মাতৃভাষার আবেগ ও চর্চা: বাংলাদেশ ও কোরিয়া

মোহাম্মদ হানিফ, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে
 | প্রকাশিত : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০১:০৬

মাতৃভাষায় মনের ভাব, আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশের অধিকার সমুন্নত রাখতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার নজির কেবল বাংলাদেশেরই আছে। বাংলাই সেই গৌরবান্বিত ভাষা। ভাষা মানুষের অস্তিত্বে যেমন বিরাজমান, তেমনি বিরাজমান প্রকৃতির অস্তিত্বেও। তাই তো সবাই নিজের মতো করে কথা বলে বিচিত্র ভঙ্গিমায়, নানা ইশারায়। ভাষা আছে বলেই এত প্রাণচঞ্চল ও আনন্দময় এই পৃথিবী। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে যখন দেই চোখ মেলি, আমাদের দৃষ্টির সীমানায় মানুষ, বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি তথা বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি জগৎ। শুনতে পাই মানুষ ও প্রকৃতিজগতের বিচিত্র ভাষা।

ভাষা বিশ্বময় সর্বত্র যোগাযোগের সেতু। আন্তর্জাতিক যোগাযোগে মাতৃভাষার পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ইংরেজি, আরবি, কোরিয়ান, জাপানিজ ইত্যাদি ভাষা শিক্ষা ও পারদর্শিতা হাজারো সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে বাংলাদেশিদের জন্য। দিন দিন বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের পথ প্রসারিত হচ্ছে, যা জীবন ও জীবিকার কাজে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। পৃথিবী নামের গ্রহে প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আমাদের প্রবাসীরা মাতৃভাষার পাশাপাশি কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী হয়ে থাকেন। ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের লোকেরা স্বীকার করতে বাধ্য হতো যে বাঙালি মেধাবী জাতি। এটি ভিনদেশে জীবিকার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার এটাও ঠিক, তৃপ্তি নেই সেই শব্দচয়নে যদি না থাকে বাংলা। বিদেশের মাটিতে চলার পথে হঠাৎ কোথাও থেকে যদি একটি বাংলা শব্দ ভেসে আসে, তখন কলিজাটা অনেক বড় হয়ে যায়। মাতৃভাষার প্রতি প্রবাসীদের আবেগ জড়ানো অন্য রকম একটি টান।

এ তো গেল প্রবাসে বাঙালির মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার কথা। কিন্তু দেশে এই বাঙালিই কি সেই আবেগ লালন করেন দৈনন্দিন জীবন কিংবা দাপ্তরিক কাজে?

চলছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। আজ ২১ তারিখে আমরা স্মরণ করছি তাদের, যাদের রক্তে কেনা আমার মাতৃভাষা বাংলা পেয়েছি। আজ বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে একটাই সুর ধ্বনিত হবে, 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি?’ দিনটিকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করায় বাংলাদেশিদের পাশাপাশি ভিনদেশিরাও এদিন গাইবে এই গান। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে অনেক গৌরবের। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ২১ ফেব্রুয়ারির পরের দিনই আমরা বাংলাদেশিরা ভুলে যাই বাংলা ভাষার কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা ও শুদ্ধ প্রয়োগ।

আমি বেশ কয়েক বছর ধরে কোরিয়ায় আছি। বাংলাদেশ ও কোরিয়ার মানুষের মাতৃভাষার প্রয়োগের তুলনামূলক বিচার করলে অবাক না হয়ে পারি না। আর ভেতরে ভেতরে নিজেকে সংকুচিত লাগে। মাতৃভাষার প্রতি কোরিয়ানদের ভালোবাসা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ দেখে তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে আমার মন।

কোরিয়ার জাতীয় ভাষা হ্যাঙ্গুল। প্রতি বছর ৯ অক্টোবর হ্যাঙ্গুল ডে (কোরিয়ান ভাষার দিন) পালন করা হয়। কোরিয়ার ভাষা তৈরি করেছেন কিং সেজং। কোরিয়ানরা কেবল একটি ভাষাতেই কথা বলে ও লেখে। বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী অনুসারে তারা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে, তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় আপনি সারা দেশে একটি মাত্র ভাষা পাবেন। পার্থক্যটি হলো স্পিকিং অ্যাকসেন্ট বা ডায়ালেক্ট কিছু আলাদা। কোরিয়ানরা তাদের ডাকে 사투리 (সাথুরি)। রাজা সেজং নিজে হ্যাঙ্গুয়েলের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘একজন জ্ঞানী ব্যক্তি সকাল শেষ হওয়ার আগেই হ্যাঙ্গুলের সাথে পরিচিত হতে পারবে এবং একজন বোকা লোক মাত্র দশ দিনের মধ্যে এই ভাষা শিখতে পারে।’

কোরিয়ানরা এই দিনে সেজং রাজার কথা স্মরণে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। তবে শুধু আয়োজনের মধ্যে তারা সীমাবদ্ধ নয়। দেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, শিল্প-কলকারখানা থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে। ইংরেজি ভাষার ব্যবহার একদম নেই বললেই চলে। তারা ইংরেজি জানলেও খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করে না। আপনি যদি তাদের মোবাইল ফোন নম্বর জানতে চান, তাও তারা তাদের ভাষাতেই বলবে, যা আমরা ইংরেজি ছাড়া বলি না। সাধারণত আমাদের কেউ ফোন করলে আমরা ফোনটা ধরেই বলি hello ‘হ্যালো’। কোরিয়ানদের কখনো এই শব্দ ব্যবহার করতে দেখিনি। ফোনটা ধরেই তাদের ভাষায় 여보세요 (ইয়ভোসেইউ) বলে থাকে। এখানে ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন বা ওষুধের ব্যবস্থাপত্রটিও কোরিয়ান ভাষায়। আর ওষুধের মোড়কের গায়ে ভাষাটিও তাদের নিজস্ব। তাদের ভাষার সফটওয়্যার দিয়েই তারা কম্পিউটার ব্যবহার করে থাকে। ভিনদেশি নয় নিজের ভাষাকে সহজ ও ছোট করে বলতে কোরিয়ানরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এক কথায়, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও তার প্রয়োগের অনন্য দৃষ্টান্ত দক্ষিণ কোরিয়া।

বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ থেকে শুধু কোরিয়ান ভাষায় দক্ষ ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ঠাঁই হয় কোরিয়ায়। ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশেষ চুক্তিতে কোরিয়ান ভাষা শেখার মাধ্যমে ১৩ হাজারের বেশি বাংলাদেশির বসবাস এই কোরিয়াতে।

বিশ্বের যেখানেই বাংলা ভাষাভাষী আছে, সেখানেই আছে আমাদের গৌরবের শহীদ মিনার। তবে স্থায়ী হোক আর অস্থায়ী হোক, বিদেশের মাটিতে বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশিদের গৌরবের মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকাটাই সম্মানের। রাজধানী সিউলের অদূরে আনসান শহরে কোরিয়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক শহীদ মিনার। এই স্থায়ী মিনার বাঙালিসহ অন্যান্য ভিনদেশি ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। প্রতি বছর কোরিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসীরাসহ বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়।

আমাদের মাতৃভাষা চর্চা নিয়ে কত অবহেলা! বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষা তৈরি করছি আমরা৷ আর ইংরেজির মতো করে বাংলা শব্দ উচ্চারণের প্রবণতা৷ এই প্রবণতা টেলিভিশন, এফএম রেডিও থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকট আকার ধারণ করছে৷

আমাদের দেশে এক শর বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে৷ এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটির নাম বাংলায়৷ বাকি সব কটির নাম ইংরেজিতে৷ এই নাম দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কি না৷ পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে আইন করে বলে দেওয়া আছে নেপালি ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম থাকতে পারবে না৷ অন্যথা হলে সরকারের অনুমোদন পাবে না৷

দেশে পরীক্ষায় যে ছেলেমেয়েটি ইংরেজিতে ‘এ’ প্লাস পায়, সে নাকি বাংলায় ফেল করে। যদি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দিকে তাকাই, চিত্র একই। বাংলা চলচ্চিত্রের নাম ইংরেজি। অনেক গানের কথায়ও একই অবস্থা। এটা আমাদের সংস্কৃতির জন্য বড় দুঃখের কারণ হচ্ছে। অপ্রিয় হলেও সত্য, বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ডের নামটিও ইংরেজিতেই সমধিক পরিচিত। চলচ্চিত্রে ইংরেজি নাম বাতিল করার পাশাপাশি সেন্সর বোর্ডের নামও পরিবর্তন করে বাংলায় করা উচিত। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে এখন বিদেশের অপসংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে, তাই ভাষাগত পরিবর্তনও দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে ভাবতে হবে।

কিছু মানুষ দেখা যায় বক্তৃতা, টক শো কিংবা ইন্টারভিউতে অর্ধেক ইংরেজি, অর্ধেক বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন। মনে হয় যেন তাদের মাতৃভাষাটা ইংরেজি, অনেক কষ্ট করে বাংলা বলছেন।

বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের আইন আছে৷ সংবিধানেও বলা হয়েছে রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা৷ অথচ এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা যায়নি৷ বিশ্লেষকরা এ ক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করছেন৷ সমস্যা পরিভাষার নয়, ইচ্ছাশক্তির।

আমাদের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত হওয়া উচিত। পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় জোরালো উদ্যোগে আমাদের সেই ১৯৫২-র আবেগ, দেশপ্রেম, আত্মমর্যাদাবোধ আর শহীদের রক্তে রাঙা ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ অক্ষুণ্ন রাখা সম্ভব। তাই মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে কবির ভাষায় বলা যায়, ‘মধুর চেয়েও আছে মধুর, সে যে আমার মাতৃভাষা/ মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।’ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনই হতে পারে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ উপায়।

লেখক: কোরিয়া প্রবাসী সাংবাদিক। ঢাকাটাইমসের দক্ষিণ কোরিয়া প্রতিনিধি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :