আড়িয়াল বিলের কুমড়ার প্রত্যাশিত দাম পাচ্ছে না কৃষক

আরাফাত রায়হান সাকিব, মুন্সীগঞ্জ
 | প্রকাশিত : ০১ মার্চ ২০২১, ২০:২৬

স্বাদে সেরা আর আকৃতিতে বিশাল। এ কারণে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের আড়িয়াল বিলের মিষ্টি কুমড়ার খ্যাতি রয়েছে দেশ-বিদেশে। আন্তর্জাতিক মেলায় প্রদর্শনী ও বিক্রির তালিকায়ও রয়েছে এ কুমড়া।

২০২০ সালে আড়িয়াল বিলে ১১ হাজার ২৪০ মেট্রিক টন মিষ্টি কুমড়া উৎপাদন হয়েছে। এ বছরও বিলের গাদিঘাট, শ্রীধরপুর, আলমপুর, বাড়ৈখালিসহ ১৯০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে স্থানীয় জাতের মিষ্টি কুমড়ার। এর মধ্যেই জমি থেকে কুমড়া উত্তোলন করে বাজারজাত করছেন কৃষকরা।

এ বছর ফলনও হয়েছে ভালো, আর বিক্রিতেও রয়েছে চাহিদা। তবে এ বছর জমি থেকে দেরি করে উত্তোলন হওয়ার কারণে আশানুরূপ দাম পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে কৃষকরা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আবাদ হয়েছে মিষ্টি কুমড়ার। একেকটি ৩০ থেকে ৭০ কেজি ওজনের কুমড়া দেখতে যেমন সুন্দর, আকৃতিতেও বিশাল। ফসল উত্তোলনে জমিতে সকাল থেকে কাজ শুরু করেন কৃষকরা। জমির আকৃতি ও ফসলের পরিমান অনুযায়ী কমবেশি শ্রমিক কুমড়া উত্তোলনে কাজ করেন।

শ্রমিকদের দিনপ্রতি পারিশ্রমিক ৫০০ টাকা। শ্রমিকরা জমি থেকে মাথায় ও নৌকায় করে গাদিঘাটসহ বিলের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার পাশে কুমড়া মজুদ করে। সেখান থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পাইকাররা গাড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে যান কুমড়া।

গাদিঘাট এলাকায় দেখা যায়, পাইকারদের অপক্ষোয় ট্রলারে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কুমড়া। কোনোটি গোলাকার, আবার কোনোটি কিছুটা লম্বা আকৃতির কুমড়া।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একগন্ডা (১৪ শতাংশ) জমিতে ১০-১২টি চারা রোপণ করা হয়। প্রতিটি চারায় ২০ থেকে ৬০টি পর্যন্ত কুমড়া হয়ে থাকে। রোপণের তিন মাস পরই ফসল তোলা যায়। শীতের শেষের দিকে ফসল বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়। এ বছরও ফলন ভালো হয়েছে।

কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা থেকে ৩০ টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ছয় টাকা কেজি দরে। একগন্ডা জমিতে কুমড়া চাষে খরচ হয় সাত থেকে আট হাজার টাকা। ঢাকার কারওয়ান বাজার, মিরপুরসহ বিভিন্ন বাজারে এসব কুমড়া পাইকাররা বিক্রি করেন। এছাড়াও জেলার ছয়টি উপজেলা ও আশপাশের জেলায়ও এসব কুমড়া বিক্রি হয়।

শ্রীধরপুর এলাকার চাষী বার্শেদ আলী জানান, ৩৫ বছর যাবত বিলে কুমড়ার চাষ করি। ওজন অনুযায়ী ২০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকায়ও বিক্রি হয় কুমড়া। খাইতে খুব স্বাদ। তাই বিভিন্ন জায়গার মানুষ আহে। আইলে কি ওইবো। এখনতে দাম পাইতাছি না। একপাখি (৩৫ শতাংশ) জমিতে কুমড়া চাষে খরচ পরে ১৫ হাজার টাকা। বর্তমানে বিক্রি কইরা ২০-২৫ হাজার টাকা উঠবো। এই কয় টাকায় তিন মাস খাটনিতে কী লাভ থাকে। একই ধরনের ভাষ্য স্থানীয় কৃষক বাবুল, সালু ও আরশাদের।

গাদিরঘাট এলাকার আরেক কৃষক মো. বাবু জানান, এ বছর ১৫-২০ দিন দেরিতে ফসল উঠেছে। বাজারে বিক্রি হইতাছে। তবে দাম একবারে কম। বাজার অনুযায়ী দাম পাই আমরা। এখন কেজি প্রতি ছয় টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে হয়।

আরেক কৃষক মনির হোসেন বলেন, ফসলের অনেক ভালো ফলন হয়েছে। জমির ২০ হাজার টাকার কুমড়া তুলতে আটজন শ্রমিক লাগে। খরচ হয় চার হাজার টাকা। পাইকারদের কাছে কেজিতে ১০-১২ টাকা বিক্রি করতে পারলেও আমাদের অনেক লাভ হতো।

এ ব্যাপারে পাইকার ব্যবসায়ী লিটন শেখ বলেন, ছয় টাকায় কুমড়া কিনে নিয়ে ঢাকার বাজারে ১২ টাকায় বিক্রি করছি। এক গাড়ি কুমড়া নিতে গাড়ি ভাড়া দিতে হয় সাত হাজার টাকা। চার টনে গাড়িতে ২০০টির মতো কুমড়া নিতে পারি।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শান্তনা রাণী জানান, এ বছর প্রায় ১৯০ হেক্টর জমিতে কুমড়া আবাদ হয়েছে। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষ ও ফেব্রুয়ারির শুরুতেই কুমড়া উত্তোলন শেষ হলেও এ বছর এখনো কুমড়া উত্তোলন শেষ হয়নি। উত্তোলন বিলম্ব হওয়ায় বাজারে কিছুটা কম দাম পেয়ে থাকতে পারে।

বিশাল আকৃতির কুমড়া ফলনের রহস্য:

কৃষি অফিসের সূত্রে মতে, প্রতি বছর বর্ষার পর বিলের জমিতে কুমড়ার আবাদ হয়। চারা রোপনের তিনমাসেই ফসল উৎপাদনে সময় লাগে মাস। বিলের কুমড়ার জাত একবারেই স্থানীয় স্বতন্ত্র। অন্য কোনো জমিতে এলাকার কুমড়ার বীজ রোপণ করলেও এমন স্বাদ ও বিশাল আকৃতির হয় না।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শান্তনা রাণী বলেন, বিশেষ ভৌগলিক কারণে এ বিলের কুমড়ার আকৃতি এতো বিশাল হয়ে থাকে। আমি অন্য কোনো জেলায় এতবড় কুমড়া দেখিনি। মূলত বর্ষা মৌসুমে দীর্ঘদিন বিলের জমি পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এসময় পানিতে জলীয় উদ্ভিদ জন্ম নেয়। পানি নেমে গেলে এসব উদ্ভিদ বিলের মাটিতে পঁচে প্রাকৃতিক সার হিসেবে কাজ করে, যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এতে ফসল ভালো ফলন হয়।

এক কুমড়াই ১২১ কেজি!

এদিকে এ বছর বিলে সবচেয়ে বিশাল আকৃতির ১২১ কেজি ওজনের কুমড়া উত্তোলন করা হয়ছে গাদিঘাট এলাকার গনি শেখের জমি থেকে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি গাদিঘাট এলাকায় জমি থেকে এই কুমড়া উত্তোলন করা হয়। উত্তোলনের দিনই কুমড়াটি বিলে ঘুরতে আসা এক ব্যক্তির কাছে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।

গনি মিয়ার ভাগিনা কৃষক বাবু জানান, এইবার দেখা বিলের সবচেয়ে বড় আকৃতির কুমড়া এটি। জমি থেকে চারজন মিলে বস্তায় ভরে বাসে ঝুলিয়ে কুমড়াটি বাজারে নিয়ে আসতে হয়েছে।

তিনি বলেন, তবে এর আগেও এর থেকে বড় কুমড়া দেখেছি। চার-পাঁচ বছর আগে একবার চারমণ ওজনের কুমড়া বাজারে তোলা হয়।

হাইব্রিড জাতের কুমড়া আবাদ বেড়েছে:

এদিকে আড়িয়াল বিলে স্থানীয় জাতের পাশাপাশি ক্রমাগত বেড়েই চলছে হাইব্রিড কুমড়া চাষ। তবে সেসব কুমড়া স্বাদ ভালো হলেও আকৃতিতে অনেকটাই ছোট। দুই থেকে সাত কেজি হয়ে থাকে হাইব্রিড জাতের কুমড়া।

হাইব্রিড কুমড়া চাষী শ্রীধরপুর এলাকার খন্দকার আবুল বারী জানান, দেশি কুমড়ার আকৃতি বড় হলেও একটি জমি থেকে এক মৌসুমে দুই দফার বেশি উত্তোলন করা যায় না। কিন্তু হাইব্রিড তিনবারও করা যায়। বাজারে চাহিদা আছে তাই এই কুমড়া রোপণ করি। একেকটি কুমড়া ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। লাভ ভালো হওয়ায় অনেক চাষীই হাইব্রিড চাষ করছেন।

আরেক চাষী ইসমাইল মিয়া বলেন, দেশি কুমড়াই সব সময় রোপণ করি। তবে কয়েকবছর যাবত দেশির পাশাপাশি হাইব্রিডও চাষ শুরু করেছি।

(ঢাকাটাইমস/১মার্চ/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :