অ্যাম্বুলেন্স, পরীক্ষা ও ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফেরা

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:৪৮

সকালবেলা মেলবোর্নের আকাশটা মেঘে ঢাকা। রাতে একটু বৃষ্টি হয়েছে। তাপমাত্রা কম। সামার হলেও শীতের কাপড় পরতে হচ্ছে। করোনাকালে ফজরের নামাজ পড়ে ফেসবুক, মেসেঞ্জার চেক করি। এটা করি ভয়ে- না জানি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মিস করি।

আজ দুটি স্ট্যাটাস পড়ে একটি বিষয় কমন পেলাম। আমার লেখার বিষয় তাই হয়ে গেল অ্যাম্বুলেন্স। কিছুদিন আগে আমার স্কুল বন্ধু ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রুমমেট করোনা আক্রান্ত হয়েছিল।খুলনার একটি হাসপাতালে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছিল বন্ধু। বন্ধুর বড়ভাই আমাকে বললেন সেনাবাহিনীর একটি অ্যাম্বুলেন্স আছে। সেটা যদি ম্যানেজ করা যায় তবে ঢাকায় নিয়ে গেলে ভালো চিকিৎসা করানো যাবে। আমাদের এই বন্ধু ছিল প্রকৃত পক্ষেই বন্ধু। নিজের বিপদ তৈরি করে বন্ধুদের সে অনেক উপকার করেছে। যাদের উপকার করেছে তাদের মুখেই এই বন্ধুর কাজের বর্ণনা শুনেছি।

আমি টেলিফোনে কথা শেষ করে আমাদের আরেক বন্ধু, যে সেনাবাহিনীতে আছে , তাকে ফোন করলাম। সে বিষয়টি শুনে সরাসরি খুলনা হাসপাতালে যোগাযোগ করলো। দুদিন পরেই আরেক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেলাম আগামীকাল করোনা আক্রান্ত বন্ধু ঢাকায় আসবে। জেনে ভালো লেগেছিল সেনাবাহিনী এমন একটি অ্যাম্বুলেন্স সংগ্রহ করেছে। অবশ্য বন্ধুর আর ঢাকায় আসা হয়নি। একসঙ্গে ঘুমিয়েছি দিনের পর দিন-সেই বন্ধুটি করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে না ফেরার দেশে চলে গেছে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স তার আর প্রয়োজন হয়নি।

কোনো এক অনুষ্ঠানে আরেক সেনা কর্মকর্তাকেও বলেছিলাম তারা যেন অ্যাম্বুলেন্স হেলিকপ্টার কেনে। আমি জানি না আমার কথাটি পছন্দ হয়েছিল কি না। ভালো কথা পছন্দ হলেও অনেকে সেটা করে না। কারণ ওইটা কেন তার মাথায় আসেনি!

কোনো একজন বরেণ্য ব্যক্তি বলছিলেন- ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের মতো আরও আটটি হাসপাতাল আমাদের বানানো উচিত। এসব নিয়ে যখন কথা শুনছি তখন আমরা আরও জেনেছি একজন সৈনিকের পিতা-মাতাও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে পারেন- কিন্তু একজন প্রবীণ অধ্যাপককে তদবির করতে হবে যদি কোনো বড় কেউ থাকে অথবা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো অনুরোধ করে! এটাকে বৈষম্য বলা যাবে কি?

যে দুটি স্ট্যাটাস থেকে অ্রাম্বুলেন্স নিয়ে কথা বলতে চাই সে প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সন্তান তার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার কথা বলছেন একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে। তিনি কেবল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে ক্ষান্ত হননি। বরং আরো একটি মহান কাজ করেছেন। নিজেকে সমাজসেবক হিসেবে যেমন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি তিনি একজন স্বীকৃত প্রবাসী অর্থনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা। কাজ করে দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। আবার নিজের পরিবার ও নিকটাত্মীয়দেরকে বিদেশ যেতে মানব দরদি ভূমিকা রেখেছেন। গতকাল সকালে জেনেছি ওই সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

ওই বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতাল থেকে ফোন করে সন্তানকে বলছেন- বাবা আমাকে ওরা হাসপাতালে আনতে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে দেরি করেছিল। তুমি আর দেরি করোনা। তোমার মাকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে আসো ভর্তি করতে। বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী আমাদের বোন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে এসেছেন। কিন্তু নিজের আর ঘরে ফেরা হলো না। হলো না নিজ গ্রামের উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়ন। লন্ডনের হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগে ভুগে ইন্তেকাল করলেন আমাদের প্রিয় হুমায়ুন কবির ভাই। আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুন।

এরপরেই আমার ছোট ভাইয়ের স্ট্যাটাস। সে আরেকজনের স্ট্যাটাস শেয়ার করেছে। বিষয় ‘গ্রামীণ অ্যাম্বুলেন্স’। কিছুদিন আগেই আমার ওই ভাইটি এবিষয়ে বলছিল। বাংলাদেশ সরকার ও বন্ধু রাষ্ট্র জাপানের যৌথ পরিচালনায় একটি প্রকল্পের অধীনে সে কাজ করছে। তারা বর্তমান করোনা সংকট উপলব্ধি করে একটি অ্যাম্বুলেন্স কিনতে চাইছে। সেটি থাকবে উপজেলা প্রশাসনের অধীনে। এরপর আর জানা হয়নি। আজ জানলাম। সাটুরিয়া উপজেলা একটি অ্যাম্বুলেন্স সংগ্রহ করেছে এবং এর নাম দিয়েছে ‘গ্রামীণ অ্যাম্বুলেন্স’। এই গ্রামীণ অ্যাম্বুলেন্স কীভাবে এক তরুণের পিতার জীবন বাঁচালো সেই বিষয়ে ওই তরুণের স্ট্যাটাস। এই স্ট্যাটাসটি দেখে যেমন মন ভরে গেল তেমনি আবার পরক্ষণে মনটা অন্য দিকে চলে গেল। বাবু পি কে হালদার। উনি এক সময়ে এই প্রকল্পসহ আরও অনেক গ্রামীণ প্রকল্পের নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব। তিনি নাকি উন্নয়নের নামে সরকারের কোষাগার থেকে নেয়া হাজার হাজার কোটি টাকা উজাড় করেছেন।

তিনি দেশের ফিরে সেই টাকা ফেরত দিতেও চেয়েছিলেন।কিন্তু টাকা এখন যাদের কাছে আছে তারা চায় না উনি ফিরে আসুক। কারণ- ফিরে এলেতো তাদের সুখ থাকবে না। তিনি টাকা ফেরত দেবেন ভালো কথা কিন্তু কেন তিনি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেননি? যদি ওই টাকাগুলো ব্যয় হতো তাহলেতো বাংলার রূপ বদলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হয়ে যেত। নয় কি?

আমরা জানি আমাদের দেশের শিল্পপতিরা নিজেদের বিমান করে পালিয়ে যান আবার দেশে ফিরে আসেন। কেউ ফেরারি হয়েও আদালতে না গিয়ে মুক্তি পায় আবার কেউ বিমানবন্দরে নেমেই গ্রেপ্তার হন। কেউ সমাজের আসল প্রয়োজনকে দেখে না। বাণিজ্যিক চিন্তা এখন যেন সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মুক্তি কোথায়, কীভাবে আমাদের অজানা।

যেখানে প্রয়োজন ছিল অন্তত ১০টি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সেখানে হয়তো কেনা হয়েছে ড্রিমলাইন। যেখানে প্রয়োজন হাসপাতাল- সেখানে হয়েছে অন্য কিছু। দেশের পরিকল্পনাবিদের এই অগভীর মেধার কারণে জাতি এখনো ধুঁকছে। এমন একটি মহামারি যেখানে মানুষকে বদলে দেয়ার কথা, সেখানে চলছে অন্ধ স্বার্থপরতার প্রতিযোগিতা। জনগণের দুর্ভোগ ভেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে ঘরে বসে দেশ পরিচালন করছেন সেখানে শুনতে পাই জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে ফেরিঘাটে ভি-আইপি প্রটোকল নেয়ার খবর। শুনতে পাই টাকার অভাবে পদ্মা রেল প্রকল্পের কাজে ধীরগতি।

১১ মাস শেষ হয়ে ১২ মাস চলছে। এমন একজন রাজনীতিবিদ আমরা পেলাম না যিনি অন্তত বলবেন- আর নয় এবার হবে সত্যিকার উন্নয়ন। প্রতিটি ইউনিয়ন এ থাকবে হাসপাতাল, থাকবে অ্যাম্বুলেন্স, থাকবেন ডাক্তার, নার্স। এমন একজন রাজনীতিবিদ পেলাম না যিনি অন্তত একটি উপজেলাকে করোনামুক্ত করেছেন। বসুরহাটে বসে একজন চিৎকার করছেন। আমরা আপনার সঙ্গে থাকতাম যদি দেখাতে পারতেন আপনি আপনার এলাকাকে করোনামুক্ত করেছেন।

আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হলের তালা ভেঙে ক্যাম্পাসে ফিরছে। তারা কি পারে না জনতার পাশে দাঁড়াতে করোনামুক্ত করতে? আজ মন্ত্রীরা টি শার্টে লিখছেন ‘AM…Man.’ জাতি আপনাদের কর্মকাণ্ডে লজ্জা পাচ্ছে কি? যদি সত্যি সত্যি Man হতেন- তবে আজ শুনতে হতো না অনেক অভিযোগ-সমালোচনা-এতদিনে বাংলাদেশ করোনামুক্ত হয়ে যেত বোধহয়। ভুল বলেছি কি?

বঙ্গবন্ধু যে চাটার দল দেখেছিলেন- সেই বীভৎস কালো ছায়া এখন বাংলার আকাশে শকুনের মতো ভিড় করছে কি? বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত সৈনিকরা সেটা দেখতে পাচ্ছে কি?

যারা আজ ছাত্রদেরকে হল দখলে উস্কানি দিচ্ছে তারা জাতির শত্রু ছাড়া আর কী হতে পারে? প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী হল দখল নয়- করোনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কাজে তোমাদের অগ্রণী ভূমিকা দেখতে চাই। তোমরাই বদলে দিতে পারো দেশ। তোমরা হতে পারো বীর মুক্তিযোদ্ধা করোনা থেকে জাতিকে মুক্ত করে।

ভ্যাকসিন সাময়িক সমাধান দেবে -কিন্তু করোনা থেকে যাবে এবং তারা বার বার আক্রান্ত করবে। আমি তোমাদের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ফিরে আসতে চাই। তাই এস সকলে মিলে করোনামুক্ত, লুটপাটকারী মুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।

প্রিয় ছাত্রছাত্রী! করোনাভাইরাস বোন, ভাই, বন্ধু , শিক্ষক অনেককেই কেড়ে নিয়েছে। সুতরাং, করোনাভাইরাস বাস্তব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের নিরাপত্তা দিতে সারাক্ষণ কাজ করছেন। তোমাদের সহযোগিতা তোমাদেরকে দ্রুত ক্যাম্পাসে ফিরতে অবদান রাখবে। কেন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, কেন সামাজিক দূরত্ব গুরুত্বপূর্ণ, কেন রাস্তা বন্ধ করা বিপদজনক ও অন্যের নিরাপত্তা হুমকি সেটা তোমাদের বুঝতে হবে।

তোমরা রাস্তা বন্ধ করলে অ্যাম্বুলেন্স সময়মত রোগী পরিবহন করতে পারবে না। হয়তো তুমি জানবে না ওই অ্যাম্বুলেন্সে তোমারি এক বন্ধুর বাবা কিংবা মা আছেন। হয়তো ডাক্তার সময়মত হাসপাতালে যেতে পারবেন না। হয়তো হাসপাতালে সময় মতো ঔষধ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নয়, তোমাদের এখন ধৈর্য পরীক্ষা দিতে হবে বন্ধুরা।

প্রিয় শিক্ষার্থী, তোমাদের শিক্ষকদের ভিআইপি মর্যাদা নেই। সামরিক হাসপাতাল , পুলিশ হাসপাতাল, রেল হাসপাতাল, সচিবালয় হাসপাতাল, ভিআইপি কেবিনে আছে। কারো আছে সিঙ্গাপুর, কারো আছে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। তোমাদের শিক্ষকদের কোনো হাসপাতাল নেই, নেই ভিআইপি কেবিন। যদি করোনা আক্রান্ত হয়, তবে তারা ওই সব সরকারি হাসপাতালে জায়গাও পাবেন না। তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তোমরা ক্যাম্পাস ও রাজপথ দখলের পথ থেকে দূরে থাকবে কি? তোমরা ক্যাম্পাস- রাজপথ দখল করলে লাভবান হবে দুর্বৃত্ত, স্বৈরাচারী, আর দুর্নীতিবাজ।

তোমরা আগামী তিন মাস সমাজের কাজ করবে কি? তোমাদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন থাকবে যারা করোনাভাইরাস নির্মূলে ভূমিকা রাখবে তাদের যেন সনদ দেয়া হয় এবং তাদেরকে যেন সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।ওই সনদ থাকলে চাকরির বয়স এক বছর শিথিল করা হবে। তাই এস দেশ গড়ার সংগ্রামে-ক্যাম্পাস দখলে নয়।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :