অপরাধ রোধে বিশেষ ভূমিকায় কমিউনিটি পুলিশিং

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:২১ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:২৩

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস

এলাকায় সামাজিক অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা রোধে গড়ে তোলা কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বেশ কাজে দিচ্ছে। বিভিন্ন সমস্যা ও অপরাধ ঠেকাতে জনগণের সঙ্গে মিলে কাজ করার সুযোগ থাকায় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায়ও বিশেষ ভূমিকা রাখছে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম। জনগণ এবং পুলিশের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই পুলিশিং ব্যবস্থা রাজধানী ঢাকাতেও এলাকাভিত্তিক অপরাধ রোধে পথ দেখাচ্ছে।

কিশোর-কিশোরীদের অনেকেই এলাকাভিত্তিক গ্রুপ বা গ্যাং তৈরি করে সংঘটন করছে নানা অপরাধের। দেশে এমন গ্যাংয়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। এরা এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে খুনসহ নানা অপরাধমূলক কাজে যখন-তখন জড়িয়ে যাচ্ছে। সামান্য কারণেই তারা ভয়ংকর সব কর্মকাণ্ড সংঘটন করছে।

এ ধরনের বিপথগামী কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে কমিউনিটি অ্যান্ড বিট পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) ১৬ হাজার ২৬৬ জন কমিউনিটি পুলিশ কাজ করছে। প্রতিটি থানায় ১৫ থেকে ২০ জন পুলিশ কাজ করে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী কোথাও কম-বেশি কাজ করে থাকে।

২০১৩ সালে স্বল্প পরিসরে পুলিশ সদর দপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) অপারেশনের অধীনে পৃথক শাখা হিসেবে কাজ শুরু করেছিল কমিউনিটি পুলিশিং। ২০১৪ সালে একজন সহকারী মহাপরিদর্শকের (এআইজি) তত্ত্বাবধানে পাবলিক সেইফটি অ্যান্ড প্রিভেনশন (পিএস অ্যান্ড সিপি) শাখার কার্যক্রম শুরু হয়। এটিই এখন কমিউনিটি অ্যান্ড বিট পুলিশিং নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

বর্তমানে পুলিশের সকল জেলা, রেলওয়ে, হাইওয়ে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ও মেট্রোপলিটন ইউনিটে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কার্যক্রম বিস্তৃতি রয়েছে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের চলমান কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী ৬০ হাজার ৯৮১টি কমিটিতে ১১ লাখ ১৭ হাজার ৮০ জন কমিউনিটি পুলিশ সদস্য কাজ করছে।

২০১৪ সাল থেকে দৃশ্যমান যেসব অগ্রগতি

কর্মসম্পাদন সূচক: ২০১৪-১৫ সালে ওপেন হাউজ ডের সংখ্যা ৮ হাজার ৮৯৪টি, জনসংযোগ সভার (র‌্যালি, স্কুল ভিজিট ইত্যাদি) সংখ্যা ৪০ হাজার ২২টি, অপরাধ বিরোধী সভার সংখ্যা ৪৭ হাজার ৬৩১টি, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভার সংখ্যা ৮২ হাজার ৯৮১টি।

২০১৫-১৬ সালে ওপেন হাউজ ডের সংখ্যা ৯ হাজার ৬৬১টি, জনসংযোগ সভার (র‌্যালি, স্কুল ভিজিট ইত্যাদি) সংখ্যা ৪০ হাজার ২২টি, অপরাধ বিরোধী সভার সংখ্যা ৫১ হাজার ৯৫৯টি, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভার সংখ্যা এক লাখ ১৭ হাজার ৯৩টি।

২০১৬-১৭ সালে ওপেন হাউজ ডের সংখ্যা ৮ হাজার ১২৩টি, জনসংযোগ সভার (র‌্যালি, স্কুল ভিজিট ইত্যাদি) সংখ্যা ৫২ হাজার ৯৫৫টি, অপরাধ বিরোধী সভার সংখ্যা ৭৬ হাজার ৫৮৭টি, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভার সংখ্যা এক লাখ ১৯ হাজার ৮৫৩টি।

২০১৭-১৮ সালে ওপেন হাউজ ডের সংখ্যা ৮ হাজার ৯৫৮টি, জনসংযোগ সভার (র‌্যালি, স্কুল ভিজিট ইত্যাদি) সংখ্যা ৫৮ হাজার ৮৬৫টি, অপরাধ বিরোধী সভার সংখ্যা ৮৩ হাজার ১১৯টি, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভার সংখ্যা এক লাখ ২৭ হাজার ৯৩৭টি।

২০১৮-১৯ সালে ওপেন হাউজ ডের সংখ্যা ৯ হাজার ৪৬০টি, জনসংযোগ সভার (র‌্যালি, স্কুল ভিজিট ইত্যাদি) সংখ্যা ৮৪ হাজার ৭৬৮টি, অপরাধ বিরোধী সভার সংখ্যা ৮৬ হাজার ৪৯১টি, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভার সংখ্যা এক লাখ ২৮ হাজার ৬২৬টি।

২০১৯-২০ সালে ওপেন হাউজ ডের সংখ্যা ৭ হাজার ২টি, জনসংযোগ সভার (র‌্যালি, স্কুল ভিজিট ইত্যাদি) সংখ্যা ৭০ হাজার ৫২১টি, অপরাধ বিরোধী সভার সংখ্যা ৭০ হাজার ৭৪৬টি, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভার সংখ্যা ৫৯ হাজার ১৬৪টি।

ক্রাইম প্রিভেনশনে যেসব কার্যক্রম

প্রতিমাসে প্রতিটি থানা/ইউনিটে ওপেন হাউজ ডে আয়োজন করা, ওই ওপেন হাউজ ডে অনুষ্ঠানে এলাকার বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, সমাজ থেকে মাদক মুক্তকরণ, স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীদের ইভটিজিং সমস্যা, যৌন হয়রানি, নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, যৌতুক প্রতিরোধ, বয়স্ক শিক্ষা, জঙ্গি ও সন্ত্রাস নির্মূলে সচেতনতামূলক আলোচনা করা হয়।

এছাড়া কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি কর্তৃক প্রতিমাসে পারিবারিক বিরোধ (ডিসপুট) নিষ্পত্তি করা হয়। কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি কর্তৃক নারী-শিশু নির্যাতন এবং নীরব পারিবারিক নির্যাতন রোধে কার্যক্রম নেওয়া হয়।

প্রতিটি জেলা ইউনিটে প্রতিমাসে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সম্বলিত ছবি ও পাঠদানের বিষয়বস্তু ছক মোতাবেক পাঠিয়ে থাকে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কার্যক্রমের অংশগ্রহণ হিসেবে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পুলিশের কাজে সহযোগিতা ও অপরাধ সচেতনতা তৈরিতে নিম্নলিখিত বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা পাঠদান করে থাকেন- বাল্য বিবাহ রোধ, ইভটিজিং প্রতিরোধ, জঙ্গিবাদ দমন, সন্ত্রাস দমন, মাদকের কুফল, নারী নির্যাতন, যৌতুক নিরোধ, মোবাইলের অপব্যবহার ও সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি সংক্রান্ত।

প্রত্যেক থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সহযোগিতায় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জঙ্গি বিরোধী সমাবেশ ও ভাড়াটিয়া তথ্য সংগ্রহ সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। সার্ভিস ডেলিভারী ও কমিউনিটি পুলিশিং সেন্টারের মাধ্যমে জনগণ যাতে সহজে সঠিক সেবা পেতে পারে এ ব্যাপারে সিপিওগণের করণীয় সম্পর্কিত নির্দেশনা আছে। এ যাবৎ ৬৬টি সার্ভিস ডেলিভারী সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, চলমান কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে পুলিশ-জনগণের মিথস্ক্রিয়ার ফলে পুলিশের কাজে জনগণের আস্থা, অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরাধপ্রবণ এলাকায় জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশের সাথে যৌথ উদ্যোগে টহল পাহারা ও নিরীক্ষণের ফলে অপরাধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে।

দেশের পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা রক্ষা, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং যাত্রীসেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি মেট্রোপলিটন/জেলা, থানা ও টার্মিনাল স্টেশনে) পৃথকভাবে কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি গঠন ও পরিবহন চালক এবং চালকের সহকারীদের জন্য প্রতিমাসে ট্রাফিক নিয়ম-কানুন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে।

এছাড়া সারাদেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে ৩০৮টি কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি গঠন করা হয়েছে ও বাস্তবায়নের কাজ অব্যাহত রয়েছে। বিশেষায়িত পুলিশ ইউনিটসমূহ যেমন- হাইওয়ে কমিউনিটি পুলিশিং ও রেলওয়ে কমিউনিটি পুলিশিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমিউনিটি পুলিশিং ও পরিবহন সেক্টর কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি গঠন করা হয়েছে।

জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স প্রতিরোধ ও নির্মূল করার লক্ষ্যে কমিউনিটি অ্যাওয়ারনেস মডিউল এবং কমিউনিটি অ্যাওয়ারনেস স্যাটাজি প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০২০ সালের ২০ জন টিওটি কোর্সের মাধ্যমে সারাদেশে ২৫ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে কমিউনিটি অ্যাওয়ারনেস মডিউল এবং কমিউনিটি অ্যাওয়ারনেস স্যাটাজি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়াও কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে দক্ষতা বৃদ্ধির  জন্য এক হাজার ৪৬৮ জন কমিউনিটি পুলিশিং অফিসার (সিপিও) এবং সংশ্লিষ্ট থানার পরিদর্শকদের সমন্বয়ে ৩৭টি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের প্রতিবেদন:

বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে মোট ৯৭ হাজার ৩১০টি অধর্তব্য অপরাধ সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়। মাদক, চোরাচালান, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে ৫০ হাজার ৬৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

জনসাধারণের সাথে অংশীদারিত্ব তৈরি ও অপরাধ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিট অফিসারগণ চার হাজার ৮৭২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৭২ হাজার ৫৫৪টি মসজিদ ও ৫২ হাজার ৬০৩টি মন্দির পরিদর্শন করেন। জনগণের সহায়তায় বিট অফিসারগণ ২৫ হাজার ৭৭৩টি জরুরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সংক্রান্ত ঘটনা মোকাবেলা এবং ১৯ হাজার ২৬৬ টি প্রতিরোধমূলক আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (কমিউনিটি পুলিশিং) সহেলী ফেরদৌস ঢাকা টাইমসকে বলেন, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সদস্যরা এলাকায় মানুষের সঙ্গে মৌখিকভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, মোটিভেশন করে, থানা পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে।

সহেলী ফেরদৌস বলেন, ‘একটি ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে জেল দিল, এতে কিন্তু সমস্যার সমাধান হলো না। কারণ এক সময় তার মধ্যে আর জেলের ভয় থাকে না। বরং তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আরো সুন্দরভাবে তাকে অপরাধ মনোবৃত্তি থেকে ফেরানো যায়। ঠিক এই জায়গাতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ভূমিকাটা বেশি।

এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা টাইমসকে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক সহেলী ফেরদৌস বলেন, ১৯৯২ সালে ময়মনসিংহে লাঠি-বাঁশির বাহিনী নামে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। আজ তা ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিবছরের অক্টোবর মাসের শেষ শনিবার কমিউনিটি পুলিশিং ডে পালিত হচ্ছে।

(ঢাকাটাইমস/২৪ফেব্রুয়ারি/এএ/ডিএম)