কোরিয়ায় করোনা সন্দেহের তীর বিদেশিদের দিকে কেন?

মোহাম্মদ হানিফ, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে
| আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২১, ১৩:৫১ | প্রকাশিত : ১৯ মার্চ ২০২১, ১০:৩৬

দক্ষিণ কোরিয়ায় সব বিদেশি কর্মীর করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে দেশটির সরকার। ধাপে ধাপে কোরিয়ার প্রতিটি প্রদেশে চলছে এই কার্যক্রম। সিউল, গিয়োংগিদো প্রদেশের বিদেশি কর্মীদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশকে বিদেশি বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এই কর্মসূচিকে বৈষম্যমূলক ও অপ্রয়োজনীয় বলে সমালোচনা করছেন অনেক কোরীয়।

গত ৮ মার্চ স্থানীয় প্রশাসন গিয়োংগিদো অঞ্চলে সব বিদেশী কর্মীকে ২২ মার্চের মধ্যে এবং সিউল অঞ্চলের কর্মীদের ৩১ মার্চের মধ্যে করোনভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য একটি নোটিশ জারি করে।

আদেশ অনুসারে এই সময়কালে যদি কোনো ব্যক্তি করোনা পরীক্ষা করতে ব্যর্থ হন তাকে অবশ্যই ৩ মিলিয়ন উয়ন (২৬০০ ডলার) পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে। তবে পরীক্ষা না করা ব্যক্তির মাঝে যদি করোনা সংক্রমণ দেখা দেয় তাহলে জরিমানার পাশাপাশি চিকিৎসার সব ব্যয়ভার তাকেই বহন করতে হবে।

গত সপ্তাহে আশপাশের গিয়োংগিদো প্রদেশে একই ব্যবস্থা গ্রহণের পরে, বিদেশি কর্মীদের ৩১ মার্চের মধ্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার আদেশ জারি করে তাদের নিয়োগকারীদের নোটিশ পাঠিয়েছে সিউল মেট্রোপলিটন প্রশাসন।

দ্য কোরিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোরিয়ায় অবস্থানরত অনেক বিদেশি মনে করেন, ভাইরাসটি সংক্রমণ এবং ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ‘উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী’ হিসাবে সব বিদেশি কর্মীর প্রতি বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করছে দক্ষিণ কোরিয়া। কাদের পরীক্ষা করা দরকার এবং অপ্রতুল প্রস্তুতির অপ্রত্যাশিত নির্দেশিকা সম্পর্কেও অভিযোগ করেছেন অনেক বিদেশি।

গত বছরের ডিসেম্বরের পরিসংখ্যানে হিসাবে শহরে ২ লাখ ৪২ হাজার ৬২৩ জন নিবন্ধিত বিদেশি কর্মী রয়েছে। তবে নগর কর্মকর্তারা অনুমান করেছেন যে মোট সংখ্যা ৩ লাখ ৯০ হাজারের বেশি হতে পারে।

দ্য কোরিয়া টাইমসের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, জেনিফার ফ্লিন (সিউলের কিউং হি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) বলেন, "আমি সরকারের বাস্তব পরিকল্পনাটি কী তা জানতে চাই, কারণ এই মুহূর্তে, তারা আসলে কর্মী হিসাবে গণনা করছে, এই তথ্য কীভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, বা অন্য কোনো বিবরণ সম্পর্কে আমাদের কাছে পরিষ্কার ধারণা নেই, শ্রমজীবী ​​বিদেশিরা কোনোভাবেই ভাইরাসে সংক্রমণ বা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে তাদের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।’

ফ্লিন বলেন, ‘এটি একটি দুর্বল চিন্তাভাবনামূলক পরিকল্পনা যেখানে কেবল দুর্বল জনগোষ্ঠী এর শিকার এবং লাঞ্ছিত হচ্ছে।’

ফ্লিন আরও উল্লেখ করেন, ‘আরও অনেক সুপরিচিত উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্র এবং ভেন্যু রয়েছে যেমন গানের ঘর এবং গির্জা, যা বর্তমানে কোনো বিশেষ বিধিনিষেধের আওতাধীন নয়, বা তাদের শ্রমিকরা কোনো ধরনের পরীক্ষার আদেশের অধীনে নেই। শুধু সব কর্মরত বিদেশি পরীক্ষা করার পিছনে কোনো যুক্তি আমি দেখি না।’

সিউলে বসবাসকারী একজন ফ্রিল্যান্সার পল ম্যাথিউজ বলেন, ‘আমি কেবল অভিবাসী হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করতে চাই। তবে হঠাৎ সিউলের প্রতিটি বিদেশির পরীক্ষা করার দাবি করা হাস্যকর বলে মনে হচ্ছে।’

কেননা, কোরিয়াতে করোনা শুরুর দিকে যখন গির্জায় কিছু মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল, যখন শুধু গির্জায় থাকা সব লোককে পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন কিন্তু কোরিয়ার সব খ্রিস্টানের পরীক্ষা করা হয়নি। আমি কেবল তাদের ইচ্ছা এই সিদ্ধান্তটি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতাম যাতে বিদেশি বাসিন্দারা বুঝতে পারে, অন্যথায় এটি আমাদের পক্ষে বর্ণবাদী ও অযৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে।"

সিউলে আরেক বিদেশি বাসিন্দা, একটি আন্তর্জাতিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, ‘আমরা জানি যে বেশির ভাগ ক্লাস্টারগুলি কোথায়- গীর্জা এবং কারখানাগুলি, তবে করোনা সংক্রমণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোরিয়ানদের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও সরকার বিদেশিদের দিকে মনোনিবেশ করতে চায়। এটি কেবল বিদেশিদের প্রতি অবিশ্বাস। যা বিশ্বব্যাপী কোরিয়ার ইমেজ খু্বই খারাপ ভাবে তৈরি হবে।’ তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ভ্যাকসিনগুলির ধীর গতিতে পরিণত হয়েছে।

গিয়োংগিদো প্রদেশের নামায়াংজুতে বসবাসরত একজন ৩৮ বছরের অফিসার কর্মী কিম, তার স্বামী ইতালির বাসিন্দা। দ্য কোরিয়া টাইমসের প্রতিবেদনে তিনি বলেন, তার স্বামীকেও পরীক্ষা করতে হবে কি না তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি প্রাদেশিক সরকারের কল সেন্টারে যোগাযোগ করেছিলেন, কিন্তু পরে তাকে বলা হয়েছিল যে তাকে করার প্রয়োজন নেই। কোরিয়ান এবং ইতালীয় দুটি পাসপোর্টের অধিকারী হওয়ায় তার দরকার নেই।

কিম বলেছিলেন, ‘এর অর্থ কি অন্য দেশের পাসপোর্টযুক্ত লোকেরা করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং কোরিয়ান পাসপোর্টযুক্ত লোকদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম?’ কিম বলেন, ‘এটি আমার মোটেই বোঝা যায় না। তবে এটি একটি বৈষম্যমূলক এবং জিনোফোবিক পরিকল্পনা যা বিদেশিদের বিরুদ্ধে ঘৃণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’

কিম আরো বলেন, সমস্যাটি যদি বিদেশি শ্রমিকরা কারখানার ছাত্রাবাসে থাকতেন তবে তাদের কারখানার কোরিয়ান সহকর্মীদেরও পরীক্ষা করা উচিত, তবে কেন কোরিয়ান কর্মীরা আদেশের অধীন ছিলেন না?

সাধারণত দক্ষিণ কোরিয়াতে ছুটির দিন ছাড়া কর্মব্যস্ততার মধ্যে করোনা পরীক্ষা করা অনেকটাই দুষ্কর বিদেশিদের জন্য। এদিকে সরকারের দেয়া সময়সীমা অনেক কম থাকায় সাপ্তাহিক ছুটিতে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে কেন্দ্রগুলোতে, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে মোটেও কাম্য নয়।

করোনা পরীক্ষার অভিজ্ঞতার কথা বলছেন বাংলাদেশি প্রবাসী সাংবাদিক মো. ইজাজুল হক। তিনি দশ বছরের বেশি সময় ধরে কোরিয়াতে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, ‘একদিকে বৈষম্য, অন্যদিকে প্রদেশের অস্থায়ী পরীক্ষার কেন্দ্রগুলো অপরিকল্পিতভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে সামাজিক দূরত্ব বা এক কথায় স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। ছুটির দিনে হাজার হাজার মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘা ঘেঁষে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে করোনা পরীক্ষা করার জন্য। আবার অনেকেই বেশ কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও তারা পরীক্ষা করতে পারেনি, যা করোনার সম্ভাব্য সংক্রমণের উচ্চঝুঁকি। আর এদিকে সরকার চারজনের বেশি সমাগম হতে নিষেধ করেছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, বিদেশি নয় করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বেশি কোরীয়দের মধ্যে।

লেখক: ঢাকাটাইমসের কোরিয়া প্রতিনিধি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :