শেখ মুজিব ও দিনে দিনে ভাষা আন্দোলন

আব্দুল্লাহ আল হাদী
| আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২১, ২১:০৯ | প্রকাশিত : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:৫৪

২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারির আগের রাত। এরআগে শেখ মুজিব ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে বন্দি ছিলেন। এরপর ফরিদপুর কারাগারে, ঢাকা মেডিকেলে বন্দি অবস্থাতেই রাতে হাসপাতালে গোপনে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজসহ ছাত্রনেতারা তাঁর সাথে দেখা করতেন। তিনি ওই সব রাতেই তাঁদের পরের নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রনেতারা মুজিবের আগের নির্দেশনা মোতাবেক সকালেই সবকিছু গুছিয়ে ফেললেন। একদল ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপরীতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্র (১৪/৪ ভোট মতান্তরে ১৪/৩) ছোট হয়ে যেতে থাকতে লাগল। সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। আগের রাতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত বহাল থাকল। মিছিল শুরু হলো। মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা আরো কয়েকজন গুলিতে উর্ধমুখি কৃষ্ণচূড়ার তলায় বাংলা ভাষার দাবিতে বুক পেতে দিল।

ঢাকায় গুলি হয়েছে, ছাত্ররা মারা গেছে। দেশের মধ্যে একটা নীরব ক্ষোভের পরিস্থিতি তৈরি হলো।

এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। একটানা প্রায় ২ বছর ৫ মাস পর জেল থেকে শেখ মুজিব মুক্তি পেলেন এবং মুক্তির পর একটু সুস্থ হয়ে উঠতে না উঠতেই ২৭ এপ্রিল তিনি ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সম্মেলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন।

বলতে গেলে শেখ মুজিব ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের এই মরণকে সাধারণ মরণ থেকে দিনে দিনে পৃথক করে তুললেন। তিনি তাঁর প্রতিবাদে, বক্তৃতায়, স্লোগানেসাংগাঠনিক কর্তব্যে ভয়হীন হয়ে গেলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই ভাষা আন্দোলন হয়ে উঠল আপমর বাঙালির নিজেদের প্রাণের দাবি।

শেখ মুজিব তাঁর ১৯৫২ এর কারামুক্তির পর পরই মে মাসের শেষের দিকে করাচিতে ও লাহোরে যান। সেখানে তিনি প্রেস কনফারেন্সে প্রথমেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে ঢাকার বাইরে প্রথম বিস্তারিত কথা বলেন, তুলে ধরেন রূপ রেখাসহ বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষায় অন্তর্ভুক্তি করনের দাবি। তার অংশ বিশেষ ছিল এরকম-

in the year 1948, Khawaja Nazimuddin, the then Prime Minster of East Pakistan during the first State Language movement entered into a written agreement with the committee of Action to give Bengali the status of state language along with Urdu. But the same gentleman, while making of a speech at Dacca Maidan on the 27th of January, threw his pledge to the wind and declared that Urdu shall be the only State Language of Pakistan. Thus creates terrible resentment in the mind of the people particularly the intelligential who had suffered during the 1948 movement. You are certainly aware of that followed thereafter and how several valuable lives were lost before the bullets of the Nazimuddin government.’

[(Sheikh Mujibur Rahman -Karachi, 30 may 1952) Secret Document Of Intelligence Branch on Father Of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, vol-2, page- 217]

এর আগে সিক্রেট ডকুমেন্টের শুরুতেই দেখা যায়, জানুয়ারি ১৩, ১৯৪৮ দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউজের সামনে কিছু অপরিচিত কর্মী শেখ মুজিবুর ও নইমুদ্দিন আহমেদের নাম সম্বলিত বুকলেট বিক্রি করছেন। তাতে লেখা ‘পূর্বব-পাকিস্তানে দুর্ভাগা জনসাধারণের কৈফিয়ত দিতে হবে আমাদের দাবি।’ আরেক দল স্লোগান দিচ্ছেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ‘আমাদের দাবি মানতে হবে।’

[Secret Document Of Intelligence Branch on Father Of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, vol-1, page- 04]

তার আগে শেখ মুজিব ৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানে ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে তাঁর অন্যতম দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা।

এর এক পর্যায়ে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা প্রদান ও সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ছাত্রদের মধ্যে হৈচৈ শুরু হয়।

এরপর ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তমুদ্দিন মজলিসের আহবানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এ ধর্মঘটে শেখ মুজিবুর তাঁর সাহসী ভূমিকা রাখেন। ওইদিন মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন শেখ মুজিব নিজেই। এরপর ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমুদ্দিন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথসভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়।

পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে পূর্ব বাংলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং ঢাকায় সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট পালনের সময় শেখ মুজিব সচিবালয়ের গেটের সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন, সে সময় তাঁর সাথে ছিলেন শামসুল হক, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, শাহ্ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ।

এর আগে তিনি (মুজিব) তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্যদের দিয়ে বাংলা ভাষার দাবীতে লিফলেট বিতরণ করিয়েছিলেন, ৪ মার্চ ১৯৪৮ একটা গোয়েন্দা তথ্যে তা উঠে আসে এরকমভাবে-

‘I have the honour to report the particulars of the members of the provincial organising committee of East Pakistan Muslim Students League as follow. They were the signatories the leaflet which advocate Bengali to be the state language for Pakistan.

SK. Mujibur Rahman s/o SK. Lutfar Rahman of Tungipara, Faridpur. Student 1st Yr. B.L., Dacca University, attached to S.M Hall, at present c/o Kamruddin Ahmed, 150 Moghultuli, Dacca. [Secret Document Of Intelligence Branch on Father Of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, vol-1, page- 06]

১৯৪৮ এরও আগে অর্থাৎ ভারত পাকিস্তান ভাগ হওয়ার আগে ও পরে অনেকেই যেমন আব্দুল হাকিম, ড. মো. শহিদুল্লাহ, প্রমথ চৌধুরী, হুমায়ুন কবির, মিজানুর রহমান, আব্দুল হক, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, মওলানা আকরাম খাঁ প্রভূত স্কলারগণ তাঁদের লেখায় মাতৃভাষা বাংলার উপযোগিতা, আবেগ, অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। এরকম আরো অনেকে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁদের প্রেম সমর্পণ করেছেন, তখন রাজনৈতিকভাবে নামমাত্র গড়ে ওঠা সংগঠনগুলো যেমন গণআজাদী লীগ, পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টি, কিংবা অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোও তাঁদের বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। সে সময়ে বয়সে তরুণ হয়েও শেখ মুজিব ঐ সকল বাঙালি স্কলারদের লেখায় নৈতিক সমর্থন জুগিয়ে গিয়েছেন নানাভাবে।

জানা যায়, বাংলা ভাষার সমর্থকরা ভারতভাগের পূর্বেই উর্দুর বিরোধিতা শুরু করেন এবং ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সভ্যরা উর্দুকে ভারতের মুসলিমদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা মনোনয়নের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু আবার বিতর্কটি শুরু হয় যখন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম নিশ্চিত হয়।

৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। গাজীউল হক তাঁর ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করছিলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’

প্রস্তাবগুলো ছিল ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেয়া হোক। জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গৃহীত হোক।’ এভাবেই ভাষার দাবি শেখ মুজিবের কণ্ঠে প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল।

মুজিব ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং সে সময়ের বিভিন্ন মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। জানা যায়, মুজিব ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত মিছিলে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দেন।

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসেই ১৪জন সমকালীন নেতৃত্বদানকারী সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবিসংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেন। ওই ইশতেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ঐতিহাসিক এই ইশতেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয় যার নাম দেওয়া হয় ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল।’ এই ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন এর অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।

১৯৫২ পার হয়ে গেছে, ইতোমধ্যে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন, দায়িত্ব পেয়ে তিনি সারা পূর্ব বাংলার পাড়া-মহল্লা- লেন-টাউন-গ্রাম-হাটে-পথে-প্রান্তরে তাঁর সংগঠন বুনে যেতে লাগলেন আর মানুষের চোখে চোখ দিয়ে জানিয়ে দিয়ে যেতে লাগলেন পশ্চিম পাকিস্তানে বসে থাকা তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা, রাজবন্দিদের উপর সরকারের জুলুম, অশুভ জমিদারি প্রথা, দুর্ভিক্ষাবস্থা, চাপানো কর্ডন সিস্টেম, অন্যায্য বিপিসি সিস্টেম, নানা অপশাসনসহ অনেক ধরনের শোষণ।

সর্বপরি রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি বাঙালিদের আদায় করে নিতে হবে।

বঙ্গবন্ধু সুযোগ পেলেই চেয়েছেন তাঁর নিরীহ বাঙালিদের মনের গোপন ইচ্ছাটুকু অর্থাৎ বাংলা ভাষার ব্যবহারকে সামনে নিয়ে আসতে। আর সেটি তিনি নানা উপায়ে প্রয়োগ করেছেন। ভাষা আন্দোলনের পরপরই তরুণ জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্সে পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নয়াচীন সফর করেন।

সেখানে অনেকে ইংরেজিতে বক্তৃতা করলেও সেখানে তিনি ও মনোজ বসু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন। তাঁর বাংলা ভাষার এ ভাষণটি ছিল দেশের বাইরে অবাঙালি ভূখণ্ডে প্রথম কোনো বাঙালির বাংলা ভাষণ। সেই ভ্রমণের এক জায়গায় তিনি বিষয়টি উল্লেখ করেছেন এভাবে-‘আমাদের সভা চললো, বক্তৃতা আর শেষ হয় না। এত বক্তৃতা দেয়ার একটা কারণ ছিল। প্রত্যেক দিন সভায় যে আলোচনা হয় এবং যারা বক্তৃতা করেন তাদের ফটো দিয়ে বুলেটিন বের হয়। এই লোভটা অনেকেই সংবরণ করতে পারেন নাই।

‘আর আমার বক্তৃতা দেয়া ছিল এই জন্য যে, বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিব।" (আমার দেখা নয়াচীন -শেখ মুজিবুর রহমান।পৃষ্ঠা- ৪৪)

এরপর ১৯৫৩ সালে দেশব্যাপী বৃহৎ পরিসরে প্রথম ভাষা শহীদ দিবস পালনের ডাক দেন তিনি, আর জনগণের সংগঠন বলতে আওয়ামী লীগই কেবল তখন শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে উঠে দাঁড়াচ্ছে। শেখ মুজিব তাঁর সাংগঠনিক জেলাগুলোতে চিঠি দিলেন ভাষা শহীদ দিবস পালনের নির্দেশ দিয়ে। কালো পতাকা দেখানো হলো। আব্দুল ওয়াদুদ পাটোয়ারী, আতাউর রহমান, কাজী গোলাম মাহাবুব, শওকত আলী, প্রাওসু সমাদ্দার, সওহার আলী, খন্দকার মোস্তাক, গাজিউল হক, খন্দকার মো. ইলিয়াস (সম্পাদক- যুগের দাবী) প্রমুখসহ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৫/২০ হাজার মানুষের মিছিল আরমানিটোলা ময়দানে শেষ হলো। শেখ মুজিব বক্তৃতায় বললেন -‘এটা আমাদের ভাষার দাবি নয়, এটা আমাদের বাঁচার দাবি।’

[Secret Document Of Intelligence Branch on Father Of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, vol-3, page- 86,87]

একটি প্রতিজ্ঞা জোরালো সামাজিক রাজনৈতিক পটভূমি নিয়ে উদিত হলো।

এভাবে দেখা যায় তিনি ১৯৫২-১৯৫৩ পুরো সময় ধরেই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিং, চাঁদপুর, চট্রগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা, যশোর, কুষ্টিয়াসহ দুর্বার সাংগাঠনিক সফর করেন এবং সব জায়গাতেই তাঁর অন্যন্য বক্তব্যের সাথে সাথে শেষ কথা একটাই -ভাষা শহীদের রক্ত বৃথা হতে দেয়া যাবে না। এবং তিনি এও বললেন পূর্ব বাংলায় উর্দুকে বয়কট করা হবে, যদি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া না হয়। মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনি জাগরণের স্লোগান দিয়ে যেতে লাগলেন।

এরকমটা চলতে থাকলে একপর্যায়ে ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে একটা চিঠি লিখলেন, চিঠিতে বাংলা ভাষা বিষয়ক অংশটুকু ছিল এরকম- 'Hence you can well realise that you are antagonising the whole of West Pakistan by demanding that Urdu should be boycotted, or that you will start Direct Action. I do not think that anybody has given you the authority to threaten such a serious course of conduct as direct action. Therefore, while you press your claims for Bengali, you must not attack Urdu.’

[Secret Document Of Intelligence Branch on Father Of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, vol-3, page- 390]

এধরনের অনেক বিষয় বঙ্গবন্ধু অনায়াসে পাশ কাটিয়ে লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন শেষ পর্যন্ত, নতুবা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যার প্রমাণ আমরা বাংলা ভাষার জন্য সোহরাওয়ার্দীর পরবর্তী সমর্থনে দেখতে পাই।

একটি জাতির বেঁচে থাকার যুগ যুগের প্রবাহ হচ্ছে তাঁর ভাষা, বঙ্গবন্ধু তাঁর বাঙালি মানুষদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য হয়ত তিনি দৈনন্দিনভাবেই জীবিত ছিলেন বিশেষ মানুষ হিসেবে।

চাপিয়ে দেয়া খোঁড়া ইসলামী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বঙ্গবন্ধু বাংলাভাষাভিত্তিক বৃহৎ শোষিত বাঙালি মননে জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক স্ফূরণ ঘটিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীনের পর তিনি (বঙ্গবন্ধু) ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন।

১৯৫২ থেকে ১৯৯৯, ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলো।

১৯৫২ এর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেল। পৃথিবীর সকল মাতৃভাষা যেন মুক্তি পেল। এবং বছরের পর বছরে বঙ্গবন্ধুর সেই লালিত ভাষা আন্দোলন হয়ে উঠল বাঙালির আজন্ম গৌরবের। আজ বাঙালি তাঁর বাংলা ভাষায় যেমন পৃথিবীর বড় স্বপ্নটুকুও দেখতে পারে।

লেখক: কবি ও সাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :