গণহত্যা দিবসে আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার

প্রকাশ | ২৫ মার্চ ২০২১, ২২:০৬

মতিয়ার চৌধুরী, লন্ডন

‘৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং গণহত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানি হাইকমান্ডসহ সকল সংগঠনের বিচার’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৫ মার্চ বিকাল ৩টায় গণহত্যার ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ ওয়েবিনারের আয়োজন করেছে।

এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক।

তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুরো সময়ের মতো এমন বর্বরোচিত গণহত্যা পৃথিবীর বুকে কোথাও হয় নি। কিন্তু এই গণহত্যার বিবরণ আমরা বিশ্বে তুলে ধরতে পারি নাই, এটা আমাদের সকলের ব্যর্থতা। সিভিল সোসাইটি, নির্মূল কমিটি এবং সরকার সম্মিলিতভাবে ৭১-এর গণহত্যার বিবরণ বহির্বিশ্বে প্রচার করলে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাকরা মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিপথগামী করার চেষ্টা করেছে। তাদের এ ভূমিকার তদন্ত হওয়া দরকার। ৭১-এর গণহত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাইকমান্ডসহ সকল সংগঠনের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ইতিহাসের মূল্যায়ণের জন্য এ বিচার হওয়া প্রয়োজন। গণহত্যার বিষয়ে বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের মিথ্যাচারের জবাবে গণহত্যার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার প্রচেষ্টায় আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। সকলকে ঐকবদ্ধভাবে এই গণহত্যার প্রকৃত চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে হবে।’

সভাপতির ভাষণে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘দেশের ভেতর নতুন প্রজন্মকে ৭১-এর গণহত্যা সম্পর্কে জানাবার জন্য এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ৭১-এর গণহত্যার নৃশংসতার বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে স্বাধীনতার জন্য জাতিকে কি অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। ২০১৭ সালের মার্চে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সহযোগী রাজনৈতিক দল ও বাহিনীসমূহের নৃশংসতম গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের কোনও উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। কী কারণে এই বিলম্ব তা আমাদের পক্ষে বোঝাও সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার যে প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ অগ্রাহ্য করে ৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচার করছে তার চেয়ে অনেক সহজ কাজ হচ্ছে ৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বছর আমরা ৭১-এর গণহত্যার ৫০ বছর উপলক্ষে এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশে এবং জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে ব্যাপক প্রচারাভিযান পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এর একটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হচ্ছে ৩০ লক্ষ্য গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে জাতিসংঘসহ সকল রাষ্ট্রের নিকট আমাদের গণহত্যার স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আহ্বান জানানো। আমাদের আবেদনপত্রে স্বাক্ষরদানকারীদের ভেতর থাকবেন বিভিন্ন দেশের নোবেলবিজয়ী ব্যক্তিত্বগণ, আইনপ্রণেতা, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, গণহত্যাবিরোধী মানবাধিকার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সহ সর্বস্তরের জনগণ। বিদেশে এই গণস্বাক্ষর সংগ্রহের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ভারত ও রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও সহযোগিতা করবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। প্রয়োজন হচ্ছে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ।’

শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে গণহত্যার যে রাজনীতি বা দর্শন তার মূল উৎপাটন করা। ৭১-এর গণহত্যা হয়েছে ধর্মের নামে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল। ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব গণহত্যার অভিশাপ থেকে কখনও মুক্ত হবে না। বঙ্গবন্ধু এ কারণেই ৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্ত্বা, ভাষা, অঞ্চল যে কারণেই হোক, বিশ্বকে গণহত্যার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হলে গণহত্যার স্বীকৃতিও জরুরি। এই স্বীকৃতি গণহত্যায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পাশাপাশি দেশে দেশে গণহত্যাকারীদের বিচারের পথও সুগম করবে এবং গণহত্যার পুনরাবৃত্তি নিরুৎসাহিত করবে।’ 

নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা শহীদসন্তান কথাশিল্পী অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে হলে এ সম্বন্ধে প্রচুর গবেষণা, লেখালেখি ও প্রকাশনা থাকতে হবে। আমাদের আবেগ থেকে বের হয়ে নতুন প্রজন্মকে এ বিষয়ে গবেষণার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ৭১ সালে আমাদের দেশে সংঘটিত অনেক বড় বড় গণহত্যার ঘটনা এখনও বিশ্ববাসীর কাছে অজানা। এগুলো গবেষণা করে প্রকাশ করতে হবে। মন্ত্রণালয় যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে এ বিষয়ে অনুদান প্রদান করে তাহলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গবেষণার ক্ষেত্র উন্মুক্ত হবে।’

নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরন্নবী বলেন, ‘সরকার উদ্যোগ নিলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমরা গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য একসাথে কাজ করব। পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের গণহত্যার স্মৃতি ভুলে গিয়েছে। সরকারকে এ বিষয়ে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’

নির্মূল কমিটির সর্ব ইউরোপীয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার কর্মী আনসার আহমদ উল্লাহ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ৭১-এর পরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও সাম্প্রদায়িক দলগুলো রাজনীতি করছে। এখন তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার হুমকি দেয়, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার করে। এসব বিষয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা দরকার।’

ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে আরও ছিলেন- মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ডাঃ আলীম চৌধুরীর সহধর্মিণী ও নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী সমাজকর্মী আরমা দত্ত, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ, কেন্দ্রীয় নেতা লেখক সাংবাদিক সাব্বির খান, নির্মূল কমিটি মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি দীপক কুমার ঘোষ, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র ও নির্মূল কমিটি আইটি সেল-এর সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, রংপুর জেলা শাখার সভাপতি ডা. মফিজুল ইসলাম মান্টু, নিউইয়র্ক শাখার সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী স্বীকৃতি বড়ুয়া ও কাজী মুকুল।

(ঢাকাটাইমস/২৫মার্চ/পিএল)