মুক্ত হোক বাক

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ০২ মার্চ ২০২১, ০৯:০৯

চারিদিকে কেবলি অন্ধকার। চোখ মেলে তাকাতে যেমন কষ্ট,তেমনি যেন একটি বদ্ধ পরিবেশ-বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার মত বাতাস নেই! পৃথিবীর বাতাসে যেমন দুর্গন্ধ, তেমনি রোগ বালাই যেন জেঁকে বসেছে! এমন একটি সময় কখনো আমরা পার করিনি বললে ভুল হবে। ১৯৭১ সালে যেমন ফিসফিস করে কথা বলতাম, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে যেমন দম বন্ধ করে চলাফেরা করতাম-নিজের কাছে প্রশ্ন রাখি: সেই পথেই পৃথিবীটা যাচ্ছে কি?

মিয়ানমার স্বাধীন হলেও সেখানে মানুষকে দিনের পর দিন দমবন্ধ করে থাকতে হতো। অনেক অপেক্ষার পর গণতন্ত্রের ফুলটি দেখে বিশ্ববাসী আনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু নোবেল বিজয়ী সুচির জাতিপ্রীতি সকলকে ব্যথিত করেছিল। রোহিঙ্গারা আজ বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে জীবনযাপন করছে। তাদের স্বাধীনতা নেই নিজ বাসভূমিতে বসবাসের। কি নির্মমতা!

একবিংশের প্রাক্কালে অনেকেই ভেবেছিল পৃথিবীটা এবার গণতন্ত্রে ফুলে ফলে ভোরে উঠবে। ভোটের অধিকার চাই দাবি শুনতে হবে না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মানুষকে কাতরাতে হবে না। করুণা ভিক্ষায় দ্বারে দ্বারে ছুটতে হবে না। কিন্তু সেটা যেন মাঘের কুয়াশায় বসন্ত আসার আগেই মুকুল ঝরার মতো ঝরে পড়ছে। ১৯৮৯ সালে যে সারা বিশ্বে মুক্তির জোয়ার এসেছিল সেটা আবার বন্দিদশায় নিপতিত হতে চলেছে।

চীন হংকংকে শৃঙ্খলিত করছে বলে বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন হচ্ছে। ভারত জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আবার সিরিয়াতে যুদ্ধবিমান বোমা ফেলছে, আর মিয়ানমার সৈনিকেরা জনগণের সমাবেশে চরম আঘাত হানছে।

অস্ট্রেলিয়া আজ করোনামুক্ত। ডলারের দাম বাড়ছে। বাড়িঘরের দামও বাড়ছে। তারপরেও অস্ট্রেলিয়া ভালো নেই। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এলেও তাকে চাপা দিতে চলছে নানা কৌশল।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়া এবং কোভিড ভ্যাকসিন দেশে দেশে আসায় মানুষ একটু স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলতে না ফেলতেই নানা সমস্যা মানুষকে ভাবনায় ফেলে দিচ্ছে।

আল্লাহ মানুষকে একরকম স্বাধীনতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আবার মানুষের জন্য আইনও দিয়েছেন। সেই আইনের গ্রন্থ কোরআনে আছে তিনি শয়তানকেও স্বাধীনতা দিয়েছেন মানুষের অমঙ্গল করবার। পৃথিবীটা তাই মঙ্গল-অমঙ্গলের সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে সেই অনাদিকাল থেকে।

মার্চ মাস বাঙালির স্বাধীনতার মাস। এই মাস এলে আমাদের পতাকা, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠে। এই মাস এলে ২৫ মার্চের ভয়াল কালো রাত্রির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে পাক হানাদার বাহিনীর নিপীড়ন, নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ছবি। সবকিছুকে ম্লান করে দিয়ে স্বাধীনতার আনন্দ আমাদেরকে প্রশান্তি দেয়।

কিন্তু সেই স্বাধীনতা যেন আবার কোথায় হারিয়ে যায়। একটি কালো মেঘ বার বার যেন আমাদের দৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম আমাদের সংগ্রামের শেষ। এবার আমরা মুক্ত। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন রমনার রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে সেই স্বাধীনতা বুঝি আমরা পেয়েও হারাতে বসেছি কি?

বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন সেই ভাবনার স্বাধীনতা কিন্তু বাস্তবের ছোয়া পায়নি নানা কারণে। আমরা বিভিন্নভাবে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়েছি সামরিক রক্তচক্ষু আর বেসামরিক লাল ফিতায়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার কথা বলে নিজের বাক স্বাধীনতাকে ভোগ করেছিলেন অন্তত ১৯ দিন। এরপর পাক বাহিনী ওনাকে পাকিস্তানের জেলে নিয়ে রাখে। আর এখন ফেসবুকে একটি প্রাণের কথা লিখে ১৯ ঘণ্টাও প্রশান্তিতে থাকা দায়। গভীর রাতে পুলিশ কিংবা র‌্যাব এসে দরজার কড়া নাড়ে। ভয়ে আঁতকে উঠে ঘুমন্ত শিশু কিংবা অধ্যাপকের স্ত্রী। এইতো সেদিনের কথা সামরিক ড্রেস পরে গভীর রাতে গ্রেপ্তার করল মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক নেতা অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার থেকে। এমনিভাবে পাকহানাদার বাহিনী গভীর রাতে কড়া নাড়তো! গভীর রাতে গ্রেপ্তার করা হলো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে। কেন আজও বদলায়নি সেই পাকিস্তানী সংস্কৃতি- গভীর রাতে শিক্ষক গ্রেপ্তার?

কেউ ভুল বা অন্যায় করলে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু কেন ২০২১ সালে এসে আমাদেরকে ১৯৭৫ সালের জেল হত্যার মতো নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হতে হবে? আমাদের স্বাধীনতাকে আমরা কি আমাদের দায়িত্ববোধ দিয়ে প্রকাশ করতে শিখিনি? যদি না শিখে থাকি তবে যেন পাঠ্যসূচিতে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার স্থান পায়। বাংলাদেশের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি ভেবে দেখবেন কি? স্বাধীনতা আমাদের প্রাণের শব্দ। স্বাধীনতা আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, তিতুমীর, ঈশা খাঁ, ক্ষুদিরাম, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, আসাদ, বরকত প্রমুখ মহামানবদের স্মরণ করিয়ে শ্রদ্ধায় আমাদের মাথাকে অবনত করে দেয়।

স্বাধীনতা আল্লাহ দান। তাকে কেউ কেড়ে নিতে বা বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। অন্যের ক্ষতি না করা আমার দায়। সক্রেটিসের এই শিক্ষা আমি যেমন পেয়েছে তেমনি হেগেলের কাছ থেকে শিখেছি Be a person এবং Die to live।

স্বাধীনতাকে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক মুক্তি এবং অমর্ত্য সেন সক্ষমতাকে নির্দেশ করেছেন। জ্যা পল সাত্রে চিন্তায় "Man is condemned to be free; because once thrown into the world, he is responsible for everything he does." স্বাধীনতার নানা অর্থের ভিড়ে দায়িত্ববোধ থেকে পলায়ন প্রবণতা আমাদের মাঝে অনেক বেড়েছে যে নৈতিকতা ঘোলা জলে হাবুডুব খাচ্ছে।

নৈতিকতার ভাটার টানে যেন কমতে শুরু করেছে পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা। তাই হয়তো কাঁদানে গ্যাস আর ছাই নিক্ষেপ করে প্রশান্তি খুঁজছি। এমনি এক কঠিন সময়ে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে যেন বলতে পারি আল্লাহ আমার সমালোচকের মুখে যেন মিষ্টি ঝরে এবং ফুলচন্দন পড়ে। কারণ সমালোচনা আমাদেরকে সতর্ক করে এবং ভুল এড়িয়ে চলতে আলো দেয়। আমরা যেন উত্তাল তরঙ্গের মাঝে সাহসী নাবিকের মতো বলতে পারি- মুক্ত হোক বাক-মানুষ মুক্তি পাক। পাপ নিপাত যাক!

স্বাধীনতার এই মাসে “স্বাধীনতা” যেন তার প্রকৃত অর্থ খুঁজে পায়। জীবনবোধে যেন স্বাধীনতার আনন্দ, আলো ও অক্সিজেন আমরা পেতে পারি। যেন নিঃশ্বাস নিতে পারি। পারব কি? না কি জর্জ এর মতো I cannot breathe বলতে বলতে নিস্তব্ধ হয়ে যাবো?

আমরা জেলখানায় নিস্তব্ধ হয়ে যেতে চাই না। আমরা যুক্তি দিয়ে বলতে চাই স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা হোক। এই আইনটি দরকার আছে। আমাদের শিশু, মা, বোনদের রক্ষা করতে, আমাদের সমাজকে কলঙ্কমুক্ত রাখতে, শয়তানকে বিরত রাখতে এবং দেশকে বাঁচাতে এই আইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু কিছু অস্পষ্টতা সেখান আছে- সেগুলো সংশোধন জরুরি-একথা বলবার স্বাধীনতা আমাদের আছে। আমাদের সেই আশা পূরণ হবে কি? বাংলা মানুষের যেমন স্বাধীনতা ছিল নীল চাষ না করবার তেমনি ভারতের কৃষকের আছে তার পণ্য কার কাছে কিভাবে বিক্রি করবার স্বাধীনতা। বার্মার জনগণের আছে প্রতিবাদের স্বাধীনতা আছে, ফ্রান্সের মুসলিমদের হিজাব পরবার স্বাধীনতা। মানব স্বাধীনতার দুয়ার তাই হোক খোলা ও অবারিত।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :