একজন সৈনিকের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ

বিভাষ দাস, চিতলমারী (বাগেরহাট)
 | প্রকাশিত : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৪:১৭

জীবনের প্রায় ৯০ বছর পেরিয়ে এখন জীবন মৃত্যুর সদ্ধিক্ষণে প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও ভাষা সৈনিক সৈয়দ নূরুল হক। বাগেরহাটের চিতলমারীর কুনিয়া গ্রামে বসবাস করেন এই সৈনিক। তার পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকায় নিজ বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। অবশ্য তাকে সাহায্যের জন্য ওই বাড়িতে রয়েছেন কিছু কাজের লোক।

এ সৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়ে দেখি তিনি ঘাসকাটা যন্ত্র নিয়ে নিজের তৈরি ফলবাগানে পরিচর্চার কাজে ব্যস্ত। এ বয়সেও সব কাজ তিনি নিজেই করেন। আলাপচারিতায় ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করছিলেন ভাষা সৈনিক সৈয়দ নূরুল হক।

তিনি বলেন, ‘১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগদান করতে এসে পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন বাংলার পরিবর্তে উর্দুই হবে পূর্ববাংলার রাষ্ট্র ভাষা। এই ঘোষণার প্রতিবাদে সমগ্র বাঙালি জাতি ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকাশহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে সে আন্দোলন। আমি যখন বরিশাল বিএম কলেজে পড়াশুনা শুরু করি তখন থেকেই এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। অকুতোভয় সকল বন্ধুদের নিয়ে নানা রকম কার্যক্রমে সক্রিয় হই। বৃহত্তর আন্দোলনের পরিকল্পনায় সামিল হই। ১৯৫২ সালে আমি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আমার ছাত্র বন্ধুদের আন্দোলনে গুলি চালানো হয়। এতে কয়েকজন বন্ধু শহীদ হন। তারা মায়ের ভাষার জন্য রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে। পরদিন থেকেই আমরা ছাত্ররা পথে নেমে যাই। তীব্র আন্দোলনে শহর কাপিয়ে তুলি। আমাদের মূল স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।’ এক সময় পাকিস্তানী সরকার আমাদের আন্দোলনের মুখে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। আমরা বিজয়ের আনন্দে সামিল হই। তবে, তখনকার সেই সংগ্রামী বন্ধুদের নাম বয়সের কারণে এখন আর মনে করতে পারিনা।’

এক পর‌্যায়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে এই সৈনিক আরো বলেন, ‘এতকিছুর পরও চলছে বাংলা ভাষার প্রতি চরম অবজ্ঞা। এ অবজ্ঞা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘পরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ১৯৫৫ সালে এমএ পাশ করি। সেখানেও পরবর্তী আন্দোলনের সঙ্গে সামিল থাকি। প্রাক্তন ভিসি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক এমাজ উদ্দিন আহম্মেদ এবং প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আমার খুব কাছের এবং প্রিয়বন্ধু ছিলেন। আমাদের একইসঙ্গে চলাফেরা ছিল সার্বক্ষণিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। বন্ধুর মত মিশতাম তার সঙ্গে। প্রায়ই দেখা-সাক্ষাত হত। ১৯৬১ সালে যখন আমি পিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি তখন বঙ্গবন্ধুকে একটু সাহায্যের কথা বলেছিলাম। কিন্তু তিনি বলেছিলেন দেখ ভাই, আমি বিরোধী দলের নেতা। আমি কোথাও তোমার কথা বলে দিতে গেলে তোমার উল্টা ক্ষতি হতে পারে। তার থেকে তুমি আল্লাহর নাম নিয়ে নিজেই পরীক্ষায় অংশ নাও। তার কথামত আমি তাই করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর তখনকার কথা শুনে মনে হয়েছিল তিনি খুব ধর্মভীরু ছিলেন। খুব খুশি হয়েছিলাম আমি।’

এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ নূরুল হক বলেন, ‘আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। তবে যে ভাষার জন্য এত শ্রম, আন্দোলন ও সময় ব্যয় করেছি তার অপব্যবহার দেখলে খুব কষ্ট হয়। চাই ভাষার প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল হোক। ভাষার আরো উন্নতি হোক। অপব্যবহারকারীদের সাজার আওতায় আনা হোক। তাহলে আনন্দ পাব। আমার দেশপ্রেম, ভাষাপ্রেম সফল হবে। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনো আমার কেউ খোঁজ নেয়নি। তবে তাতে কোনো আক্ষেপ নেই।’

(ঢাকাটাইমস/২১ফেব্রুয়ারি/পিএল)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :