একুশ আত্মোপলব্ধি ও আমার গর্বের দিন

প্রকাশ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:১৩ | আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:৩১

দুর্লভ বিশ্বাস

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে বৃটিশ শাসন-শোষণের অবসানের সময় পূর্ববঙ্গ তথা যারা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী ছিলাম আমরাও ভেবেছিলাম এবার আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। আমাদের আর কেউ শোষণ করতে পারবে না। রাজনীতি অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে আমরা আমাদের অধিকার ফিরে পাব। এ আশায় আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে “জাগো মুসলমান-আন পাকিস্তান” শ্লোগানে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের আকাশ-বাতাশ মুখরিত করে তুললাম।

বৃটিশের শৃঙ্খল থেকে স্বপ্নের সেই পাকিস্তান আনার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ১৯৪৮ সালের ১৪ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনালে মি. জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতায় যখন বললেন একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, তখনই আমাদের সেই স্বপ্নে চির ধরতে শুরু করে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে মি. জিন্নাহর সেই ভাষণের সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন ছাত্রের নো নো বলার মাধ্যমে। সেই কয়েকজন ছাত্রের মধ্যে সে সময়ের শেখ মুজিব বর্তমানে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। এমনিভাবে শিক্ষা-দীক্ষায় সর্বক্ষেত্রে বাঙালিরা যাতে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে পাকিস্তানিরা সকল প্রকার অপতৎপরতা চালাতে থাকে। অন্যদিকে বাঙালিরা মাতৃভাষার ওপর আঘাত রুখতে সংগঠিত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৫২’র একুশ ফেব্রুয়ারি।

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন, ওইদিন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্মারকলিপি দেয়ার। পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের ওপর শোষণ-নির্যাতন অব্যাহত রাখার জন্য ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ কর্মসূচি সফলে অনড়। ভোর থেকেই ছাত্র-জনতা তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় জমায়েত হতে থাকেন। ১০ জন করে মিছিল আইন পরিষদের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। পাকিস্তানি পুলিশ কর্মসূচি পণ্ড করার জন্য ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে মুহুর্মুহু গুলি চালায়। এতে সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারসহ অনেকেই শহীদ হন। এ রক্তদানের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি “জাগো মুসলমান-আন পাকিস্তান” শ্লোগান দিয়ে অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত পাকিস্তান পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী অর্থাৎ বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য নয়। তাই একুশ আমার আত্মোপলব্ধির দিন। এ উপলব্ধি থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে একাত্তরে আমার স্বাধীনতা প্রাপ্তি।

এ একুশ আমার শুধু আত্মোপলব্ধির দিনই নয়, একুশ যে আমার গর্বের দিনও। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই ভাষার জন্য ১৯৬১ সালে আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় আন্দোলন হয়েছে এবং পুলিশের গুলিতে ১১ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু সে রক্তদানের কোন স্বীকৃতি মিলেনি। একইভাবে ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আত্মদানের ঘটনা ঘটেছে। এরও কোনো স্বীকৃতি নেই। কিন্তু আমার আত্মোপলব্ধির মহান একুশ শুধ্ ুজাতিরই নয়Ñআন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। ১৯৯৯ সালের ১০ নভেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে আমার একুশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই থেকে একুশ সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তাই একুশ আমার গর্বেরও।

লেখক: সাবেক কমান্ডার, মির্জাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