গৌরবময় এক অভিযাত্রার শেষ পদক্ষেপ

প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:৫৬

মো. আনোয়ার হোসেন শামীম

স্বাস্থ্যকর্মী ভাই যখন প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিপর্ব সারছিলেন, আমার মন তখন মুহূর্তে ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে গেছে সিলেট র‍্যাব-৯ এর করোনা রেসপন্স টিমের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে থাকার স্মৃতিময় সেই দিনগুলোতে। আহা! আমার মানবজন্মের শ্রেষ্ঠতম সেসব দিন।

যেই কঠিন সময়ে সন্তান করোনা আক্রান্ত বাবা-মাকে জঙ্গলে ফেলে আসছেন, ভাইয়ের জানাজা দেয়ার জন্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ভাইকেও, পুরো দুনিয়া করোনা-ভীতিতে থরথর কম্পমান; সেই নিদানকালে আমি এবং আমার টিম এত বিপুল সংখ্যক করোনা রোগীর পাশে ভাইয়ের স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা নিয়ে দাঁড়াতে পেরেছি, মানুষের জন্য কাজ করার নেশায় মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করতে পেরেছি! একজীবনে একজন মানুষের আর কত কী চাওয়ার থাকতে পারে!

২৯ মে, ২০২০ মধ্যরাত। রাতের খাবার সেরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ করেই ভয়ংকর সংবাদটি আসে! আমার রানার সৈনিক হাসান ফোন করে জানায়, র‍্যাব-৯ এর সেদিনের পরীক্ষাকৃত সদস্যদের ৮০ শতাংশই করোনা পজিটিভ! অল্প জায়গায় বসবাসরত এতগুলো মানুষের জন্য এটা যে কত বড় বিপদের আভাস, তা বুঝতে পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

তার চেয়েও বড় কথা, করোনা-ভীতিতে আচ্ছন্ন এই কঠিন মুহূর্তে কে নেবে এই সম্ভাব্য বিপুলসংখ্যক মানুষের চিকিৎসা, দেখাশোনা, থাকা, খাওয়াসহ সার্বিক দায়িত্ব! সেই গভীর রাতের থমথমে আবহে সিও স্যারের বিশেষ জরুরি সভা আহ্বান। জানি না, সেসময় আমার ওপর কি ভর করেছিল, আমি উপস্থিত অফিসার-ফোর্সের  উপস্থিতিতে কোনোরকম ভাবনাচিন্তা ব্যতিরেকেই র‍্যাব-৯ এর করোনা রেসপন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট টিমের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির মহাগুরুভার গ্রহণে সম্মতি প্রকাশ করে দিই।

এরই মধ্যে র‍্যাব হেডকোয়ার্টার থেকে দুজন মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট চলে আসে। সাথে আমাদের র‍্যাব-৯ এর নিজস্ব ২ জন মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট। এই চারজনের সাথে অন্য আরো ৩ জন ননমেডিকেল সাধারণ র‍্যাব সদস্য মিলিয়ে প্রস্তুত হয় করোনা রেসপন্স টিম। কিন্তু সমস্যা বাধে অন্য জায়গায়। রোগীদের ওষুধ পথ্য খাওয়ানো থেকে শুরু করে দিনরাত তাদের সাথে অবস্থান করে সকল ম্যানেজারিয়াল ফাংশন সম্পন্ন না হয় করা গেল, কিন্তু রোগীদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করার জন্য ডাক্তার তো লাগবে! এমন কঠিন সময়, এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার কোথায় পাই! 

আমি ফেসবুকের নিকট কৃতজ্ঞ যে, আমার এই আইডির টাইমলাইনে 'একজন ডাক্তার' চেয়ে  পোস্ট করার পরই  আমি কাঙ্ক্ষিত সেই ডাক্তার (ডা. মো. কামরুল হাসান, ৪৮ ব্যাচ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ) ভাইকে পেয়ে যাই। খুব অল্প সম্মানিতে তিনি আমাদেরকে যেই সার্ভিসটা দিয়েছেন, যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত আমাদের সাথে করোনা ওয়ার্ডে অবস্থান করে রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করেছেন, আমি সারাজীবন ওনার নিকট কৃতজ্ঞতা পাশে বন্দি থাকব।

দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথমেই আমরা ফোর্স ব্যারাকের ৫ তলায় করোনা ওয়ার্ড স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে রোগীর চাপ এতটাই বেড়ে যায় যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার উপক্রম হয়। প্রতিদিন ২০-৩০ জন নতুন রোগীর আগমন ঘটছে। ৫ তলার প্রতিটি কক্ষ কয়েকদিনের মধ্যেই করোনা রোগীতে পূর্ণ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে ইসলামপুরের টেক্সটাইল মিল ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয় পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় থাকা হোম কোয়ারেন্টাইনড রোগীদেরকে। পাশের একটি কমিউনিটি সেন্টারও ভাড়া করে রাখি। দরকার পড়লে...।

প্রতি রুমে ১৩-১৪ জন করে রাখা করোনা রোগীদের মধ্যে আমরা কয়েকজন 'সুস্থ' মানুষ ডাবল পিপিই পরে দিনরাত ঘুরিফিরি, তাদের ওষুধ-পথ্য পৌঁছানো, খাওয়ানো  ও করোনা থেকে মুক্তি পাবার জন্য তাদের অবশ্য পালনীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর প্রতিপালন নিশ্চিত করি। ডাবল পিপিই পরে ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ঘামতে ঘামতে করোনা রোগীদের খাটে বসে তাদের দেখভাল করতে করতে ভাবি, এতগুলো রোগীর সুস্থতা আমরা নিশ্চিত করতে পারব তো!

জানি না, কেউ বিশ্বাস করবে কি না- এই পুরো সময়ে একবারের জন্যও আমার দুশ্চিন্তা হয়নি যে, দিনরাত করোনা রোগীদের সংস্পর্শে থাকতে গিয়ে আমিও না আবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি! জানি না, এই মহাবিশ্বের মহান অধিপতি কোথা থেকে আমার বুকে এত সাহসের সঞ্চার করে দিয়েছিলেন। শুধু একটাই সমস্যা মনে হতো, ডাবল পিপিই পরে থেকে দীর্ঘ সময় পুরো শরীর ঘামে জবজবে ভেজা থাকা। যারা কখনো  পিপিই পরেননি, তারা বুঝবেন না এই প্রায় বায়ুরোধী পোশাকের ভিতর পুরো দিনরাত কাটানো কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। আমি টিম সদস্যদের নিকট  কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, কেউ একটিবারের জন্যও না-শব্দ উচ্চারণ করেননি। তাদের জন্য সত্যিই আমি গর্বিত।

এর আগে মার্চের শেষাশেষি যখন দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের ঢেউ প্রথম আছড়ে পড়ে, তখন আমি শ্রীমঙ্গল র‍্যাব ক্যাম্পের কমান্ডারের দায়িত্বে। আমার সর্বান্তকরণ কৃতজ্ঞতা আমার অধীনস্থ র‍্যাব সদস্যদের প্রতি।  পুরো করোনাকাল জুড়ে তাদেরকে আমি রাতের ঘুম বা দিনের বিশ্রামটাও ঠিকমতো গ্রহণ করতে দিইনি। সারা দিন হোম কোয়ারেন্টাইন, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন অভিযানের পর রাতভর তারা আমার সাথে দূর-দূরান্তে ছুটেছেন হাতে, কাঁধে, মাথায় ত্রাণের বস্তা নিয়ে, যেসব এলাকায় গাড়ি চলাচলের পথ না থাকায় অন্যান্য সংস্থার ত্রাণ পৌঁছাচ্ছিল না, খুঁজে খুঁজে তাদের কাছে। আমার ক্যাম্প সদস্যদের বীরত্বের সাক্ষী পুরো মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জবাসী। এত পরিশ্রম, এত কষ্টের পরও একজন সদস্যও আমাকে বলেনি যে, ‘স্যার আমি পারব না’। কৃতজ্ঞতা তোমাদের প্রতি হে বীরের দল।

কোনো মধ্য রজনীতে শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজারের হাওরাঞ্চলের কর্দমাক্ত পথে নিজেদের বেতনের টাকায় কেনা ত্রাণের বস্তা কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিংবা অবসন্ন বিকেলে র‍্যাব-৯ এর করোনা ওয়ার্ডে ডাবল পিপিই পরে রোগীদের দেখভাল করতে করতে  কতবার আনমনে ভাবতাম, কবে আসবে এই করোনা রোগীর ভ্যাকসিন! কবে থামবে এই মারণব্যাধিতে আক্রান্ত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জনস্রোত! কেউ বলে ছয় মাসের মধ্যেই এসে পড়বে, আবার কেউ বলে কমসে কম দুই বছর।

আলহামদুলিল্লাহ, সময়ের পরিক্রমায় আজ আমি নিজেই সেই ভ্যাকসিন গ্রহণ করলাম। ২৪ ঘণ্টারও বেশি হয়ে গেল, সামান্য ব্যথা ছাড়া আর কোনোরকম অসুস্থতা বা খারাপ বোধ করছি না। অতি শিগগিরই  আপনাদের কাছেও নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে এই ভ্যাকসিন। সকলের প্রতি অনুরোধ থাকবে- কোনো চিন্তা নেই, ভ্যাকসিন নিন হাসতে হাসতে, নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে। করোনাভাইরাস নিপাত যাক, জয় হোক মানুষের, জয় হোক পৃথিবীর।

[করোনাকালে পৃথিবীবাসীর পক্ষে, করোনা নামের হিংস্র রাক্ষুসদের বিরুদ্ধে সামান্য ভূমিকা পালনের সুযোগ পাওয়া জনগণের নগণ্য এক চাকর।]

লেখক: সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি)

ঢাকাটাইমস/১৭ফেব্রুয়ারি/এসকেএস