের ব্যতিক্রমও হয়। ঙ). এছাড়া দীর্ঘ অক্ষরের বিস্তার করেও দু’মাত্রা ধরা হয়; সে কারণে একে বিস্তারপ্রধান ছন্দও বলা হয়।
চ). অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে স্বরবৃত্ত ছন্দের মতোই এক মাত্রা গুনতে হয়;
ছ). অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি/ বদ্ধাক্ষর/ রুদ্ধাক্ষর থাকলে (য় থাকলেও) দু’ মাত্রা গুনতে হয়;
য). ‘য়’ -কে বলা যায় semi-vowel, পুরো স্বরধ্বনি নয়, তাই এটি অক্ষরের শেষে থাকলেও দু’ মাত্রা হয়। সে কারণেই 'হয়’, 'কয়', 'নয়', 'দ্বয়' দু মাত্রার শব্দ; পরিচয়, অভিনয়, অক্ষয়, অপচয়, আলোকালয় -- এরকম শব্দের শেষের 'য়'- কে-ও দু মাত্রার গুনতে হয়।
ঞ). এটি মধ্য-লয়ের ছন্দ
ট). মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবিতা আবৃত্তির গতি স্বরবৃত্ত ছন্দের চেয়ে ধীর, কিন্তু অক্ষরবৃত্তের চেয়ে দ্রুত।
অন্যভাবে বললে, মাত্রাবৃত্তে যুক্তাক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিতে হয়, অর্থাৎ দু’মাত্রা দিতে হবে। অনেকে তাই মাত্রাবৃত্তকে ‘যুক্তাক্ষর ভাঙা ছন্দ’ও বলে থাকে। একটা উদাহরন দি; যেমন,‘কষ্ট ’ শব্দটি মাত্রাবৃত্তে ভেঙে গিয়ে হবে ‘ক ষ্ ট’– ৩ মাত্রা। (কিন্তু অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা,যা পরে বিস্তারিত বলবো।) ‘ছন্দ’ অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা, আর মাত্রাবৃত্তে ৩ মাত্রা
(ছ ন্ দ )।
তবে একটা ব্যতিক্রম মনে রাখা দরকার। শব্দের প্রথমে কোন যুক্তাক্ষর থাকলে সেটা ভাঙা সম্ভব নয়, সে কারনে মাত্রাবৃত্তেও তা ১ মাত্রাই পায়। যেমন, ‘ক্লাস’ শব্দটি অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত দুই ছন্দেই ২ মাত্রার। কারণ শব্দের শুরুতেই যে যুক্তাক্ষর ‘ক্ল’ রয়েছে, তা ভাঙা যাচ্ছেনা। তাই শব্দের আদি অক্ষর যুক্তাক্ষর হলে ১ মাত্রা হবে । যেমন, ক্ল , ক্র , দ্র —এমন দুটি বা তিনটি বর্ণের অক্ষরও ১ মাত্রা পাবে । সোজা কথা, শব্দের মাঝে অথবা শেষের যুক্তাক্ষর মাত্রাবৃত্তে ২ মাত্রা পাবে। শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর থাকলে ১ মাত্রা-ই পাবে।
রবীন্দ্রনাথ ‘মানসী’ পর্বের কবিতা থেকে এ ছন্দের সূচনা করেন। তাই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথই এ ছন্দের স্রষ্টা। ‘মানসী’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণমূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি।” পূর্ণ মূল্য বলতে তিনি মূলতঃ ২ মাত্রার মূল্যকেই ইঙ্গিত করেছেন।
নিচের উদাহরণটা লক্ষ্য করি:
এইখানে তোর ∣ দাদির কবর ∣ ডালিম-গাছের ∣ তলে ∣∣ (৬+৬+৬+২)
তিরিশ বছর ∣ ভিজায়ে রেখেছি ∣ দুই নয়নের ∣ জলে ∣∣ (৬+৬+৬+২)
কবিতাটির মূল পর্ব ৬ মাত্রার। প্রতি চরণে তিনটি ৬ মাত্রার পূর্ণ পর্ব এবং
একটি ২ মাত্রার অপূর্ণ পর্ব আছে। মাত্রা গণনা করলে দেখা যাচ্ছে, প্রথম চরণের প্রথম পর্ব-
এইখানে তোর; এ+ই+খা+নে = ৪ মাত্রা
(প্রতিটি অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকায় প্রতিটি ১ মাত্রা);
তোর = ২ মাত্রা (অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকায় ২ মাত্রা)।
দ্বিতীয় পর্ব- দাদির কবর; দা+দির = ১+২ = ৩ মাত্রা;
ক+বর = ১+২ = ৩ মাত্রা।
তৃতীয় পর্ব- ডালিম-গাছের; ডা+লিম = ১+২ = ৩ মাত্রা;
গা+ছের = ১+২ = ৩ মাত্রা।
চতুর্থ পর্ব- তলে; ত+লে = ১+১ = ২ মাত্রা।
আবার:
গগনে গরজে মেঘ ∣ ঘন বরষা ০০০
কূলে একা বসে আছি ∣ নাহি ভরসা ০০০
রাশি রাশি ভারা ভারা ∣ ধান কাটা হল সারা∣
ভরা নদী ক্ষুরধারা ∣ খর-পরশা ০০০
কাটিতে কাটিতে ধান ∣ এল বরষা ০০০
উপর্যুক্ত কবিতায় ১ম, ২য়, ৪র্থ ও ৫ম পংক্তিতে আট মাত্রার একটি করে পূর্ণ পর্ব এবং পাঁচ মাত্রার একটি করে অপূর্ণ পর্ব রয়েছে।
ছন্দ বিন্যাসের অনুশীলনের সুবিধার্থে কৌতূহলী পাঠাকদের জন্য মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লিখিত আরো কিছু কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া হলোঃ
১।'দুই বিঘা জমি'---রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:
এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভুরি!
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
.........
আমি শুনে হাসি,আঁখিজলে ভাসি,এই ছিল মোর ঘটে!
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!
২। ‘মোহর্রম'---কাজী নজরুল ঈসলাম:
নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া -
আম্মা লাল তেরী খুন কিয়া খুনিয়া,
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে?
সে কাঁদনে আঁসু আনে সিমারের ও ছোঁরাতে।
.........
কত মোহররম এল গেল চলে বহু কাল,
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লহু-লাল।
..........
ফিরে এল আজ সেই মহরম মাহিনা
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা।
.........
৩। ‘নন্দলাল'---দ্বিজেন্দ্রলাল রায়:
নন্দর ভাই কলেরায় মরে, দেখিবে তারে কে বা ?
সকলে বলিল, “যাও না নন্দ, করো না ভায়ের সেবা।”
নন্দ বলিল, “ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই-
না হয় দিলাম, কিন্তু, অভাগা দেশের হইবে কী?
বাঁচাটা আমার অতি দরকার, ভেবে দেখি চারিদিক”
তখন সকলে বলিল- “হাঁ হাঁ হাঁ, তা বটে, তা বটে, ঠিক।”
৪। ‘উটপাখি’---সুধীন্দ্রনাথ দত্ত:
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূণ্যে চলবে না আগাগোড়া।
........
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।
অন্ধ হ'লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আমাকে এডিয়ে বাডাও নিজেরই ক্ষতি
ভ্রান্তিবিলাস সাজেনা দুর্বিপাকে।
৫। ত্রিশূলের সামিয়ানা---নেয়ামত ভূঁইয়া:
কোন অপরাধে হাসি ঝুলে আছে ফাঁসির দড়িতে, বলো!
পৃথিবীকে দেখে হাসে গ্রহ শনি প্লুটো বুধ মঙ্গলও।
কোন অপরাধে ঘাসের ডগায় শিশির জমতে মানা?
মুচলেকা দিয়ে ফরমাশে ক্যানো জ্বলবে শিশির কণা!
.........
কোন অপবাদে নিন্দা কুড়োবে পবিত্র মাতা মেরী?
কোন অপরাধে ছলাৎ জলের গলায় বাঁধের বেড়ি?
গৌরি সেনের খাজাঞ্চি থেকে কেনো লুট হয় সোনা,
পাখির উপর কেনো জারি হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা?
সে সবের কিছু এখনো হয় নি জানা;
কী করে জানবো, জানবো কী করে, আমার জানতে মানা—
মাথা গুঁজবার এতোটুকু ঠাঁই ত্রিশূলের সামিয়ানা।