বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পে ভিসির অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি

প্রকাশ | ০২ মার্চ ২০২১, ১৮:৪৮ | আপডেট: ০২ মার্চ ২০২১, ১৮:৫৩

বেরোবি প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ‘বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প’ শেখ হাসিনা ছাত্রী হল ও ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটসহ স্বাধীনতা স্মারকের নির্মাণকাজে ভিসি অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সরেজমিন তদন্ত কমিটি। দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে কমিটির প্রতিবেদনে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৪ জুন অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ ভিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রকল্পের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজ তদারক করার জন্য উপাচার্যের ঘনিষ্ঠজন প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

কিছুদিন পর আইন ও চুক্তি লঙ্ঘন করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আর্কিটেক্ট মনোওয়ার হাবিব ও প্রাকৃত নির্মাণ লিমিটেডের কার্যাদেশ বাতিল করে প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদেরকে দ্বিতীয় পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। তার মালিকানাধীন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নাম প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড। কার্যাদেশ বাতিলের সময় আর্কিটেক্ট মনোওয়ার হাবিবকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

অনুমোদিত ডিপিপির তোয়াক্কা না করে ভবন দুটির (শেখ হাসিনা ছাত্রী হল ও ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) নকশা পরিবর্তন করা হয়। পাশাপাশি নির্মাণে ব্যয় বাড়ানো হয় দুই গুণের বেশি। ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভবনে নির্মাণ ব্যয় ২৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ধরা হয় ৬১ কোটি টাকা। আর  ৫১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে শেখ হাসিনা ছাত্রী হল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১০৭ কোটি টাকা।

অন্যদিকে মূল ডিপিপিতে পরামর্শক ফি না থাকলেও বর্তমান ভিসি নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ সেই খাতে ব্যয় করেছেন ৪০ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের নানা অসংগতি নজরে এলে ইউজিসিকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এরপর গত বছরের ২০ এপ্রিল ইউজিসির সদস্য মুহাম্মদ আলমগীরকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার যার অন্য সদস্যরা হলেন ইউজিসির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক (বর্তমানে সচিব) ফেরদৌস জামান ও ইউজিসির অতিরিক্ত পরিচালক দুর্গা রানী সরকার।

চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি সরেজমিন পরিদর্শনে আসে তদন্ত কমিটি। পরিদর্শনকালে তারা বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণাধীন স্থাপনাসহ প্রকল্পের কাগজপত্রাদি যাচাই করেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। তাতে দেখা যায়, তদন্ত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি স্থাপনা নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজে পেয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জয়েন্ট ভেঞ্চার অব আর্কিটেক্ট মনোয়ার হাবীব অ্যান্ড প্রাকৃত নির্মাণ লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা না করে প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ কর্তৃক দ্বিতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেসার্স একিউম্যান আর্কিট্যাক্ট অ্যান্ড প্লানার্স লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৬, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস ২০০৮ এবং প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চুক্তির নিয়মাবলির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে কমিটি মনে করে।

প্রথম পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শেখ হাসিনা ছাত্রী হল এবং ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জন্য প্রকৃত নকশা বা ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভবন নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।

ইতোমধ্যে ওই ভবনের অর্ধেকের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাই এখানে দ্বিতীয় ড্রয়িং বা ডিজাইনের কোনো ধরনের প্রয়োজন আছে বলে কমিটি মনে করে না। বর্তমান পরিস্থিতি যা হোক না কেন, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনকৃত এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক যথাযথ প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত মূলধন ডিজাইন অনুযায়ী নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা উচিত।

সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে অযাচিতভাবে দ্বিতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কার্যাদেশ দেওয়া হয়, যা সরকারি ক্রয় পদ্ধতির নিয়মবহির্ভূত। এ ধরনের অনৈতিক কাজের জন্য সংশ্লিষ্টদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে আর্কিটেক্ট মঞ্জুর কাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ওয়ার্কস কমিটির সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্য কর্তৃক মনোনীত আছেন। এই সময়ে দ্বিতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত মেসার্স একিউম্যান আর্কিটেক্ট অ্যান্ড প্লানার্স লিমিটেড ভবন সংশোধিত ড্রয়িং বা ডিজাইন প্রণয়ন করে বর্তমান প্রকল্প পরিচালক উপাচার্যের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েছেন। আর্কিটেক্ট মঞ্জুর কাদের থাকা সত্বেও এ রকম একটি অগ্রহণযোগ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ ড্রয়িং বা ডিজাইন অনুমোদিত হয়েছে। তাই তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাকে কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার স্বার্থে প্রয়োজন।

দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদানকৃত দুটি ভবন- শেখ হাসিনা ছাত্রী হল এবং ড. ওয়াজেদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের ড্রয়িং বা ডিজাইনের এরিয়া এক হলেও আরডিপিপিতে দুটি ভবনের অতিরিক্ত এরিয়ার অনুকূলে অর্থ প্রাক্কলন করে প্রকল্প পরিচালক ও উপাচার্যের স্বাক্ষরসহ ইউজিসিতে পাঠানো হয়েছে।

এই অতিরিক্ত এরিয়া ও অতিরিক্ত  প্রাক্কলন ব্যয়সহ আরডিপিপি প্রণয়ন করা নৈতিক বিচ্যুতি। যেহেতু প্রথম পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও আর্কিটেক্ট মনোয়ার হাবীব ড্রয়িং বা ডিজাইনের ওপর তিনটি অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলমান, তাই তার এবং উক্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে অবশিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি অবকাঠামো নির্মাণে যে অবহেলা, দীর্ঘসূত্রতা ও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা বর্তমান প্রশাসনের অনৈতিকতা, অদক্ষতা ও ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, শিক্ষা গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিও চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রধান এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে থাকার জন্য বর্তমান উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর এই দায়দায়িত্ব অবশ্যই বহন করা উচিত। একই সঙ্গে ইউজিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভবনের নকশা পরিদর্শন করে যেভাবে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।  

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর উন নবীর আমলে ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনা ছাত্রী হলের ১০ তলা ভবন ও ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ১০ তলা ভবনের কাজ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে ‘স্বাধীনতা স্মারক’ প্রকল্পের কাজও শুরু হয়। ২০১৮ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভবনগুলোর নির্মাণকাজ এখনো অর্ধেকও হয়নি।

(ঢাকাটাইমস/২মার্চ/কেএম/মোআ)