অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্ক জোরালো হবে কি?

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ১৬ মার্চ ২০২১, ১০:৫৫
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। করোনা ভাইরাস বদলে দিয়েছে বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্র। করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশ বিশ্বকে তাকে লাগিয়ে দিয়েছে বললে ভুল হবে কি?
অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিক মানের সেবা, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি সর্বোচ্চ মানবতাবাদী অবস্থান এবং সর্বোপরি সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাংলাদেশকে যেন এক উঁচুমাত্রায় নিয়ে গেছে বিগত এক দশকে। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষায় বাংলাদেশ এক ধ্রবতারা।
যখন বিশ্ব করোনা ভাইরাস দমনে ব্যস্ত, তখন কঠিন এক ব্রত (নিয়ন্ত্রণ চিন্তা) মাথায় নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক সরকার এগিয়ে চলেছে। রক্তে রঞ্জিত রাজপথ! পেছনে নাকি আছে চীন। এই রটনা সামরিক জান্তাদের চেষ্টাকে অধিকতর চাপে ফেলেছে। চীন নেপাল, ভুটান , শ্রীলংকা, বাংলাদেশ জয় করেছে অর্থনৈতিক বন্ধু হয়ে। কিন্তু মিয়ানমার জয় করবার বাসনাকে ভিন্নচোখে দেখছে বিশ্ববাসী।
উদ্বিগ্ন বিশ্ব তাই নতুন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্মাণে অগ্রসর হচ্ছে। সেই প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া একটি Alliance গঠনের চেষ্টা করছে। ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অস্ট্রেলিয়া সবচেয়ে উদ্বিগ্ন চীনকে নিয়ে। আর সেজন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী টেলিফোন আলোচনা করেছেন।বোঝা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারতের মতো অস্ট্রেলিয়াও বাংলাদেশেকে পাশে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ কি চীন থেকে সহসা সরে আসবে? কিছু দিন পরে আবার চীন তাদের বন্ধু হবে- তখন বাংলাদেশ-ভারত অচেনা হয়ে যাবে কি?
বাংলাদেশের মানুষ অস্ট্রেলিয়াকে যেমন বন্ধু মনে করে, তেমনি চীনকেও- যদিও একসময় চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং, বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বন্ধুত্ব সম্পর্ক জোরালো করা ছাড়া অন্য কোনো কিছু ভাবনার সুযোগ এখানে থাকছে না বলেই মনে হচ্ছে। সু চির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অস্ট্রেলিয়ান হলেও রোহিঙ্গা শরণার্থী ফেরার ব্যাপারে তেমন ভূমিকা বাংলাদেশ দেখেছে কি? একটি শূন্যতা সেখানে ছিল কি?
একসময় অস্ট্রেলিয়া ভারতীয়দেরকে যেখানে পেয়েছে মেরেছে। তখন চীন তাদের বন্ধু ছিল। সে সময় বাংলাদেশকেও প্রকারান্তরে উপেক্ষা করেছে বললে ভুল হবে না হয়তো। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হলো সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব হবে? যেভাবে চীন তাদের অবস্থান বিশ্ব দরবারে নির্ধারণ করছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ কিভাবে চলবে? ভারতকে বাংলাদেশ সব সময় পাশে রাখবে। ১৯৭১ সাল থেকে রচিত এই বন্ধন কেউ ছিন্ন করতে পারবে না। চীন চাইলেও সেখান থেকে সরাতে পারবে কি? আর আরও যৌক্তিক প্রশ্ন হলো চীন সেটা চায় কি ?
করোনা উত্তর বিশ্ব রাজনীতি চীন -বাংলাদেশ সম্পর্ককে ব্যাহত করবে না বলে আমার বিশ্বাস। আমরা চীনা ভ্যাকসিনকে গ্রহণ করিনি বটে; কিন্তু চীন বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ পূর্তি এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে জাতির পিতার ভাস্কর্য পাঠাতে ভুল করেনি- যদিও তারা ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার হত্যাকারীদেরকে আশ্রয় ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার নামে অবৈধ সরকারকে বৈধতা দিয়েছিলো।
অস্ট্রেলিয়া নতুন কিছু করছে কি? আমি দুটি চিঠি লিখেছিলাম প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ জানিয়ে করোনা মোকাবেলায়। ৯ মাসেও উত্তর মেলেনি। তেমন কোনো সহযোগিতাও মরিসন সরকার করেছে বলে জানিনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরিসে পাইন ভারত -যুক্তরাষ্ট্র -জাপানকে নিয়ে সম্মেলন করে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি যদি আগেই যোগাযোগ করতেন- সেটা আরও effective হতো কি?
৯/১১র পর বিশ্ব রাজনীতিতে যে পরিবর্তন দেখা গেছে, তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বিদেশী মিশনগুলো দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখে ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ পররাষ্ট্র নীতিতে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব যুক্ত করলেও সমাজতন্ত্র বিরোধীরা বঙ্গবন্ধু সরকারকে মানতে চাইছিলো না। এর কারণ সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এবং পাকিস্তান কতৃক চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের কানে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে বিষঢালা। ৯/১১ সেই বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়। তারা বুঝতে পারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের প্রকৃত বন্ধু। আর তাই বারবার নানা কূটকৌশল প্রয়োগ করে পাকবন্ধুরা বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে।
১৯৭১ সালে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ওডারল্যান্ড বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ১৯৭২ সালে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। একসময় দুইদেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পূর্ব তিমুরকে গড়েছে। এমনকি ১৯৯৮ সালে ভারত -পাকিস্তান পারমানবিক বোমা ফাটালে ভারত -পাকিস্তানকে দেয়া সকল বৃত্তি বাংলাদেশকে দিয়ে দেয়। এরপর কেন জানি সেখানে ভাটা পড়ে। আজ অস্ট্রেলিয়া তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে কি? নাকি তারা বাংলাদেশকে চীন থেকে দূরে সরাতে চায়? সেটা অনুমান করা কঠিন কি? অস্ট্রেলিয়া শরণার্থী বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখে। সেই বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা। কিন্তু সেভাবে অস্ট্রেলিয়া ছিল না বোঝা যায়।
অস্ট্রেলিয়া একসময় চীনের প্রতি খুবই উদার ছিল। মেলবোর্ন -সিডনি শহরের রাস্তায় নামলে মনে হতো যেন চীনে আছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেও একই অবস্থা। বাংলাদেশও চীনকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকি ভারত তার মাটিতে চীনকে নির্মাণ কাজে নিয়োগ দিয়েছে। এভাবে চীন যখন বিশ্ব জয় করছে তখন কোথায় যেন বাঁধ সেধেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪ বছর চীনকে কোণঠাসা করে রেখেছে। সেখানে ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ফলে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি -বাণিজ্য বিঘ্নিত হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার কিসের জন্য চীনকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাচ্ছে বোঝা মুশকিল। আমার মনে হয় ভারত-বাংলাদেশ এর মতো এশিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া চীনকেও পাশে রাখতে পারে। চীনের সঙ্গে বিরোধ খুব একটা উপকার করবে বলে মনে হচ্ছে না।
অস্ট্রেলিয়া সম্প্রতি বাংলাদেশে মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এমন সিদ্ধান্ত আরো আগেই নেয়া দরকার ছিল। বাঙালিদের ভালোবন্ধু হিসেবে অস্ট্রেলিয়া পেতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের মন অন্য যেকোনো দেশের মানুষের মন থেকে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তার সঙ্গে আছে কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। তাই তারা কুয়েত মুক্ত করতে সেই দেশের পাশে থেকেছে।
অস্ট্রেলিয়া খরচের দোহাই দিয়ে হাই কমিশন দিল্লি নিয়ে গিয়েছিলো। পেছনে যুক্ত ছিল জঙ্গিবাদ। আমরা আরো দেখেছি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বন্ধ করা হয়েছিল ঐরকম জঙ্গিবাদ ভীতি থেকে। বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে তারা জঙ্গিবাদ বিশ্বাস করে না বা লালন পালন করে না। তারা মুসলিম চেতনাকে মনে করে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। ইসলামকে তারা শান্তির ধর্ম মনে করে। ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য-লেলিনবাদ বা মাওবাদ ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের জন্য নয়।
আমার আশা অস্ট্রেলিয়া সরকার হাই কমিশন ঢাকায় ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। তাতে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাবে। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এই নীতি থেকে বাংলাদেশ বিচ্যুত হবে না বলে আমার আস্থা। ঢাকা-অস্ট্রেলিয়া বিমান চালু হতে পারে, অধিক শিক্ষার্থীকে অস্ট্রেলিয়া বৃত্তি দিতে পারে, ঢাকায় একটি টেকনিকাল ইনস্টিটিউট ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে। এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে পারে সেখান থেকে দক্ষ -অদক্ষ শ্রমিক আসার অনুমতি দিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনে যদি অস্ট্রেলিয়ার কোনো দায় থাকে তবে বাংলাদেশ সেখানে অগ্রাধিকার পাবে। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক আরও জোরালো হোক।
লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :