আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
| আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২১, ১৬:০৮ | প্রকাশিত : ২৩ মার্চ ২০২১, ০৯:১৫

প্রিয় পাঠক, মেলবোর্নে আজ একটি সুখবর দিয়ে দিন শুরু হয়েছে। আজ মেলবোর্ন-ভিক্টোরিয়া সম্পূর্ণ করোনাভাইরাস মুক্ত। এই দিনটি শুভ হলেও অস্ট্রেলিয়ার অন্য দুটি স্টেটে বন্যা আক্রান্ত হয়ে ১৮০০০ মানুষ গৃহহারা। গেল বছর আগুনে পুড়েছে, এরপর এলো করোনাভাইরাস। আর সেটা থেকে মুক্তি মিলতে না মিলতে বন্যা। আর এসব ছাপিয়ে পার্লামেন্ট যৌন স্ক্যান্ডাল হতাশ করছে সকলকে। সবকিছু মিলিয়ে দিনটি সুন্দর এজন্য যে, বৃষ্টি দরকার। পানির অপর নাম জীবন। বন্যা বাঙালির জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট, ধ্বংস বয়ে এনেছে। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি জীবন। মানুষ আবার মাথা উঁচু করে দিয়ে জীবন চাকা সচল রাখে।

মার্চ মাসের এই দিনগুলি এলে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিকে। এক মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে বাঙালি নয়টি মাস বাঁচার সংগ্রাম করেছে। বালিশচাপা দিয়ে রেডিও শোনা এবং ভয়ে ভয়ে পথচলা ছিল নিত্যদিনের সাথী। এইদিন (২৩ মার্চ- পাকিস্তান দিবস হিসেবে পরিচিত)। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই দিনে বাংলার মাটিতে উড়তো পাকিস্তানি পতাকা। এই দিন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো বাঙালির সাহস ও শক্তির প্ৰতীক। আমরা স্বাধীন- এই ছিল সেদিনের সম্মিলিত ঘোষণা। সারা বাংলাদেশে বাঙালির লাল সবুজের পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে। আমরা স্বাধীন- কী এক অদ্ভুত অনুভূতি! শিহরণ জাগায় আমাদের ধমনীতে শিরায় শিরায়। পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান নয় এটা আমাদের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে বলেই দিয়েছেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ আমাদের মনেই হয়নি আমরা পরাধীন। আমরা সকলেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি- আমরা স্বাধীন এই ছিল যেন আমাদের সকলের অনুভূতি।

কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে পাকহানাদার বাহিনী আমাদের ওপর গণহত্যা চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে পাক বাহিনী ছাত্র শিক্ষকদেরকে হত্যা করে। এবার বঙ্গবন্ধুকে আর কেউও বাধা দেয়নি। বঙ্গবন্ধু বললেন, আজ থেকে আমরা স্বাধীন। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের ইতিহাস এভাবেই আবর্তিত হচ্ছিল।

৯ মাস আমরা পাকিস্তানদের হাতে বন্দি ছিলাম। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করছে দেশকে মুক্ত করবার জন্য। আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করলাম। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন, ভারতীয় সৈনিক ফিরে গেল, ফিরে গেল পাক বাহিনী। আমরা সংবিধান পেলাম। সংবিধান বললো- আমরা মুক্তি সংগ্রাম করিয়া বাংলাদেশ গঠন করিলাম। এই ‘আমরা’ আজ বাংলাদেশের মালিক।

সেদিন কেউ বলেনি আমি বাংলাদেশ স্বাধীন করলাম, আমি বাংলাদেশ দিলাম। সেই থেকে বাংলাদেশ আমাদের সকলের। সেদিন কে বেতারে কোন ঘোষণা দিয়েছিল সেটা মুখ্য ছিল না। দেশ গড়তে হবে ছিল আমাদের শপথ। সেদিন আমার কেউই এই বাংলায় ভেসে আসিনি। সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা দেশ দখল করেনি। তারা বরং বাংলাদেশে দখলদার মুক্ত করেছিল সেদিন, তারা তাদের অস্ত্র জমা দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে।

