স্বাধীনতা: আমার প্রীতম

প্রকাশ | ১৯ মার্চ ২০২১, ১৭:৪০

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

তুমিহীন আমার যে যাপিত জীবন; সে জীবন কেমন জীবন!
কতোটা ঊষর আর কতোটা ধূসর-
সেই রূপরেখা আঁকা আমার জন্যে কতোটা দুষ্কর
আড়ালে থেকেও তুমি জেনেছো তার সব আগাগোড়া
তবু তুমি ফিরলে না, মৌনতা ভাঙলে না,
অভিমানে ছেদ ফেললে না; রয়ে গেলে উদাসীন।
বাজপাখি, চিল আর শকুনেরা বিষাক্ত নখড়ে
ভূমি দস্যুর মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যায় আমার পায়ের তলার সবটুকু জমিন।
আমার খরস্রোতা নদী, আমার কাজলা দিঘি, ফসলের মাঠ,
গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু, মুখের গ্রাস, বাবুই পাখির বাসা, কুহু-কেকা কলরব, বসন্ত বন, খেয়াঘাটের নাও, রাখালের বাঁশি, গোলাপের সুবাস, দোয়েলের শিস, রেলের হুইসেল, আট বেহারার পাল্কি, বাউলের একতারা, নববধুর লাজ,বোনের সম্ভ্রম, ভায়ের আদর, মায়ের মমতা, বিজু বাবুর বায়োস্কোপ, লাল মিয়ার গাজীর পট, জঙ্গনামা পুঁথি, পিতলের পানের বাটা, বাস্তু-বসত, দাদীর রূপার নথ, দাদার চশমাজোড়া, আমার মুখের বুলি, ঠাকুমা’র ঝুলি—
সব লুটে নিয়ে যায় হিংস্র হায়েনার পাল।
তুমি উদাস নজরে দেখলে আমার আজন্ম স্বপ্নের খেলাঘর
কেমন করে দিনে দিনে হয়ে গেলো ছাই-ভস্ম, ধূধূ বালুচর;
এমন মুলুকে দম নেয়ার আরেক নাম
বুকের উপর চেপে থাকা পাথর সরানোর প্রাণান্ত কসরত।
তোমাকে হারিয়ে পলাশীর আম বাগান থেকে সেই-যে কাঁদতে লেগেছি, আর থামাথামি নেই,
যদিও জানি, হৃদয়হীনের কাছে অশ্রুর কোন বিশেষ আবেদন নেই,
ওদের কাছে অশ্রু মানে কেবল ক’ফোঁটা সাধারন নোনা জল।
অথচ আমার সেই অবিরল অশ্রুধারা
গড়ে তুলেছে দক্ষিণের অথৈ সাগর।
তুমি কেবল আনমনে বললে,
‘একে একে মিলে হয় একতা,
জনে জনে মিলে হয় জনতা।
একতার পতাকায় রক্তিম আখরে
লিখা থাকে মুক্তির বারতা।’
তোমার এই ইঙ্গিত ইশারার ঢেউয়ের ছোঁয়া পৌঁছে যায়
কূল ছাপিয়ে কূলে, ঘাট পেরিয়ে ঘাটে, আত্মা থেকে আত্মার গহীনে।
আমরা বিলুপ্তির রাহু থেকে বাঁচতে নিজেরাই হয়েছি অনিরুদ্ধ।
হাতকে করেছি হাতিয়ার, শোকের সাগরে ভাসিয়েছি শক্তির সাম্পান, প্রতিরোধে হয়েছি হিমাচল,
অশ্রুকে করেছি ব্রহ্মাস্ত্র, রক্ত রেণুতে জ্বলেছি আগুনের ফুলকি।
মিছিলে মিছিলে মশালে মশালে জ্বেলেছি লংকার আগুন,
খাক করে দিয়েছি জবর দখলির উদ্ধত রাজদণ্ড, রাজাসন।
প্রাণ দিয়েছি মহাপ্রাণের দিশায়, মান দিয়েছি অনন্ত সম্মানের নেশায়।
বুকের পিঁজরের যেখানটায় তোমার জন্যে ছিলো যুগান্ত
হাহাকার,
বুক উঁচিয়ে সেখানটায় পরে নিয়েছি ঘাতক বুলেটের বিজয় মালা,
লাল রক্তের উষ্ণ সোঁতায় তোমাকে করিয়েছি শোণিতস্নান,
এভাবেই পেয়েছি তোমাকে;
তোমার নব-উত্থান মানে আমার পরিত্রাণ,
আমি আবার খুঁজে পেলাম,সেই হারানো আমাকে,
মহাকাল সবুজের পটে লাল লাল অক্ষরে লিখে নিলো জীবনের বিনিময়ে আমার মিলেছে সশব্দ সন্ধান।
তুমি মানেই আমি; তুমি স্বাধীনতা, আমি তোমার বিজয়ের গান।
হে স্বাধীনতা, তুমিই আমার প্রীতম,
সব না-পাওয়ার সাহারার বুকে সবুজ মরুদ্যান,
আমার শুরু ও আমার শেষের  প্রেমের উপাখ্যান।