মনমাঝি তোর বৈঠা নেরে-আমরা যে আর বইতে পারছি না!

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:২৭

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ

সাম্প্রতিকালে দেশে-বিদেশে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো মনকে খুবই উতালা করে দিয়েছে। সেসব ভুলতে নানা চেষ্টা করছি। আর তাই খুব সকালে-বিকেলে মুক্ত বাতাসে একটু হাঁটা, রাতের চাঁদ দেখা, আকাশের তারা গোনা, আপনজনদের খবর নেয়া। কিন্তু ঘুরে ফিরে মন কেবল হিসেবের খাতা খুলে বসে।  কী পেলাম-কী দিলাম, কেন পেলাম না-বিষয়গুলো ঘুরপাক খায়। এই কী ও কেন সারাক্ষণ তাড়া করে আমাদেরকে। যুক্তি ও আবেগের খেলা। এরই মাঝে সকালবেলা টিভির পর্দায় দেখলাম – ‘Sex scandal in [অস্ট্রেলিয়া] Parliament house worsens’- অপেক্ষায় থাকলাম এবং এর পরেই এলো আরেক পার্লামেন্ট স্টাফের অভিযোগ-ওই একই ব্যক্তির দ্বারা তিনিও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন! মন্ত্রী পার্লামেন্টে জবাব দিতে গিয়ে কাঁদছেন আর প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট বলছেন- তিনি জানেন না। তিনি যেভাবে বলছেন তা আরও কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে নিপীড়িত তরুণীকে। তিনি নতুন তথ্য দিয়েছেন।    

যে বিষয়টি নিয়ে লিখছি সেটা প্রায় দু'বছর আগে অস্ট্রেলিয়া পার্লামেন্ট ভবনে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অফিসে একটি কদাকার অমানুষ কর্তৃক তরুণ সহকর্মীকে ধর্ষণ করবার ঘটনা। ২৪ বছরের এই তরুণীর নাম ব্রিটনি হিগ্গিন্স। অনেক স্বপ্ন নিয়ে তিনি পার্লামেন্টে চাকরি নিয়েছিলেন। পুরান ছবিতে দেখা যায়, তিনি প্রধানমন্ত্রী খুব কাছেই ছিলেন।আলোর পাশেই অন্ধকার।

ব্রিটনি হিগ্গিন্সকে সেই জঘন্য ঘটনা মিডিয়াকে বলতে হলো বিচার পাবার আশায়। এক অবিশ্বাস্য ঘটনা- দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অফিসে এমন ঘটনা! আরও অবিশ্বাস্য বিষয় হলো, মন্ত্রী এই ঘটনাকে চাপা দিতে চেষ্টা করেছেন নির্বাচন ভরাডুবির আশংকায়। এমনকি ফেডারেল পুলিশ জেনেও এগিয়ে আসেনি। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মন্ত্রী তার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও শেয়ার করেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু ব্রিটনি হিগ্গিন্স-এর টেক্সট মেসেজ প্রমাণ করছে প্রধানমন্ত্রীর অফিস বিষয়টি সাত দিনের মধ্যেই জেনেছে। ক্ষমতা- নাকি ক্ষমতাহীনতা- নাকি ক্ষমতার লোভ- বিবেচনার বিষয়। শুনেছি ক্ষমতার মোহে নাকি মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। 

এই তো ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছুদিন আগে ওই দেশের ক্যাপিটল হিল কীভাবে সমর্থকদের দিয়ে তছনছ করালেন। আরেক মহাশক্তি রাশিয়া কীভাবে বিরোধী মতের মানুষদেরকে মোকাবেলা করছেন তা আমাদেরকে ভাবনায় ফেলে দেয়। আমরা এই একবিংশ শতাব্দীতে আসলে কতটুকু উন্নত হয়েছি বা কতটুকু সভ্য হয়েছি সেই প্রশ্ন করা যায় কি?

একদিকে বেলারুশের জনগণ তাদের সরকারপ্রধানের পদত্যাগ চাইছে-অপরদিকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পরে যখন জার্মান চ্যান্সেলার এঞ্জেলা মার্কেল বিদায় নিতে চাইছেন তখন দেশবাসী কাঁদছে। সুচিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য মিয়ানমারের জনগণ আন্দোলন করছে। সেই ক্ষমতার কাছে সারেন্ডার এখন বিশ্বব্যাপী প্রকট। কোভিড মহামারির যেন ক্ষমতার কাড়াকাড়ির বিষয়টিকে উসকে দিয়েছে। ঠিক সেই সময়ে রাজ পরিবার ছেড়ে হ্যারি ও মেগান ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে রাজপরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন। পৃথিবীর এই ভাঙা গড়ার খেলা চিরন্তন কি?

ক্ষমতার ইতিহাস বড় নির্মম। পৃথিবীর মানুষ জেনেও সেই মায়াবি আগুনের পেছনে ছোটে। চাই চাই যেন শেষই হয় না।অনেকে টাকাকে ক্ষমতা মনে করে। আর তাই টাকা বানানোর পেছনে ছোটে অনেকে। সেই ক্ষমতার তাড়না আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে দিচ্ছে। আমরা যে আর নিতে পারছি না? কীভাবে মনকে ফেরানো যায় প্রতিদিনকে খবরের শিরোনাম থেকে? এভাবে যদি দিনের পর দিন চলতে থাকে মানুষতো মানসিক রোগী হয়ে যাবে? একদিকে চরম অবিচার অপরদিকে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার পৃথিবীকে ওরা দিন দিন পাপ ও দীর্ঘশ্বাসে ভরে দিচ্ছে। করোনা ভাইরাস যেমন আমরা দেখি না, তেমনি এই অবিচার-অন্যায়কে আমরা দেখি না। তাই দেখি না মানুষের দীর্ঘশ্বাস।

সম্প্রতি বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে বলেছেন- আপনারা আমাদেরকে পিয়নদের হাতে সঁপে দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করুন। কতটা ক্ষোভের কথা এই মাননীয় বিচারকদের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো! ওনারা সমাজে আরও অনেক অসঙ্গতি দেখতে পান। কিন্তু সেগুলো নিয়ে কথা বলতে পারেন না হয়তো। যদি পারতেন তবে আরও অনেক অসঙ্গতি, অসত্য জাতি জানতে পারতো বৈকি! আজকাল কোনো কোনো মাননীয় বিচারক পত্রিকার খবর দেখে আমলে নিয়ে বিচার করেন। বিচারিক এই ক্ষমতা আমাদেরকে বিমোহিত করে। ইস- আমরা কেন এমন একজন বিচারক পেলাম না যিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রায় দিতেন ইনডিমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল। এই অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য কত না সংগ্রাম করতে হয়েছে। কত না রক্ত ঝরেছে। আমাদের বিচারব্যবস্থা কবে এমন সাহসী হবে জানি না- তবে আশার আলো দেখতে পাই। একদিন হয়তো আসবে- কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয় কথাটি পরম সত্য। গতকাল মঙ্গল গ্রহে একটি যান অবতরণ করেছে সাত মাস আকাশ ভ্ৰমণ করে। পরেরটি আরও ৫-৬ বছর পরে যাবে। আমরা আশায় থাকি।

সম্প্রতিকালের একটি সংবাদ- সরকার নাকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের কথা ভাবছে। আজ যে সত্য আমরা প্রকাশ করতে পারছি না, যে প্রশ্ন করতে পারছি না, যে স্বাধীনতা আমরা ভোগ করতে পারছি না- ওই সংশোধন যদি সেটা করতে সার্থক হয় তবে সেটি আনন্দের হবে বৈকি!

একটি আনন্দের সংবাদে যেন লক্ষ ফুল ফুঁটে উঠেছে। ভারী হয়ে উঠেছে বাংলার আকাশ-বাতাস। সকলে আনন্দের সংবাদের অপেক্ষায়! কেউ কি সেই আনন্দের সংবাদ দেবেন এই স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে।

পদ্মা ব্রিজের ৪১ তম স্প্যান লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দ বার্তা ছড়িয়ে ছিল সেরকম আনন্দর সংবাদ বুকটাকে হালকা করতে পারে।  শুদ্ধ চেতনার জাগরণের অপেক্ষায় জাতি। মহান ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষা বিজয়কে স্মরণ করিয়ে দেয়, পদ্মা ব্রিজ যেমন আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়- সেভাবে আমরা আগামী দিনগুলোকে অনুভব করতে পারি- আনন্দ ও সুখের কান্নায়। আমার বঙ্গবন্ধু আমাদের যে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছেন সেই মুক্তি কবে আসবে?

এই লেখা যখন লিখছি তখন আমার প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ। ছাত্ররা আশেপাশে মেস কষ্ট করে থাকে। তারা এক নিরাপত্তাহীনতার মাঝে আছে, গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিপতিত হয়েছে। আল জাজিরার ষড়যন্ত্র আর সংশ্লিষ্ট মহলের ব্যর্থতা জাতিকে কুর কুরে খাচ্ছে। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা কিংবা মিথ্যাকে সত্য বানানোর অবিরাম চেষ্টা চলছে। তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে আমরা আর বইতে পারছি না।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়