প্রিয় পাঠক, এখন আপনি হয়তো প্রশ্ন করবেন এগুলো কেন আমাকে শোনাচ্ছেন? দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করছি। কারণ ১/১১-র এক উপদেষ্টা যিনি মাইনাস টু ফর্মুলা দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি একটি টিভি চ্যানেল আপনাদের উদ্দেশে কিছু বলছেন। হয়তো ভাববেন, এরকম একজন মহান ব্যক্তি বলছেন- আমরা ভেসে আসিনি। একদল লোক ভারত থেকে ফিরে দেশটাকে দখল করলো, ইত্যাদি। উনি আপনাদেরকে যা বলছেন তা কেবল পরাজয়ের গ্লানি থেকেই বলছেন।

উনি ২০১৮ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রাজাকারদেরকে পুনর্বাসিত করতে। কিন্তু বিধির বাম। ওনাকে যেতে হয় জেলে। ১৯৭৪ সালে এক অসুস্থ মহিলা যিনি চেতনা হারিয়ে নগ্ন হয়ে ঘুরতেন। তাকে বেছে নিয়েছিলেন ষড়যন্ত্রের পাত্র হিসেবে। তাকে একটি জাল পরিয়ে ছবি তোলেন। আর সেটা ওনার পত্রিকায় সুন্দর করে গল্প বানিয়ে ছাপিয়ে দেন। পৃথিবীতে ওই বাসন্তীর মতো চেতনা হারা মানুষ এখনো আছে। এটা সব দেশেই আছে। মানুষ ভারসাম্য হারায় এবং উভ্ৰান্ত-নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তার মানে পৃথিবী গরিব হয়ে গেছে বলা যায় না।

আমি ইউরোপ আমেরিকার পথেও এমন মানুষ দেখেছি যারা ঐরকম উদ্ভ্রান্ত। তাদের দেখলে আমাদের কষ্ট লাগে। আমরা তাকে একটি নতুন কাপড় কিনে দিই। সেটা হয়তো ফেলে দিয়ে আবার আগের মতো চলে। আমি বলবো না ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। তবে আমি একবোতল কেরোসিনের জন্য ভোররাতে লাইন দিয়ে খালি হাতে ফিরেছি। আমি দেখেছি মানুষ না খেতে পেরে মারা গেছে। আবার একই সময় কেউ কেউ দুটি রেশন কার্ড বানিয়ে লুটপাট করেছেন। আমি বন্যায় আক্রান্ত মানুষদের জন্য রিলিফ নিয়ে গেছি। কিন্তু জীবন সেখানে থেমে যায়নি। আমরা হোঁচট খেয়েছি আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আবার আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি।

আজ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। আমরা সকলে মিলেই দেশের উন্নয়ন করছি। অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ Friedrich August von Hayek বলেছিলেন- অর্থ হচ্ছে আসল ফ্রিডম বা মুক্তি বা সক্ষমতা বা স্বাধীনতা। মিল্টন ফ্রিডম্যান তার এই অর্থনৈতিক দর্শনকে গ্রহণ করেছিলেন। আর পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র এই দর্শনকে নির্ভর করে উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। বাংলার এই বিজয় বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতে রাষ্ট্রকে জনগণ তুলে দিয়েছে বলেই সম্ভব হয়েছে। এই মুক্তির মালিক জনগণ। আমরা সকলেই মিলে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি ।

যারা আজ বলছেন আমরা বানের পানিতে ভেসে আসিনি তারা কেবল মিথ্যাচার করছেন। নিজেদের কুকীর্তি আড়াল করে রাজাকার পুনর্বাসন করবার খায়েশ প্রকাশ করছেন। বাঙালি মানুষ চিনতে ভুল করে না। তারা বঙ্গবন্ধু কন্যাকে নির্বাচিত করেছে। আর আপনাদেরকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। বাংলার পতাকা জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার হাতে নিরাপদ। কোনো হায়েনা তাকে পরাস্ত করতে পারবে না। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা থেকে বাংলাকে যেন আল্লাহ রক্ষা করেন। সকলকে স্বাধীনতা দিবসের অগ্রিম শুভেচ্ছা।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :