বাংলাদেশের ৫০ বছর: অগ্রগতি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

জি এম কিবরিয়া
 | প্রকাশিত : ০৮ মার্চ ২০২১, ১১:০৮

গল্পটি হলো, একদা নুহু নবীর কিস্তি, অবিশ্বাসীরা মল ত্যাগ করে ভরে ফেলল। নুহু অতি দুঃখে ফরিয়াদ করল, হে পরোয়ার দিগার---! স্রষ্টা (হয়তো) মৃদু হাসলেন।

এদিকে এক অবিশ্বাসী অন্ধ অতি বৃদ্ধা মহিলা আক্ষেপ করে বললেন, "সবাই খুশি মনে মল ত্যাগ করছে, আমি বাদ যাব কেন?" অন্ধ বৃদ্ধা নাতনির সহযোগিতায় যে প্রাকৃতিক কাজ তে গিয়ে হঠাৎ সে মলভর্তি কিস্তিতে (নৌকো) পড়ে গেল! হাজার হাজার দর্শক মুহূর্তেই হাই হাই করে উঠল। বৃদ্ধা কিস্তির তরলের মধ্য থেকে মাথা উচিয়ে চিৎকার করতে লাগল, ‘আমি তোমাদের সবাইকে দেখতে পাচ্ছি! আমার চোখ ভালো হয়ে গেছে!’ অবিশ্বাসীরা তখন হাজার চোখে দেখল, বৃদ্ধার শুধু চোখই ভালো হয়নি, সে এক অপরূপা যুবতী হয়ে গেছে! তাৎক্ষণিক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল, কিস্তির তরল গায়ে মাখলেই তক লাবণ্য ও সৌন্দর্যময় হয়ে ওঠে কি না! অবিশ্বাস্য! সত্যিই তো!! রাষ্ট্র হয়ে গেল সেই খবর রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন রাষ্ট্রে। কিস্তির মল উধাও হয়ে গেল! যারা বোতলে সঞ্চয় করছিল, তারা চড়া দামে বিক্রি করল। কিস্তি ধোঁয়া পানিও শ্যাম্পেনের অধিক কদর পেল!

পরিবেশবাদী আন্দোলনের অংশীদার হিসাবে মাঝেমধ্যেই ভাবি যে, এদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়ে অলৌকিক কিছু করে দেন, হে খোদা! প্লিজ, কুদরতি কিছু একটা করুন দয়াল! এই ভাবনার পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় খবর এল পঙ্গপাল এখন আর সমস্যা নয়, সম্পদ! যে পঙ্গপাল ভারত, পাকিস্তান, ইথোপিয়া, কেনিয়া, উগান্ডাসহ সারা আফ্রিকার খাদ্য ভান্ডারকে তছনছ করে দিচ্ছে, বিশ্বকে ঠেলে দিচ্ছে খাদ্য সংকট বা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দিকে, বিশ্ব খাদ্য সংস্থাসহ বিশ্বনেতৃত্বের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে, সেই পঙ্গপাল কি না বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি আধা ডলারে!

উত্তেজনা নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। সারা বিশ্ব যেখানে অনেক আগেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চমৎকার জৈব সার, প্লাস্টিক চিপস, বায়ু গ্যাস, তৈরি করছে, আমরা কেন ঢাকা শহরের চমৎকার পিচঢালা পথকে শীতে ধুলো ও বর্ষায় কাদা আর আবর্জনার রাজ্য বানিয়ে রাখলাম দশকের পর দশক?

৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই। গত ১৫ মার্চ জাতিসংঘ (সিডিপি) বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছে। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে এর চেয়ে বড় উপহার আর কী হতে পারে! স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে এরূপ অনেক অগ্রগতি আছে যা জাতি হিসাবে আমরা গর্বের সাথে উচ্চারণ করতেই পারি। যেমন: ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয়, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ইত্যাদি।

তাছাড়াও পরিসংখ্যানগত তুলনাও করতে পারি! যেমন: ১৯৭২-৭৩ এর প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা আর ২০২০-২১-এর বাজেট ৫,৬৮,০০০০ কোটি টাকা; মাথাপিছু আয় ছিল ১৯৭১ সালে ১৪০ ডলার আর ২০২০ সালে ২,০৬৩ ডলার।

দুর্নীতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা আছে বা থাকতে পারে, কিন্তু আমার আলোচনা সেদিকে নয়; স্রেফ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

এখানে একটি প্রশ্ন উদিত হতেই পারে যে, বিগত ৫০ বছরে জাতি হিসেবে আমাদের অর্জনগুলো পরিবেশগত অসচেতনতা কিংবা কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে ম্লান হয়ে যাচ্ছে না তো?

ঢাকার রাস্তা-ফুটপাতে ময়লা আবর্জনার চালচিত্র দেখে আমরা নাগরিকরা এই দায় আমার নয় কিংবা এটি সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা বলে আকাশের দিকে তাকাতেই পারি! উপরে উদীয়মান দশ-বিশ তলার দিকে তখন চোখ পড়বে! আর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলতেই পারেন, আমরা এখন উন্নয়নশীল জাতি! কিন্তু অন্যের চোখ (কোনো বিদেশি বা সভ্য জাতি) কি আমাদের সভ্যতার উচ্চস্তরে ঠাঁই দেবে?

না। তারা দেখবে তাদের চোখেই। যেমন: এনভায়রমেন্ট পারফরমেন্স ইনডেক্স-২০২০ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম (সূত্র: উইকিপিডিয়া)। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

এবার আসুন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটু একাডেমিক আলোচনা করি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কী? বর্জ্য সাধারণত কঠিন, তরল, গ্যাসীয়, বিষাক্ত ও বিষহীন- এই পাঁচ রকমের হয়ে থাকে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, সমস্ত জীবকূলকে রোগের হাত থেকে রক্ষা, পরিবেশদুষণ ও অবনমন রোধের উদ্দেশ্যে আবর্জনা সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পুনব্যবহার এবং নিষ্কাশনের সমন্বিত প্রক্রিয়াকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলা হয়।

কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কী? সমন্বিত এবং সম্পূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্জ্য বস্তুর উৎপাদন কমানো, সুন্দর নগর পরিবেশ সৃষ্টি ও বর্জ্য থেকে বিকল্প আয়ের উৎস বের করাকে আমি কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলব। এ ক্ষেত্রে তিনটি R নীতি অনুসরণ করা যায়। তিনটি R নীতি হলো- Reduce (কমানো), Re-use (পুনর্ব্যবহার) এবং Recycle (পুনশ্চক্রীকরণ) ।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আইন কী বলে?

পরিবেশ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়ে এদেশে অনেক আইন-কানুন ও বিধিবিধান রয়েছে। সংবিধানের চেয়ে বড় কোনো আইন নেই! সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে, “জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।”

এছাড়াও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১৮ (ক) ধারা যোগ করা হয়েছে যে, “রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।”

কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না কেন?

জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ মহানগরী। এজন্য এখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

১। জনসংখ্যার আধিক্য; ২। নাগরিক সচেতনতার অভাব; ৩। গৃহীত পদক্ষেপগুলো মনিটরিংয়ের অভাব; ৪। সমন্বয়হীন উন্নয়ন (একজনে রাস্তা করে গেল অপর কর্তৃপক্ষ রাস্তা কেটে পূর্বাবস্থা না করেই চলে গেল); ৫। উন্মুক্ত নির্মাণকাজ (বিশেষ করে খোলা ট্রাকে বালু বা মাটি পরিবহন); ৬। দীর্ঘ মেয়াদে রাস্তা বা নালা উন্মুক্ত করে নির্মাণ, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার (এখানে জবাবদিহিতা অভাব পরিলক্ষিত, নতুবা কয়েক বছরের মধ্যেই রাস্তা ফুটপাত মেরামতের প্রয়োজন হতো না) ৭। স্কুল পর্যায়ে শিশুদের সচেতনতা সৃষ্টি না করা; ইত্যাদি।

সুপারিশ

তবুও সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ ঢাকায় রূপান্তরিত করা কোনো কঠিন কাজ নয়। ক্লিন গ্রিন বাংলাদেশ আন্দোলন নিয়ে আমরা এক বছরের বেশি সময় কাজ করছি। এ সময় আমরা বাস্তবিক অর্থে এই সমস্যা নিয়ে কাজ করেছি, সমস্যা বিশ্লেষণ করেছি ও নাগরিকদের সাথে কথা বলেছি, বাস্তবিক কর্মসূচি পালন করে তা পর্যবেক্ষণ করেছি। এই অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু সুপারিশ তুলে ধরছি:

১। বর্জ্যকে সম্পদের পরিণত করতে হবে। ২০১৯ সালে বিশ্ব বসতি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘Frontier Technologies as an Innovative Tool to Transform Waste to Wealth’ অর্থাৎ ‘বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার’। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রতিপাদ্যটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ। এক্ষেত্রে উপরে বর্ণিত গল্প ও কেনিয়ার উদাহরণ টনিকের মতো কাজ করবে।

যেমন, প্রতিটি বাসায় দুটি করে (সবুজ ও লাল) ডাস্টবিন সরবরাহ করতে হবে। ফলে পচনশীল ও অপচনশীল দ্রব্য সহজেই আলাদা করা যাবে। সিটি কর্পোরেশন এই বর্জ্যগুলো ওজনভিত্তিক কিনে নেবে। তবে ময়লা কেউ রাস্তায় ফেলবে না, যত্ন করে রেখে দেবে। এই ময়লা রিসাইকেলিং করে জৈব সার বা অন্য প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে।

২। প্রতিটি স্কুল-কলেজে ছাত্র শিক্ষকের অংশগ্রহণে শরীরচর্চা ও জাতীয় সংগীতের পর প্রতি সপ্তাহে মাত্র ৫ মিনিটের একটি পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি পালন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এটি খুবই কার্যকর কর্মসূচি, যা সিজিবি পালন করছে এবং আমরা দেখেছি এটি খুবই কার্যকর।

৩। নির্মাণের জন্য বালু ও মাটি বস্তায় ভরে পরিবহন করতে হবে। অর্থাৎ বালু-মাটি খোলা ট্রাকে পরিবহন (ঢাকায়) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। এই বালু রাস্তার পড়ে এবং বাতাসে উড়ে।

৪। উন্নত দেশের মতো যতটুকু রাস্তা বা ড্রেন মেরামত করা হবে ততটুকু কাজ একদিনে বা একরাতে সম্পূর্ণ করে ফেলতে হবে। পরেরদিন যতটুকু সম্পূর্ণ করা যাবে ততটুকু রাস্তা কাটতে হবে। কোনোমতেই রাস্তা বা ড্রেন কেটে দিনের পর দিন ফেলে রাখা যাবে না।

৫। প্রচলিত আইন যথাযথ প্রয়োগ ও শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে।

আমার মনে হয়, যে আইন বাংলাদেশে আছে তা যথেষ্ট। উপরোক্ত ৫টি সুপারিশ যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে পরিবেশগত উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। ফলে পরিবেশগত সূচকের পাশাপাশি জ্ঞানভিত্তিক সূচকেও বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি লাভ করবে আর টেকসই হবে এদেশের উন্নয়ন। আমরা হবো অনন্য এক সভ্য জাতি।

লেখক: ক্লিন গ্রিন বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :