স্বাধীনতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু

ড. মিল্টন বিশ্বাস
| আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২১, ১৭:৪৫ | প্রকাশিত : ২৬ মার্চ ২০২১, ১০:৪১

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা সম্পর্কে ভাবনার চুম্বক অংশসমূহ বিবেচনায় নিলে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে রাজনীতিবিদদের পথ অন্বেষণে সুবিধা হবে। ২৬ মার্চ ১৯৭৫ সাল। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়োজিত জনসভায় জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ দুনিয়ায় এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে, কেউ একে ধ্বংস করতে পারবে না।’ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এ দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর এই কথার সত্যতা খুঁজে পেয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সবাইকে এক হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। এই ঐক্যচেতনা এসেছে গভীর উপলব্ধি থেকে। তাঁর মতে, রক্তের বিনিময়ে ধ্বংস্তূপের মধ্যে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষ ও ৫৪ হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড ছাড়া আমাদের আর কোনো সম্পদ নেই। তাঁর মতে, ‘আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের স্বজন হারানোর অর্থ হলো, আমাদের অর্থনীতির মালিক আমরা এবং আমাদের দেশ সেই সম্পদ ভোগ করবে।’ অথচ তাঁর শাসনামলে বিদেশি চক্র এদেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। তারা এ দেশের স্বাধীনতা বানচাল করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। আর লক্ষ্য সিদ্ধির জন্য বাংলাদেশে চোরাপথে অর্থ আসতে আরম্ভ করে। দেশের মধ্যে শুরু হয় ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ।

বঙ্গবন্ধু-বিরোধী শক্তি রাতের অন্ধকারে তাঁদের হত্যা করে, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যুদ্ধ করেছেন, দেশ ত্যাগ করেছেন, ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে যাদের সম্পত্তি। যারা নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ করেছে, তাদেরও হত্যা করা হয়। যুদ্ধোত্তর পরিবেশে অস্ত্র উদ্ধার তৎপরতা চললেও অস্ত্র তখনো গোপনে অনেকের কাছে ছিল। ফলে রাজনীতির নামে হাইজ্যাক, ডাকাতি, টেলিফোন করে মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় বা মানুষের বাড়িতে গিয়ে গহনা কেড়ে নেওয়া চলতে থাকে। মাত্রই কিছুদিন আগে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটা দেশে এই অবস্থা চলতে দিতে চাননি তিনি। ব্রিটিশ শাসনের ২০০ বছর ও পাকিস্তানি আমলের ২৪ বছর শেষ হলেও কোনো নিয়ম-নীতি না থাকায় চরম অরাজকতার দিকে দেশ যখন পতিত হতে উন্মুখ, তখন তিনি সবকিছু আরম্ভ করেন গোড়া থেকে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এবং আগে যে পলিসি তিনি নিয়েছিলেন, বিশেষত বৈদেশিক নীতিকে বাংলাদেশের মানুষ, শিক্ষিত সমাজ এবং দুনিয়াবাসী তার প্রশংসা করেছে।

স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা দুনিয়ার নির্যাতিত পিপল-এর সাথে আছি, আমরা কারো সাথে শত্রুতা করতে চাই না। আমরা সকলের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। আমরা আন্ডারডেভেলপড কান্ট্রি। আমরা বিশ্বে শান্তি চাই। আমরা কারো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমাদের ব্যাপারেও কেউ হস্তক্ষেপ করুক এটা আমরা চাই না।’ তাঁর আমল থেকেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য। জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠী, কমনওয়েলথ ও ইসলামি সামিট-এর সদস্য। ইউএনও-র চার্টারে বিশ্বাস করা হয় তখন থেকেই। তাঁর আমল থেকেই সবাই এ দেশের বন্ধু। তাঁর কাছে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল- মানুষের মঙ্গল করা, দেশকে গড়ে তোলা। এ জন্য সাবকন্টিনেন্টে একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে এ দেশে উন্নয়নের কাজ করতে চেয়েছিলেন তিনি।

স্বাধীনতার সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তাদের বঙ্গবন্ধু ক্ষমা করে দিয়েছিলেন সত্য। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশে বিপ্লবের পরে এভাবে ক্ষমা করা হয়নি, একেবারে নির্মূল করে দেওয়া হয়েছে। এ দেশের দুর্ভাগ্য হলো, সেই ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই তাঁর আমল থেকেই সরকারবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়।

এসব দেখে বুঝে তিনি জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে পুরাতন সরকারনীতির পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যারা এক মত, এক পথ, তারা মিলে একসঙ্গে এক ঐক্যে নতুন দলের সৃষ্টি করেছিলেন। ‘বাকশাল’ ছিল স্বাধীন দেশের নতুন সিস্টেম। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য এক দল করা হয়। যারা বাংলাকে ভালোবাসে, এর আদর্শে বিশ্বাস করে, চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ মানে, সৎ পথে চলে- তারা সবাই ওই দলের সদস্য হতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধু ঘুণে ধরা শাসনব্যবস্থা ভেঙে চুরমার করতে চেয়েছিলেন। বিচার পদ্ধতিকে ভেঙেচুরে জনগণ যাতে তাড়াতাড়ি বিচার পায়, সে রকম ব্যবস্থা নতুন করে করতে চেয়েছিলেন। করেছিলেন শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ।

স্বাধীনতা বলতে তিনি বুঝেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে। এমনকি রাষ্ট্রের সার্বভৌম রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীকে বসিয়ে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁর মতে, ‘আই ওয়ান্ট মাই আর্মি—এ পিপলস্ আর্মি। আই ডু নট ওয়ান্ট মাই আর্মি টু ফাইট অ্যাগেইনস্ট এনিবডি। বাট আই ওয়ান্ট মাই আর্মি টু ডিফেন্ড মাইসেলফ অ্যান্ড অ্যাট দি সেম টাইম টু ওয়ার্ক।’ স্বাধীন দেশে তিনি করাপশন-এর অবসান চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন, পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না। এবং সেই সঙ্গে সিস্টেমই পরিবর্তন করতে হবে। ঘুণে ধরা সিস্টেম দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যায় না। গত ৫০ বছরে এ দেশের মানুষের সেই সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। এ জন্য করাপশনও দূর হয়নি এ দেশ থেকে। স্বাধীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে তিনি চিন্তা করে গেছেন। তিনি মনে করতেন, নতুন এডুকেশন সিস্টেম কেরানি পয়দা করার জন্য হবে না, বরং মানুষ পয়দা করবে। তবে এটা তিনি জানতেন, তিন বছর, সাড়ে তিন বছর একটা দেশের জীবনে কিছুই না। দেশের সার্বিক অবস্থা ইমপ্রুভ করতে সময় লাগবে।

পশ্চিমা দুনিয়া থেকে পাওয়া তত্ত্ব নয়, বরং যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন, তা ছিল এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত। আসলে বঙ্গবন্ধুর শোষণহীন সমাজব্যবস্থায় মানুষ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করার স্বপ্ন দেখেছিল। আর তিনি চেয়েছিলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইজ্জত সহকারে দুনিয়াতে বাঁচিয়ে রাখা, বাংলার দুঃখী মানুষকে পেট ভরে খাবার দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করা, যেখানে অত্যাচার-অবিচার, জুলুম থাকবে না, দুর্নীতি থাকবে না।

ক্ষমতা বন্দুকের নলে- এ বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্ষমতা বাংলার জনগণের কাছে। জনগণ যেদিন বলবে, ‘বঙ্গবন্ধু ছেড়ে দাও’, বঙ্গবন্ধু তারপর এক দিনও রাষ্ট্রপতি, এক দিনও প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় কিংবা তারপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এসেও বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছেন দুঃখী মানুষকে ভালোবেসে, তিনি রাজনীতি করেছেন শোষণহীন সমাজ কায়েম করার জন্য। এ কারণে স্বাধীনতা তাঁর কাছে এভাবে ধরা দিয়েছে- ‘আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। কি স্বাধীনতা? আপনাদের মনে আছে, আমার কথার মধ্যে দুইটি কথা ছিল। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুঃখী মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়, তা হলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না।’

অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বাধীনতার মানে ছিল শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, তাঁর আত্মত্যাগের জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা আজ দুনিয়ায় ওড়ে।

(লেখক: ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম। নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক: ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম; নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

([email protected])

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :