‘ফিরে আসুক আমাদের সব রঙিন উৎসব’

সুজয় সরকার
| আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:২৫ | প্রকাশিত : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের যারা ছাত্র, তারা জানেন সরস্বতী পূজা ঘিরে আগের রাতে কী অদ্ভুত স্মৃতিময়তা, কী গভীরতর প্রাণের টান থাকে উৎসব নিয়ে। জগন্নাথ হলে যারা 'তিষ্ঠ ক্ষণকাল' ঘরানাতে হলেও এই উৎসবের আঁচ নিয়েছেন, তারাও জানেন কী অদম্য উত্তাপ এই উৎসবে। কিছুই হচ্ছে এসবের এবার।

এদিকে একদিন আগেই ছিল পহেলা ফাল্গুন, সাথে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বঙ্গীয় ক্যালেন্ডার দীর্ঘদিন পরপুরুষের ঘর করে অবশেষে নিজ স্বামীর গৃহে ফিরেছে দুবছর হল। আর এই গৃহ প্রত্যাবর্তনের রেশ ধরে হলুদ শাড়ি পড়া একলা ফাল্গুন সাথী করে নিয়েছে লাল-শার্ট পড়া ভ্যালেন্টাইন কে। গেলো বার ফাল্গুনী বেহায়ার মতো ভ্যালেন্টিনোর হাত ধরেছিল নাকি বেচারা ভ্যালেন্টিনো বেকুবের মতো ফাল্গুনী কে 'আ লা ভিউ' বলেছিল তা নিয়ে পূব পাড়ার ক্ষেন্তমাসী আর পাশের বাসার রোজী আন্টির ফেইসবুকে এক পশলা ঝগড়াও হয়ে গিয়েছে মাঝরাতে। সেই ঝগড়ার লাইক-কমেন্ট গুনে গুনে শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়ে সকালে সময় মতো দোকান খুলতে পারেনি শাহবাগের 'নিউ ক্যালিফোর্নিয়া গোলাপ ঘর'এর দোকানি শহর আলী ; বেচারার ব্যবসায় মন্দা। অথচ এবার লাল-গেঁন্দাফুল আর ভেলভেট টিউলিপ দিয়ে একটা লরেল ক্রাউন বানিয়ে মার্কেট একা দখলের কি ইচ্ছেটাই না তার ছিল!

না, এসবের কিচ্ছুটি হয়নি। শহর আলী ঠিকমতো দোকান খুলেছিল। লরেল ক্রাউনও বানিয়েছে বেশ। কিন্তু আগের বছরগুলোর মতো বিক্রি যে নেই। এ শহরের উৎসবের রঙ গুলো কি তবে তার সাত দিন আগে কিনে ফ্রিজে রাখা গাঢ় ম্যাজেন্টা গোলাপের মতো ফিকে হয়ে গেল!

করোনার কারণে সারা পৃথিবীর মতো এ শহরেও উৎসব আছে -উৎসব নেই ; রঙ থাকলেও ফিকেই।

"এবার বাঁচা গেছে দোস্ত, গত সাত বছর ফাল্গুন-ভ্যালেন্টাইন'স এ গার্লফ্রেন্ড কে শাড়ি আর গোলাপ দিতে দিতে ফতুর হয়ে গেছি!"

দোষ কি আমার পাঁচবছর হাফ-বেকার থাকা বন্ধুটিরই? আপনার আমার দোষ নেই?

যারা বিভিন্ন অজুহাতে বাঙালির সব উৎসবকে একটা ট্যাগ দিয়েছি তাদের আত্মা শান্তি পাচ্ছে না এখন? যারা প্রত্যেক 'দিবস' আসলেই "এটা-ওটা কোন দিবসে সীমাবদ্ধ থাকে না, আমাদের প্রতিদিনই হ্যানো দিবস", বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি, তাদের বেলা? নাকি আপনাদেরও এখন, "বুক চিন চিন করছে হায়!... "

বিশ্বাস করেন, আমার প্রত্যেকটা উৎসব ঠিকমতো না হলে 'বুক চিন চিন' করে ; হোক সে উৎসব বাঙালি বা বিহারির, পাহাড়ি বা পাড়া-প্রতিবেশির, মুসলিম বা হিন্দুর, খ্রীষ্টান বা ইহুদির।

উৎসবের মধ্যে একটা অফুরন্ত প্রাণ থাকে, একটা ফুরিয়ে যাওয়ার চিনচিনে ভার থাকে, 'আসছে বছর আবার হবে'র একটা টান থাকে; আর এই প্রাণ-ভার-টান মিলে গড়ে ওঠে একটু অদ্ভুত মৃতসঞ্জীবনী। এ যেন জীবনানন্দের "জীবনের স্রোত ভালোবেসে" বেঁচে থাকা "চারি দিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা"র প্রতিকূলে এক মশার জীবন।

ও হ্যাঁ, জীবনানন্দের দাশের এই 'আট বছর আগের একদিন' কবিতা মনে হলেই চোখে ভাসে পঞ্চমীর চাঁদের আলোয় একগাছা দড়ি নিয়ে অশ্বত্থের ডালে ঝুলে প্রাণ দেওয়া সেই হতভাগা যুবকের কথা। ইংরেজ কবি W H Auden বলেছিলেন "Poetry makes nothing happen."। তবুও, করোনাকালেই এই বঙ্গদেশে কত কত তাজা প্রাণ ঝুলে গেছে অশ্বত্থের ডালে তার পরিসংখ্যানটা জানেন তো?

কোনদিন অশ্বত্থের ডালে যাওয়ার প্রয়োজন হলে আমাদের ফিরিয়ে দিক এই হরেক রঙের উৎসবের ডালাগুলো, আমাদের মাথায় শোভা পেতে থাক ভ্যান্নাপাতার লরেল ক্রাউন অথবা লাল গেঁন্দাফুল। খুব দ্রুত ফিরে আসুক আমাদের সব রঙিন উৎসব, বিশ্বজননীর সব কচি উৎসবেরা।

ও হ্যাঁ, আজ বাণী-বন্দনা। শুভেচ্ছা জ্ঞানার্চনের, শুভকামনা জ্ঞানার্জনের জন্য; আর প্রার্থনা যদি করতেই হয় সে হোক,

"তমস্যা মা জোতির্গময়ঃ"

('অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাও।)

আসুন গান শুনি,

"ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি

এখানে থেমো না...

লেখক: সহকারী কমিশনার, ডিএমপি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :