ভূরুঙ্গামারীতে লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা, অবাধে শিশুশ্রম

মমিনুল ইসলাম বাবু, কুড়িগ্রাম
| আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৪:৩৮ | প্রকাশিত : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৪:৩৫

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষিজমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও নেই এসবের। শিশুশ্রম আইনত দন্ডনীয় অপরাধ হলেও ইটভাটাগুলোতে অবাধে চলছে শিশুশ্রম। ভাটার তপ্ত আগুনে পুড়ছে ফসলি জমির উর্বর মাটি। ইটভাটার কুন্ডলি পাকানো কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত কালো ধোঁয়ার বিষ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। যত্র তত্র ইটভাটার কারণে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এলাকার পরিবেশ।

উপজেলায় ইটভাটা আছে ১০টি। উপজেলা সদরের আশেপাশে এলকার কৃষিজমিতে এসব ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এগুলো হলো মেসার্স ফ্রেন্ডস ট্রেডার্স, খোকন ট্রেডার্স ১ ও ২ পিএসকে ও এল টি বিসহ আরো পাঁচটি।

ইট পুড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাহাড়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং লোকালয় থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। এছাড়াও কৃষিজমিতে ইটভাটা তৈরির আইনগত বিধি নিষেধ থাকলেও কৃষিজমি ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে এসব ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রায় সব ইটভাটাতেই ১৮ বছরের কমবয়সী শিশুরা ইট তৈরি ও পোড়ানোর কাজ করছে। স্কুল ও মাদ্রাসাগুলো বন্ধ থাকায় স্কুল পড়ুয়া কম বয়সী শিশুরা টাকার লোভে শিশুশ্রমে ঝুঁকছে। কম টাকায় শিশু শ্রমিক পাওয়ায় এতে ভাটার মালিকরাও সুযোগ নিচ্ছেন।

বৃহস্পতিবার সরেজমিন গিয়ে এর সত্যতাও পাওয়া গেছে। মেসার্স ফ্রেন্ডস ট্রেডার্সে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার পাটেশ্বরী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আবু বক্বর সিদ্দিক সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আশরাফ ভূরুঙ্গামারী সিনিয়র মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আরমান ও ২ নম্বর পাইকেরছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মোবারকসহ আরো অনেক শিশুকেই কাজ করতে দেখা যায়।

শিশুরা জানায়, তারা এক লাইন ইট উল্টালেই ৩০ টাকা মজুরি পায়। তারা প্রতিদিনই এই কাজ করে থাকে। ইটভাটায় শিশুরা কাজ করার বিষয়ে ফ্রেন্ডস ট্রেডাসের্র মালিক ফজলুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান। ভাটায় নিয়োজিত শ্রমিকদের নেই কোনো স্বাস্থ্য সুরক্ষাও।

ইটভাটাগুলোর আশপাশের এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ইটভাটায় বিপুল পরিমান ফসলি জমি নষ্ট করে ইট তৈরি করছে। বেশ কয়েকটি ট্রাক্টর দিয়ে কৃষি জমির টপ সয়েল (জমির উপরিভাগের মাটি) এনে ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

তাছাড়াও এসব ইটভাটার পাশেই আছে কৃষিজমি। ইটভাটার মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভাটা প্রতিষ্ঠাকালে এলাকাবাসী প্রশাসনের কোনো দপ্তরে অভিযোগ দিতে সাহস পায়নি। গত কয়েক বছর থেকে ভাটায় ইট উৎপাদন ও বিক্রির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসকের লাইসেন্সসহ কোনো কাগজপত্রই নেই।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করেই ভাটাগুলো চলছে। ভাটার পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে মাটি। ভাটার জন্যে ব্যবহারকারী ট্রাক ও ট্রাক্টরের ঘন ঘন যাতায়াতের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে পথচারীসহ স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এর কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ হচ্ছে বিনষ্ট, নষ্ট হচ্ছে ফসল।

ইটভাটা এলাকার কৃষক আশরাফ, করিম ও জব্বার মিয়া বলেন, কয়েকবছর আগেও এই জমিতে আমরা ফসল উৎপাদন করেছি। এখন সেখানে তৈরি করা হয়েছে ইট ভাটা। এতে শুধু কৃষি চাষাবাদ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভাটায় ব্যবহৃত চিমনি দিয়ে নির্গত ধোয়ায় কয়েকশ বিঘা ফসলি জমি হুমকির মুখে পড়েছে।

ভূরুঙ্গামারী উপজেলা ইট ভাটা মালিক সমিতির আহ্বায়ক ও কাজি ব্রাদার্স ব্রিক্সের স্বত্বাধিকারী কাজি মোস্তফা বলেন, আমার জানামতে পাঁচটি ইটভাটার লাইসেন্স আছে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর কারো ইটভাটার নবায়ন দিচ্ছে না। তাই চলতি বছর ভাটার কোনো লাইসেন্স নবায়ন হয়নি। শিশু শ্রমের বিষয়ে তিনি জানেন না বলে জানান।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এএসএম সায়েম বলেন, ইটভাটার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা স্বাস্থ্য বিধি না মেনে কাজ করলে তাদের শ্বাসকষ্ট, ডাচ এলার্জি ও ফুসফুসের সংক্রমনসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ বিস্তারের আশঙ্কা রয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, অপরিকল্পিতভাবে ইট ভাটা গড়ে ওঠায় বিপুল পরিমান কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। এসব ভাটায় ইট তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে ফসলি জমির টপ সয়েল। ফলে একদিকে কৃষক হারাচ্ছে বড় অংশের কৃষি উপযোগি জমি। অন্যদিকে ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদনের লক্ষমাত্রা পূরণ না হওয়ার সম্ভবনা দেখা দিতে পারে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মা বলেন, এ উপজেলায় ১০টি ইটভাটা রয়েছে। ভাটার লাইসেন্স ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয় জানেন। কোনো ইটভাটায় শিশু শ্রম থাকলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের সহকারি পরিচালক ইউছুফ আলী বলেন, ভূরুঙ্গামারী উপজেলার কোরো ইটভাটারই পরিবেশ অধিদপ্তরের হালনাগাদ ছাড়পত্র নেই। শুধুমাত্র খোকন ট্রেডার্স নামের ইটভাটার ১৭ জানুয়ারি ২০ সাল পর্যন্ত ছাড়পত্র ছিল। এখন একটিরই নেই।

ইউসুফ বলেন, ইতোমধ্যে আমরা কয়েকটি উপজেলায় বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়েছি। আমরা সব উপজেলাতেই এই ধরনের অভিযান চালাব। কেউ যদি আইন অমান্য করে ইটভাটা চালায় তা হলে সঠিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম বলেন, ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দশটি ইটভাটার মধ্যে সাতটির লাইসেন্স নবায়ন আছে। শিশু শ্রমের বিষয়টি নিয়ে মালিক সমিতির সভাপতিকে চিঠি দেয়া হবে। এর পরেও বিধিমালা লঙ্ঘন করে কেউ ইটভাটা পরিচালনা করলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

(ঢাকাটাইমস/১৮ফেব্রুয়ারি/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :