দেশজ প্রগতিশীলতাই বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
| আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২১, ১১:৪৪ | প্রকাশিত : ১৭ মার্চ ২০২১, ০৯:৩৫

যারা নিজস্ব লোকজ আধার ও প্রকৃতি থেকে নির্বাচিত জ্ঞান ও নির্যাসিত বোধ অর্জন করে তা কর্ষণ ও বিকশিত করার মধ্য দিয়ে প্রগতির চেতনা অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবোধের চেতনাই প্রকৃত জাতীয়তাবাদ। যার বহিঃপ্রকাশ অভিব্যক্তির সবটুকুর মধ্যে স্বদেশ অঙ্গের ভাবধারায় প্রচলিত শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা, শিল্প-সাহিত্য, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির স্বকীয়তা বিদ্যমান। এই চর্চার প্রগতিশীলতা কল্যাণমুখী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করে।

দলীয় বৃত্তের বাইরে অবস্থিত সাধারণ মানুষকে সহজে আকর্ষিত করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে দেশজ প্রগতিশীলতার। আরেকটি বিশেষ চরিত্র প্রস্ফুটিত রয়েছে তা হলো শিক্ষিত শ্রেণির পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সহজে অভিযোজন করানো যায়। যার নিজ অঙ্গে শ্রেণিবিভাজন দৃষ্টিভঙ্গিজনিত শ্রেণিশত্রুর ভাবনা নেই। সেদিক থেকে এটিই আসলে ক্লাসিক প্রগতিশীলতা।

স্বদেশের আদি হতে গড়ে না উঠে কেবল বিদেশি প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতাদের অনুসরণ করে এবং পাঠ্যপুস্তকের তত্ত্ব দ্বারা প্রেষিত হয়ে যারা প্রগতিশীল রাজনীতি করেন, তাদের হাত ধরে জাতীয়তাবাদের সফলতা আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

জাতীয়তাবোধে গড়ে ওঠা প্রগতিশীলতার সঙ্গে বিদেশি ভাবনার প্রগতিশীলতার স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ঈর্ষাকাতরতা, অসহিষ্ণুতা ও পাণ্ডিত্যের ক্ষতিকর প্রভাব তুলনামূলক বিশ্লেষণে প্রতিক্রিয়াশীল আচরণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই প্রতিক্রিয়াশীলতা কখনো দলবদল করে অন্য দলে যোগদান করলেও শেষ দিন পর্যন্ত সুযোগের অপেক্ষায় থাকে যেখান থেকে এসেছে তাদের নির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার মানসিকতায়। সময় এবং সুযোগ পেলে সে ঠিকই ছোবল মেরে নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়।

ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের ব্যক্তিদর্শনে সফল মহানায়ক রাজনীতির কবি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বস্তুত, বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতির পিতার হাত ধরেই দীর্ঘ পথপরিক্রমা করে পরিপূর্ণতা লাভ করে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত ফোকলোর শামসুজ্জামান খানের নির্বাচিত প্রবন্ধে শেখ মুজিব কেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা এবং বাঙালির জাতির জনক, সেই বিশ্লেষণে বলেন- "শেখ সাহেবের অতুলনীয় কৃতিত্ব এখানে যে, বাংলাদেশের চারটি ধর্মে বিভক্ত অসম ও অসমন্বিত উপাদানে গঠিত বাঙালি জাতির এবং প্রায় ঊনপঞ্চাশটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে একই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অটুটে ঐক্যে গ্রথিত করে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। এ রকম সাফল্য নজিরবিহীন।"

তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে কয়েক শ বছরে যে বাঙালি জাতি গড়ে ওঠে, তা ছিল একটি নৃগোষ্ঠী মাত্র। একই ভাষা ও সাধারণ আর্থ-সামাজিক জীবনধারার বিকাশের ফলে এবং শারীরিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক গড়নের সাযুজ্যে এই নৃগোষ্ঠীর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও বহু ক্ষেত্রের নানা মনীষীর স্ব-স্ব ক্ষেত্রে চিন্তার নব নব বিন্যাসে একটি উন্নত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। প্রায় তিন দশকের স্বাধিকার ও সুপরিকল্পিত স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তা একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে। এই জাতিরই মূল স্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমান।"

১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিভাজনে বিভাজিত হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফসল হিসেবে ভারত কিংবা পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়নি। ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব বিবেচনা করে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জেল জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তখনকার বাস্তবতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, পরবর্তীতে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় থেকেও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিপ্লবী চেতনায় নিজেকে শানিত করে যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পৃথক জাতিরাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিলেন, তখন সে স্বপ্নযাত্রায় নিজস্ব দর্শন প্রতিফলনে নিজ হাতে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগের জন্ম দেন। ধীরে ধীরে রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব করে গড়ে তুলতে ছাত্রলীগকে নিজস্ব চেতনাজাত প্রগতির ধারায় নানা কর্মসূচিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করান। প্রস্তুত হতে থাকে ছাত্রলীগ। মহান নেতার নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এক কথায় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের ভূমিকা অনন্য অসাধারণ।

বলে রাখা জরুরি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে তারই নেতৃত্বে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও ফজলুল হক মনিকে নিয়ে ১৯৬১ সালে নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। ’৬২ থেকে পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসকে কাজে লাগিয়ে বাঙালি জাতির জন্য শুরুতেই কিছু স্লোগান তৈরি করার দায়িত্ব দেন, যা সব বাঙালির শোষণ-বঞ্চনার বিপরীতে গড়ে ওঠা আবেগ থেকে নিঃসরিত। জাগো জাগো, বাঙালি জাগো, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, শুরুতেই স্লোগান দুটি বঙ্গবন্ধুর খুব পছন্দ হয়। এভাবে আরও বেশ কতগুলো স্লোগান নির্মিত হয়, যার প্রায় সব কটিই এদেশের মা-মাটি-মানুষের গভীর আবেগ থেকে উৎসারিত এবং জাতীয়তাবোধের চেতনা দ্বারা নির্মিত।

অপরদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান কবিতা বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবোধে অসামান্য অবদান রেখেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'- রবীন্দ্রনাথের এই গানকে জাতীয় সংগীত করবেন ভাবনাটির প্রকাশ লক্ষ করা যায়, যখন পঞ্চাশের দশকে সনজীদা খাতুন এবং ষাটের দশকে অজিত রায়কে দিয়ে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন এ গান বারবার পরিবেশন করিয়েছিলেন। আরও একটি গান ডি এল রায়ের রচনা 'ধনধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা' বঙ্গবন্ধু খুব পছন্দ করতেন। সময় পেলে এ দুটি গান গুন গুন করে গাইতেন তিনি। আর সুযোগ পেলেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন।

রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমস্ত ভাবনাজুড়ে অনন্য মাত্রার দেশাত্মবোধ, দেশজ সংস্কৃতির নির্যাস এবং সাধারণ মানুষের ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূরীকরণ তথা অর্থনৈতিক মুক্তি এবং তা বাস্তবায়নে জাতীয়তাবাদী একটি স্বপ্ন রাষ্ট্র উপহার দিতে যেসব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ পর্যায়ক্রমে গ্রহণ করেছেন, তার সবকিছুতেই এমনকি রণকৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ধার করা চিন্তাকে তিনি পরিহার করে অর্থাৎ ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে সম্মুখযুদ্ধ পরিহার করে পাক সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে শুরুতেই যুদ্ধকৌশলে বিচ্ছিন্নবাদিতার পরিচয় না দিয়ে তিনি বেছে নিলেন গেরিলা যুদ্ধ। সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে কৌশলের অংশ হিসেবে স্পষ্ট করেই বললেন- "তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।" রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে বললেন তিনি, এমনকি যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশমাতাকে রক্ষা করার জন্য নির্দেশনা দেন।

গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের শক্তিশালী দর্শন উপস্থাপন করে জাতিরাষ্ট্রের নতুন সংবিধান প্রণয়ন করলেন। একাডেমিক আলোচনায় যে যেভাবেই বলুক না কেন, এই চারটি মূলনীতির পুঁথিগত ভাষা যা কিছুই প্রকাশ করুক না কেন, বঙ্গবন্ধুর অন্তরে এ চারটি মূলনীতির সবটুকু বোধে দেশজ ভাবনার স্বকীয়তা বিদ্যমান। তার সমাজতান্ত্রিক চিন্তার বোধটুকু একেবারেই নিজস্ব ঘরানার নিজস্ব চেতনা দ্বারা নির্মিত একান্তই তার নিজের ভাবনাজাত স্বকীয় সমাজতন্ত্র। সমবায়ভিত্তিক চিন্তা-চেতনা সমর্থিত ছিল এটি। বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় তার নিজস্ব বক্তব্যে উঠে এসেছে- “সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না, এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন। বাংলাদেশে ধনীদের আমি আর ধন সম্পদ বাড়াতে দেবো না। বাংলার কৃষক, মজদুর, বাংলার বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক এ দেশে সমাজতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করবে।” (বঙ্গবন্ধু; সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ৭ জুন, ১৯৭২)

সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার বাম সংগঠনের কমরেডদের চিন্তা-চেতনা ও আভিজাত্যের সবটুকুতে বিদেশি ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়। নিজস্ব ভাবধারার বিপ্লবী চেতনার সঙ্গে তাদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মকৌশলে বিস্তর ফারাক লক্ষ করা যায়। যেকোনো প্রেক্ষাপটে স্থানীয় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেয়ে শেখানো বুলি শ্রেণিশত্রু প্রভাবক সিদ্ধান্ত গ্রহণে খুব বেশি ঝোঁক কাজ করে থাকে। সামাজিক প্রেষণা খুব একটা কার্যকরি কৌশল হিসেবে সমাজ পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে বিবেচিত হতে দেখা যায়নি। বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যারা ভাগ্য পরিবর্তনের রাজনীতি করেন, এসব নেতা কখনো ওই জাতীয় মানুষের সঙ্গে এক পাটিতে ঘুমানোর কোনো রেকর্ড তৈরি করেননি তাদের পুরো জীবদ্দশায়।

গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, জাতীয়তাবাদের চেতনা নির্মাণে তাদের কর্মকৌশল খুব দুর্বল। বিশেষ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের প্রেক্ষাপটে জাতীয়তাবাদী চেতনা নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্বের দৃশ্যমান প্রতিফলন বাংলার সাধারণ মানুষের আবেগকে পুরোপুরি স্পর্শ করতে পারেনি। দেশজ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বাম রাজনীতির দর্শনের সঙ্গে উৎকৃষ্ট রসায়ন তৈরি করতে না পারায় বাংলাদেশ-উত্তর ৫০ বছরে এসেও এ দেশের মানুষের কাছে তারা বাম রাজনীতিকে গ্রহণযোগ্য করাতে পারেননি।

জাতীয়তাবোধ তৈরি করতে মহান জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান একটানা তিন দশকের শ্রম-ঘাম, সংগ্রাম, জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সমস্ত প্রতিবন্ধকতার ঊর্ধ্বে ওঠে বাংলার মানুষকে ভালোবেসে এবং বাংলার মানুষের ভালোবাসা নিজে হৃদয়ে ধারণ করে লালন করার মধ্য দিয়ে নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও রাজনীতির দর্শনকে পর্যায়ক্রমে বাঙালির অন্তরে গ্রথিত করে যে স্বকীয় চেতনাবোধের জন্ম দেন, সেটাই মূলত বাঙালির মূল জাতীয়তাবাদ। সে মন্ত্রে বাঙালি জাতিকে দীক্ষিত করে বাঙালি জাতির দিকপাল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নিজ হাতে বাংলাদেশের জন্ম দেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :