সাতই মার্চে ঐশ্বরিক শুভেচ্ছাদূতের আহ্বান

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
| আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২১, ১৮:২৩ | প্রকাশিত : ০৭ মার্চ ২০২১, ১৭:৩২

১.

"আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলেই জানেন এবং বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি।... আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম?... এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস- এই রক্তের ইতিহাস মুমূর্ষু মানুষের করুণ আর্তনাদ- এদেশের করুণ ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করলেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল' জারি করে দশ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।...

“তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করেছিলাম, ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আমাদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে সভা হবে।... আমি বললাম, অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব, এমনকি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনের মতেও যদি তা ন্যায্য কথা হয়, আমরা মেনে নেব।...

“ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম, আমি যাব। ভুট্টো বললেন যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে এলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষের, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। দেশের মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলো। আমি বললাম আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করুন। আমি বললাম, আপনারা কল-কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন, সারাদিনে জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল, সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। আমি বললাম আমরা জামা কেনার পয়সা দিয়ে অস্ত্র পেয়েছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করবার জন্য। আর সেই অস্ত্র আমাদের দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের বিরুদ্ধে তার বুকের ওপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি বলেছিলাম, ইয়াহিয়া খান সাহেব, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখুন কীভাবে আমার গরিবের ওপর, বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কীভাবে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, আপনি দেখুন।...২৫ তারিখ অ্যাসেম্বলি ডেকেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই। ১০ তারিখে বলেছি, রক্তে পাড়া দিয়ে, শহীদের ওপর পাড়া দিয়ে, অ্যাসেম্বলি খোলা চলবে না। সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকের ভিতর ঢুকাতে হবে। যে ভাইদের হত্যা করা হয়েছে, তার তদন্ত করতে হবে। জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না।... আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই।... আজ থেকে এই বাংলাদেশ কোর্টকাচারী, আদালত ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।...২৮ তারিখে কর্মচারীদের বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, এরপর যদি একটি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় -তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।... সৈন্যেরা, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আর তোমরা গুলি করবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।... এই বাংলায় -হিন্দু মুসলমান যারা আছে আমাদের ভাই, বাঙালি-অবাঙালি, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।... দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে যাতে মানুষ তাদের মাইনেপত্র নিতে পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বাংলাদেশের নিউজ বাইরে পাঠানো চলবে। এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে- বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবে। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন এবং আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

জয় বাংলা।"

২.

ঐতিহাসিকভাবেই অলি-আউলিয়া, আউল-বাউল, সুফি-সাধকের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এমন বিচিত্র ভৌগোলিক সুবিধাসম্বলিত সকল রকমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপলীলা নিয়ে নদীমাতৃক ব-দ্বীপের মানচিত্র শোভিত বাংলাদেশ, যেখানে ১২ আউলিয়ার মধ্যে সীতার বাস। বসবাস উপযোগিতায় এমন একটি ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ, যার রয়েছে ছয়টি ঋতুর নানা বৈশিষ্ট্যের বাহারি চরিত্র। প্রকৃতি ও মাটি গুণের সমন্বিত এমন একটি চারণভূমি, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এসে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ এসে একই সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাশাপাশি স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে শুরু করেছে। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র সকল কিছুকেই দারুণভাবে অভিযোজিত করতে পেরেছে এদেশের শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠা লোকজ সংস্কৃতি। এমনই সুন্দরে বসবাস করতে এসেছিলেন মধুমতির তীরে ধর্মপ্রাণ সুফি সাধক শেখ বোরহানউদ্দিন, যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শেখ পরিবারের গোড়াপত্তন হয়। সেই কবে কতদিন আগে কোত্থেকে এমন সাধু পুরুষ ধর্মপ্রাণ বোরহানউদ্দিন মধুমতির তীরে গোপালগঞ্জ এসেছিলেন, তার সঠিক সময় নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে ২০০ বছরের পুরোনো দালানকোঠা দেখে বুঝতে বাকি থাকে না হয়তো আরও আগে তারা এসেছিলেন বাংলার মাটিতে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ কুদরতুল্লাহ ও শেখ একরামুল্লাহ এই দুই ভাইয়ের পরম্পরা হতে আজ পর্যন্ত ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে শেখ বংশের গোড়াপত্তন নিয়ে সিরাজউদ্দিন আহমেদ রচিত গ্রন্থ 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান' বইটির প্রথম অধ্যায়ে টুঙ্গিপাড়া শেখ বংশ লেখাটিতে শেখ বংশের পরম্পরা তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। তার ভাষায়" বৃহত্তর ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশ বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক পরিবার। শেখ বংশ ইসলাম ধর্ম প্রচার, সমাজ উন্নয়ন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।... প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য শেখ বংশের আদি পুরুষ শেখ আউয়াল ইরাক থেকে চট্টগ্রামে এসেছিলেন।... হযরত শেখ আউয়াল ইরাকের রাজধানী বাগদাদের হাসনাবাদ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত শেখ আউয়াল চট্টগ্রামে কয়েক বছর ধর্ম প্রচারের পর ঢাকা সোনারগাঁওয়ে ধর্ম প্রচারের জন্য আগমন করেন।... শেখ আউয়ালের পুত্র জহিরউদ্দিন ধর্মপ্রচারের সাথে জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা শুরু করেন।... শেখ জমিরউদ্দিন ফরিদপুরের কান্দিরপাড়ের খন্দকার পরিবারে বিয়ে করেন।... কিন্তু ব্যবসার কারণে তিনি কলকাতাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। তার সাথে জমিদার রানী রাশমনির বিরোধ ছিল। শেখ জমিরউদ্দিনের পুত্র জান মাহমুদ। ব্যবসা উপলক্ষে পূর্ব বাংলায় আসেন এবং পাটগাতিতে ব্যবসা করতেন। মধুমতি নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়া গ্রাম তাকে আকৃষ্ট করে। তিনি টুঙ্গিপাড়ার বাইগার নদীর তীরে বসতি স্থাপন করেন।... শেখ জান মাহমুদের পুত্র শেখ বোরহানউদ্দিন। বোরহানউদ্দিন টুঙ্গিপাড়ার কাজী পরিবারে বিয়ে করেন।... শেখ বোরহানউদ্দিনের তিন পুত্র কুদরত রফিকুল শেখ, শেখ তাজ মাহমুদ তেকড়ি, শেখ একরামুল্লাহ। শেখ একরামুল্লাহর দুই পুত্র শেখ মোহাম্মদ জাকির, শেখ মুহাম্মদ ওয়াসিম উদ্দিন। শেখ জাকিরের তিন পুত্র শেখ আবদুল মজিদ, শেখ আবদুল হামিদ ও শেখ আব্দুর রশিদ। শেখ আবদুল হামিদের তিন পুত্র ও চার কন্যার মধ্যে শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমান।

৩.

শেখ পরিবারের আভিজাত্য, জমিদারিত্ব, চড়াই-উৎরাই, শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, মামলা মোকদ্দমার ইতিহাস একপর্যায়ে দরিদ্রতা ছুঁয়ে যাওয়া ২০০ বছরের পুরোনো। বিশেষ ইটের দ্বারা নির্মিত দালানকোঠা, ইংরেজ নীল ব্যবসায়ী রাইনের অত্যাচারের বিপরীতে বিচার ব্যবস্থায় বিজয়ী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে আধা পয়সা জরিমানা করে ইংরেজদের আভিজাত্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার মতো সাহসী ভূমিকা রাখা কিংবা রানী রাসমনির অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যুদ্ধংদেহী কেওয়াজ তৈরি হলে রাসমনির পক্ষের দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল তমিজউদ্দিন আহত অবস্থায় ধরা পড়ে এক পর্যায়ে মৃত্যুবরণ করে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলা মোকদ্দমায় আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে পরিশেষে শেখ পরিবার মুক্তি লাভ করলেও ততদিনে লুটপাটের শিকার হয়ে দরিদ্রতা অনেকটাই তাদেরকে স্পর্শ করে ফেলে । জানা যায়, শেখ পরিবারের সাথে কাজী পরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলেও তাদের মধ্যে গড়ে ওঠা বৈরী সম্পর্ক বিস্মিত করে। শেখ পরিবারের অস্তিত্বকে নিঃস্ব করার প্রয়াসে কাজী পরিবার যে ঘটনার জন্ম দিয়েছিল তা রীতিমতো অবাক করে দেয়। কাজী পরিবারের বৃদ্ধ মুরব্বীকে তার সন্তানেরা মেরে ফেলে শেখ পরিবারের সীমানায় রেখে পুলিশ নিয়ে এসে সবাইকে ধরিয়ে দেয় মার্ডার কেসের আসামি হিসেবে। এ বিচারের শেষ পর্যায়ে এসে শেখ পরিবারের উকিলের আবেদনের প্রেক্ষাপটে মাননীয় আদালত নতুন করে তদন্ত করার নির্দেশ দিলে একজন সিআইডি কর্মকর্তা পাগল বেশে দীর্ঘদিন ওই এলাকায় থেকে কাজী পরিবারের ঝগড়াঝাটির সুযোগে একদিন বের করে আনেন চাঞ্চল্যকর তথ্য। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়াঝাটি করতে থাকলে কে কীভাবে বাবাকে মেরেছে এবং মৃত্যুর আগে বাবা পানি চেয়েছিল, বোন ভাইদেরকে তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল এমন তথ্য সিআইডি কর্মকর্তার প্রতিবেদনে লিখিত জমা পড়লে মাননীয় আদালত শেখ পরিবারের সবাইকে মুক্ত করে প্রকৃত আসামিদের যাবজ্জীবন জেল দেন। এক্ষেত্রেও মুক্তির আগ পর্যন্ত শেখ পরিবার আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও শেষ অবধি শেখ পরিবারের বিজয় ঘটে। বর্ণিত বেশিরভাগ ঘটনাতেই সৃষ্টিকর্তার বিশেষ আশীর্বাদ ও সেই সাথে পূর্বপুরুষের কোনো আধ্যাত্ম আলো এসব ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলোতে যেমন আশ্রয় যুগিয়েছে, তেমনি মুক্তিলাভ করিয়েছে।

৪.

বিস্ময়করভাবে কিশোর বঙ্গবন্ধুর বয়স যখন বারো কি তেরো, তার জীবনে ঘটল বিশ্বের নজিরবিহীন একটি ঘটনা। তিনি জানালেন তার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। বেগম মুজিবের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। শেখ মুজিব পরিবারের ভাই বোনদের সাথে তিন বছরের রেনুর বিবাহিত জীবন নিয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা। কোনো স্বাভাবিক নিয়মে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ছাড়া এমন ঘটনার বাস্তবতা অনুভব করা সত্যিই বিস্ময়কর! কিন্তু সেটিই ছিল বাস্তবতা। ছোট বেলার খেলার সাথী থেকে শুরু করে জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সারথী ছিলেন বেগম মুজিব। এমনকি ঈশ্বরের শুভেচ্ছা দূত হয়ে বাংলার ভাগ্যাকাশে নতুন সূর্য উদিত করতে ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রেও বেগম মুজিব সাহস এবং আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছেন। তার মর্মবাণী এমনটাই ছিল যে, বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য, তাদের মুক্তির জন্য, তোমার জীবনের যে সাধনা ব্রত, জেল জুলুম অত্যাচার নিপীড়ন কষ্ট যন্ত্রণা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে তোমার চেতনায় যে আলো সঞ্চিত হয়েছে, সে আলোটুকুই তুমি উপস্থিত জনতার অন্তরে ছড়িয়ে দিও। অর্থাৎ তোমার মনে যা বলতে চায় দ্বিধাহীন চিত্তে তুমি তা বাংলার মানুষকে বলে দিও। আমরা জানি বঙ্গবন্ধু সেদিন কোনো লিখিত বক্তব্য পাঠ করেননি। তার অন্তর্নিহিত কারণটি মূলত এমন বক্তব্যকেই সমর্থন করে।

৫.

একজন ইতিহাসবেত্তা, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সাধারণ পাঠক বিভিন্নজনের কাছে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রায় একই রকম হলেও জ্ঞান-গরিমা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যজনিত কারণে বিভিন্ন রকমের অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়। ব্যক্তিগতভাবে জ্ঞান অন্বেষণের চিত্রপটে আমার কাছে ৭ মার্চের অনিবার্যতা এবং মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে বেশ খানিকটা ভিন্নতা নিয়ে ব্যতিক্রমী দৃশ্যপট তৈরি করেছে। শোষণ, বঞ্চনা, গঞ্জনার সাথে ’৫২, ’৬৬, ’৬৯ তে বাঙালির রক্তঝরা ইতিহাসে দেহমন যেমন অশান্ত হয়ে উঠেছিল, সেই সাথে ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে বাংলার সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ইতিহাসে নজিরবিহীন জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন এমনকি মৃত্যুর পরোয়ানার আশঙ্কা নিজের জীবন চেতনায় ধারণ করে বিশ্লেষণ করলেই কেবলমাত্র ৭ মার্চের অনিবার্যতা উপলব্ধি করা সম্ভব। ধ্যানে-জ্ঞানে, শয়নে-স্বপনে, প্রার্থনার সময়ের সবটুকুতে কায়মনোবাক্যে কেবলমাত্র মানুষকে ভালোবাসা আর মানুষের ভালোবাসা অর্জন করার মানসে জীবন-যৌবন, সংসার, লোভ-লালসা, মোহ সব কিছুকে বিসর্জন দিয়ে যখন মানুষের মুক্তি কামনা করা হয়, তখন তা চেতনার সাধারণ বৃত্ত ভেদ করে আধ্যাত্মবাদের উচ্চমার্গীয় শাখায় প্রবেশ করে। আধ্যাত্মবাদের এ স্তরে ধরেই নেওয়া হয় সৃষ্টিকর্তার বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট পছন্দের প্রতিনিধিরাই কেবল এমন মার্গে অবস্থান করতে পারেন এবং বিশেষভাবে আলোকপ্রাপ্ত হন। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এ অবস্থায় যে তাড়না সৃষ্টি হয়, তার স্বরূপটা এমন যে অদৃশ্য কোনো শক্তি সারাক্ষণ মনসংযোগে নিয়ন্ত্রিত ও প্রয়োজনীয় সঠিক নির্দেশনা পাঠিয়ে পথ প্রদর্শন করে চলছেন। ৭ মার্চের আগ পর্যন্ত বাংলার ভাগ্যাকাশে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসলে মহাকালের সাক্ষী হয়ে সৃষ্টিকর্তার শুভেচ্ছা দূত হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অমাবস্যার অন্ধকারে বাংলায় যে আলো প্রজ্বলিত করে সারা বাংলার মানুষের মনের অন্ধকারকে দূরীভূত করে মুক্তির আলোয় আলোকিত করেছিলেন, মূলত সেদিনই বিশ্বধরিত্রীতে বাংলাদেশ নামক ভ্রূণের জন্ম হয়। অতঃপর ৯ মাস প্রতিরোধ যুদ্ধ করে ধরিত্রী তার নতুন সন্তান বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে দেন বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। ৭ মার্চ পৃথিবীতে বাংলাদেশের জন্মযাত্রা শুরু হয়, ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ তার চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশে পরিণত হয়। ঠিক যেমনটা একটা মানব ভ্রূণ মায়ের পেটে এসে নয়-দশ মাস পর পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুর জন্ম হয়। যদিও ঐতিহাসিকভাবে ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময়টা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন হিসেবে খ্যাত, যা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের আহবানে বাঙালির দেওয়া চূড়ান্ত সাড়া এবং যা একই সাথে ইয়াহিয়া খান প্রশাসনের চরম বিপর্যয়কেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

৬.

সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে গভীরভাবে অনুধাবনের জন্য কিছু একাডেমিক আলোচনা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রচনাসমগ্রে 'পিতাকে ফিরে পেলাম ' প্রবন্ধে সাতই মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে বাঙালির অদম্য সাহসের একটি বর্ণনা দেন এভাবে যে- "এরই একটা পর্যায়ে আলোচনার জন্য ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসে।... ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউসে (বর্তমান হেয়ার রোডে অবস্থিত 'সুগন্ধা' বাড়িটি) বাবুর্চি রান্না বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ অসহযোগ আন্দোলন। তাই কেউ পাকিস্তানিদের জন্য রান্না করবে না। রান্না করা গরম খবর পাওয়া কঠিন হয়ে পড়লে প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন আসে। কারণ প্রেসিডেন্ট রান্না করা খাবার পাচ্ছেন না। আর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়া তারা রান্নাও করবে না।... ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইয়াহিয়া প্রশাসন সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অভিন্ন সত্তা এবং বাংলার অবিসংবাদিত নেতা।... একদিকে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি, অপরদিকে অসহযোগ আন্দোলন সফল করে পাকিস্তানি মিলিটারি শাসকদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন 'বাঙালি জাতিকে আর কোনোদিন দাবায়া রাখতে পারবা না।' পারে নাই, বাঙালি নেতার এই ভবিষ্যৎ বাণীকে বাংলার মানুষ সত্য বলে প্রমাণ করেছে, বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।"

৭.

কলম্বিয়ান প্রখ্যাত সাংবাদিক এ. এল. খতিব তার 'হু কিল্ড শেখ মুজিব' গবেষণা গ্রন্থে রাজনীতির কবি প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভুট্টো সাহেবের উক্তি তুলে ধরেছেন। ভুট্টো বলেন, 'তখন সারাবাংলা পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। তারা একজন নায়ক খুঁজছিল, পরিস্থিতি মুজিবকে সে নায়কের ভূমিকায় বাছাই করেছিল। তিনি একটি ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিলেন সংগ্রামের আগুন জ্বালানো ব্যক্তি হিসেবে। মুজিব সবসময়ই ছিলেন জনগণের মহান নেতা, মুজিব সৃষ্টি হয়েছিলেন পূর্ববর্তী দুটি সরকারের আমলে করা উপর্যুপরি ভুল এবং ভ্রান্ত হিসাবের কারণে।' খতিব সাহেব আরো বলেন "পরিস্থিতির কারণেই কেবল একজন মানুষ জাতীয় নায়কে পরিণত হন না। মুজিবের সৎ সাহস ছিল অতুলনীয় এবং তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।"

তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল নিউজউইক পত্রিকায় ছাপা হয়, 'গত মাসে মুজিব যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তখন তার সমালোচকরা বলেছিলেন যে তিনি এমন করছেন কেবল তার চরমপন্থী সমর্থকদের চাপে পড়ে, তিনি শুধু একটি বিশাল জনতার ঢেউয়ের উপরে চড়তে চাইছিলেন, যাতে তিনি এর নিচে চাপা পড়ে না যান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির সংগ্রামী নেতা হিসেবে মুজিবের উঠে আসাটা ছিল তার সমগ্র জীবনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে লড়াই করার যৌক্তিক ফলাফল। মুজিব একটি জনতার ঢলের চূড়ায় বসে থাকলেও তিনি ঐ জায়গায় দুর্ঘটনাবশত যাননি।"

এ. এল. খতিব তার বিশ্লেষণে তুলে ধরেন, "মার্চ ১৯৭১ এ মুজিব ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার বার্তাটি স্পষ্ট ছিল। এ কথাগুলো বলে মুজিব তাঁর ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার সাতই মার্চের ভাষণ সর্বকালের সেরাগুলোর মধ্যে একটি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভাষণ অসংখ্যবার বাজানো হয়েছিল। এটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস। জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান থাকা অবস্থায় 'বার্থ অব এ নেশান' শিরোনামের একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যা পরবর্তীতে পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, 'রেসকোর্স ময়দানের সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তা ছিল আমাদের জন্য সবুজ সংকেত।’

ভাষণটি যে স্বাধীনতার আহ্বান ছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এরপরও কেউ কেউ ৭ মার্চ ১৯৭১-এ মুজিব স্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি বলে সমালোচনা করে থাকেন। জনসভার মাধ্যমে কখনও স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয় না। মুজিব সেদিনের জনসভায় প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তা নিঃসন্দেহে আক্রমণের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকা পাক সেনাবাহিনীর পক্ষে যেত। মুজিব এমন কিছু বললে রেসকোর্স ময়দান এবং তার আশপাশে জড়ো হওয়া লাখো মানুষের ভাগ্যে কী হতো, তা ভেবেই আতঙ্কিত হতে হয়। ওই ময়দানের উপরে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ঘোরাঘুরি করছিল। ৭ মার্চ ১৯৭১-এর জনসভা শেষ করার পর মুজিব অসুস্থ বোধ করছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় যারা তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তাদের উদ্দেশে মুজিব বলেছিলেন, 'আমি এখন একজন মুক্ত মানুষ। দায়িত্ব শেষ করেছি।'

৮.

খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে সাতই মার্চের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, ১৯৭০ সালের ১৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তার দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে নৌকা প্রতীক পছন্দ করেন এবং ছয় দফার যে আগুন জ্বেলেছিলেন মানুষের মনে, তার প্রতিফলনে সে বছরই ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে। ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জনপ্রতিনিধিদের শপথগ্রহণ পরিচালনা করেন।

৫ জানুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনে তার সম্মতির কথা ঘোষণা করেন। ২৮ জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তিন দিন বৈঠকের পর আলোচনা ব্যর্থ হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ঘোষণা দিয়ে দুই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান। ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এ দাবিকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে মর্মে দাবি করে বলেন, ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ।

১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু হরতাল আহ্বান করেন এবং হরতাল পালন করার পর বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি দাবি জানান। সেই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চের রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খলমুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন "প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।... রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।"

সাধারণ মানুষকে ভালোবেসে এবং মানুষের ভালোবাসা পেয়ে কতটা ঐশ্বরিক আলোপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তা সহজে অনুমেয় যখন দেখি ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার মানুষ যে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে অতি বিরল ঘটনা। ভাবতে গেলে ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ববাংলাকে স্বাধীন দেশের ন্যায় বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন।

৯.

বিশিষ্ট লোকতাত্ত্বিক ও গবেষক শামসুজ্জামান খান তার নির্বাচিত প্রবন্ধ 'জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণ: একটি অনুপুঙ্খ পাঠ'-এর প্রবন্ধ আলোচনায় সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সংক্রান্তে বিষয়বস্তু ও বঙ্গবন্ধুকে জ্ঞানের যে ক্ষুরধার বিশ্লেষণ করেছেন, তা যে বিশেষণ দ্বারা সাধুবাদ জানালে যথার্থ পূর্ণাঙ্গতা পেতে পারে সে বিশেষণটি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে জানা নেই। বড়জোর আমি পারি তার লেখা থেকে ধার করা শব্দ এই লেখাটির বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করতে- তা হলো, সাতই মার্চকে নিয়ে গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এটি একটি মাস্টারপিস। যে বিবেচনার রূপরেখা নিয়ে আমি ৭ই মার্চের ভাষণ সম্পর্কে লিখতে আগ্রহী হয়েছি, শামসুজ্জামান খানের এ প্রবন্ধের শুরুতেই সে আলোর ছটা আমার চোখে ধরা পড়েছে। পাঠের শুরুতেই বলেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চ ১৯৭১-এর অনন্য ভাষণটি অধিকারবঞ্চিত বাঙালির শতসহস্র বছরের সংগুপ্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের উচ্চারণে সমৃদ্ধ। মাত্র উনিশ মিনিটের ওই ভাষণে তিনি এত কথা অমন অমোঘ তীক্ষ্ণতা, সাবলীল ভঙ্গি, বাহুল্যবর্জিত কিন্তু গভীরভাবে অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া ভাষায় কেমন করে বলতে পারলেন সে এক বিষয় বটে! ভাষণের মূল কথা যদি খুঁজি, তাহলে দেখা যায়- পূর্ব বাংলার মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস ও অধিকারহীনতার বিষয় এতে দীপ্ত হয়ে উঠেছে এবং পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমেই এ অবস্থা থেকে বাঙালির সার্বিক মুক্তি সম্ভব- এই বক্তব্যই বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতা-শৈলীর অতুলনীয় ভঙ্গিতে কখনো আবেগ, কখনো যুক্তি, কখনো প্রশ্ন বা ইচ্ছাকৃত জোরালো পুনরুক্তির মাধ্যমে সোচ্চার করে তুলেছেন, কিংবা বিশেষ স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে সংগত কারণেই কৌশলময় ভাষা বা ইঙ্গিতে শ্রোতাদের মনে গেঁথে দিয়েছেন।... তবে সাতই মার্চের অনন্যসাধারণ ভাষণ, তাঁর এবং শুধু তাঁরই এক চিরকালীন মাস্টারপিস।"

১০.

প্রত্যেকটা স্পেসিসের একটি নির্দিষ্ট জেনম সিস্টেম বা জেনেটিক কোড থাকে। আদি থেকে ট্রানসফর্মেশনের মাধ্যমে সামান্য কিছু পরিবর্তনের ধারা অভিযোজিত করে নিরন্তন চলমান থাকে এই জেনেটিক সিস্টেম। ভার্চুয়াল হিসাবের ধারা সংরক্ষণেও এই কোড খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানুষ হিসাবে পারিবারিক পরম্পরা বিশেষায়িত কোডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যেকোনো পরম্পরায় যখন কোথাও এসে ঠেকে যায়, মাঝখানে কিছু ঠিকানা খুঁজে পায় না, যখন আবার শেষে এসে কিছু ধারাবাহিকতা চলমান হিসেবে পায়, তখন মাঝখানের এই অংশকে গবেষক কিংবা বিজ্ঞানীরা অন্ধকারাংশ কিংবা মিসিং লিঙ্ক হিসাবে আখ্যায়িত করে। অসীমের সাথে সসীমের একটি বিরাট দৃশ্যমান পার্থক্য এখানটাতে। অসীমের ব্যবস্থাপনায় কোডিং পদ্ধতি অনুসরণে কোনো মিসিং লিঙ্ক থাকার সুযোগ থাকে না। তাই তার ব্যবস্থাপনা শতভাগ পরিপূর্ণ।

আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় যে বিষয়টি অনুধাবনের চেষ্টা করতে চেয়েছি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বপুরুষ হযরত শেখ আউয়াল থেকে শুরু করে অনেকেই ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে ধর্মপ্রচারে নিবেদিত ছিলেন। পূর্বপুরুষের মধ্যে কেউ একজন এমন শ্রেণির মার্গীয় সাধক মানুষ ছিলেন যিনি স্রষ্টাপ্রেমের আধ্যাত্ম আলোয় আলোকিত হয়েছিলেন। বিশ্বাস করা হয় এখানেও একটি কোডিং সিস্টেম রয়েছে যা ট্রানসফর্মেশনের মাধ্যমে ওই কোডের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী প্রজন্মেরও কেউ কেউ আলোকিত হন। সাধুভক্তি কিংবা গুরুতত্ত্বে কিছু সাব কোড সিস্টেম লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ, গুরু তাঁর নিজের জীবদ্দশায় নির্দেশিত হয়ে কিংবা আপন প্রেমে ভক্তি পেয়েও কাউকে কাউকে এ বর, আশীর্বাদ কিংবা আলো দিয়ে তার জীবনের অসমাপ্ত কাজগুলো আলোক প্রদত্ত শিষ্যর উপর ন্যস্ত করে যান। যারা পারিবারিক পরম্পরায় এ আলো প্রাপ্ত হন, তারা সরাসরি পারিবারিক কোডের মাধ্যমে প্রাপ্ত হন। আর যারা পারিবারিক বলয়ের বাইরে আশীর্বাদপ্রাপ্ত হন, তারা সাব কোডের মাধ্যমে এ ধ্যানজ্ঞানের আলোপ্রাপ্ত হোন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষকে ভালোবেসে এবং সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে যেমন অসীম আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে পেরেছিলেন আপন মনে, তেমনি তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা বাংলার মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ৪৬৮২ দিন, প্রায় ১৩ বছর জেল জীবনে তিনি যে স্রষ্টাসাধন করেছেন বাঙালির ভাগ্যপরিবর্তনে, তা থেকে তিনি মানবকল্যাণে স্রষ্টার বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আধ্যাত্ম্যবাদের ট্রান্সফরমেশন কোডের বিশেষ আলোপ্রাপ্ত হন।

প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশের জন্মযাত্রা শুরু হয় সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে। গবেষণা, বিবেচনা ও বিচারের সর্বক্ষেত্রে ভাষাশৈলীর ব্যবহার, যুদ্ধের রণকৌশল, বক্তব্যের অভিব্যক্তি সবার কাছে খুব সহজে বোধগম্য করা, বিচ্ছিন্নবাদিতার খপ্পরে পা না দেওয়া, অসহযোগ থেকে স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যা যা করণীয় তার দিকনির্দেশনা দেওয়া, আর যার জন্য বাঙালি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, সুকৌশলে বঙ্গবন্ধু সেই আলোর বিচ্ছুরণ করলেন শেষ লাইনগুলো উচ্চারণ করে 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।' মনে হয়েছে পুরো ১৮ মিনিটের অদৃশ্যমান স্ক্রিপ্ট স্রষ্টাপ্রেরিত কোনো প্রতিনিধি যেন বঙ্গবন্ধুর অন্তরে বসে থেকে বাঙালি জাতির মহানায়কের কণ্ঠে যথাযথ নাটকীয় উপস্থাপনায় মঞ্চস্থ করালেন। সাথে সাথে আলো ছড়িয়ে পড়ল বাঙালির অন্তরাত্মায়। অতঃপর অসহযোগ এবং ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বপ্নের সোনালি লক্ষ্য অর্জন বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।

একই অভিব্যক্তির দেখা মেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রচনাসমগ্রে 'পিতাকে ফিরে পেলাম' শিরোনামে একটি লেখায়। তিনি বলেছেন "লাখো শহীদের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে এসে শ্রদ্ধা জানালেন শহীদদের প্রতি, মা-বোনদের প্রতি, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি তিনি ঘোষণা দিলেন। নীতি আদর্শ নিয়ে দিক-নির্দেশনা দিলেন। দীর্ঘ নীতিনির্ধারণী ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কীভাবে চলবে, অর্থনৈতিক নীতি কি হবে, সামাজিক নীতি কি হবে, রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা দেন। কীভাবে একটা মানুষ পারে, যদি না তাঁর মাঝে কোনো ঐশ্বরিক শক্তি থাকে।... জনতার নেতা প্রথমে ছুটে যান তাঁর প্রিয় জনতার কাছে। তারপর ফিরে আসেন পরিবারে, আমাদের কাছে। সেখানে পা দিয়েই প্রথমেই দাদা-দাদিকে সালাম করেন। তারপর গেলেন আমার মায়ের কাছে। আবেগে জড়িয়ে ধরেন দুজন দুজনকে। মুহূর্তটা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। এ আলিঙ্গন যেন কোনোদিন বিচ্ছিন্ন হবার নয়। কি ধৈর্য, কি মহান ত্যাগ, কি দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এ মহামিলন! সত্যিই আর বিচ্ছিন্ন হননি। মৃত্যুতেও দুজন একই সঙ্গে ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন এ পৃথিবী ছেড়ে।"

লেখক: পুলিশ সুপার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :